বৈদেশিক ঋণ গ্রহণে এখনও ঝুঁকিমুক্ত অবস্থানে বাংলাদেশ

শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক চরম অর্থনৈতিক সংকটের অন্যতম কারণ অনিয়ন্ত্রিত বৈদেশিক ঋণ ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছে শেয়ার বিজ। এতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। এ নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের আজ প্রকাশিত হচ্ছে প্রথম পর্ব

ইসমাইল আলী ও মাসুম বিল্লাহ: অর্থনৈতিক সংকট ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কায়। অনিয়ন্ত্রিত কঠিন শর্তের বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ, অভ্যন্তরীণ মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় অদূরদর্শিতা, মেগা প্রকল্পের দুর্নীতি প্রভৃতি কারণে দেশটির অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। বর্তমানে দেশটির বৈদেশিক ঋণ-জিডিপি অনুপাত দাঁড়িয়েছে ৬১ শতাংশের বেশি, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা নির্দেশ করছে। কারণ কোনো দেশের জন্য বৈদেশিক ঋণ-জিডিপি অনুপাত ২০ শতাংশকে আদর্শ বলে মনে করা হয়।

শ্রীলঙ্কায় সংকট এতটাই ঘনীভূত হয়েছে যে, কাগজ, জ্বালানি তেলসহ প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার সংকুলান নেই। ফলে কাগজ সংকটে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে স্কুল-কলেজ। জ্বালানি তেল সংকটে গণপরিবহন বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো দৈনিক ১০ ঘণ্টা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। সংকটের মুখে দেশটির মন্ত্রিসভার ২৬ সদস্য ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গর্ভনর গতকাল পদত্যাগ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিরও পদত্যাগ দাবি করছে দেশটির জনগণ।

প্রতিবেশী দেশটির এ অবস্থা দেখে সাধারণ মানুষের অনেকেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। বৈদেশিক ঋণের দ্রুত বৃদ্ধি ও মেগা প্রকল্পে নানা অনিয়মের খবর এ শঙ্কাকে আরও ঘনীভূত করেছে। যদিও বৈদেশিক ঋণে বাংলাদেশ এখনও ঝুঁকিমুক্ত বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ-জিডিপির অনুপাত এখনও ২০ শতাংশের নিচেই রয়েছে। তবে ঋণ গ্রহণ দ্রুত বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ যাতে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতির সম্মুখীন না হয়, সেজন্য এখন থেকেই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন বলে মত তাদের।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যমতে, ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল এক বিলিয়ন ডলারেরও কম (৯৭ কোটি ডলার)। স্বাধীনতা-উত্তর দারিদ্র্যপীড়িত বাংলাদেশ তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও দাতাদের থেকে অনুদানই পেত বেশি। ফলে সে সময় বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বাড়ত খুবই ধীরগতিতে। এতে ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে দেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় চার দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারে।

পরের দশকে যদিও তা বৃদ্ধির হার কিছুটা বাড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে দেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলারে। পরের দশকে তা বৃদ্ধির হার কমে আসে। এতে ২০০০-০১ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫ দশমিক শূন্য সাত বিলিয়ন ডলারে। আর ২০১০-১১ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ২৩ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারে। তবে গত এক দশকে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের হার দ্রুত বাড়ায় ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে এর স্থিতি দাঁড়ায় ৬০ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ এক লাফে প্রায় আড়াইগুণ হয়ে গেছে।

যদিও এর পুরোটাই সরকারের নিজস্ব ঋণ নয়। এর মধ্যে সরকারের বৈদেশিক ঋণ রয়েছে ৫০ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার। অবশিষ্ট ঋণের মধ্যে রয়েছে আইএমএফের বাজেট সহায়তা ও সরকারি বিভিন্ন সংস্থার ঋণ। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতের জন্য নেয়া হয়েছে পাঁচ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার, আইএমএফের দুই দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার, বিমান বাংলাদেশ এয়ালাইনসের উড়োজাহাজ কেনায় এক দশমিক শূন্য চার বিলিয়ন ডলার, বিসিআইসির সার কেনায় শূন্য দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার এবং বিপিসির অপরিশোধিত তেল কেনায় শূন্য দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত এক দশকে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ এ সময় বেশকিছু মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটির জন্য নেয়া হয়েছে কঠিন শর্তের ঋণ। তবে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ-জিডিপি অনুপাত এখনও রয়েছে আদর্শ মানের চেয়ে কম। যদিও সম্প্রতি তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে ঝুঁকি এড়াতে এসব বৈদেশিক ঋণের ব্যবহারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি।

ইআরডির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত সাত বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছর দেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ২৬ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। পরের অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৯ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছর বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৩২ দশমিক শূন্য সাত বিলিয়ন এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছর ৩৮ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার।

পরের তিন অর্থবছর তা আরও দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছর এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৪ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন  ডলার, ২০১৯-২০ অর্থবছর ৫১ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার ও ২০২০-২১ অর্থবছর ৬০ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার।

বৈদেশিক ঋণের এ দ্রুত বৃদ্ধি বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার পথে নিয়ে যাচ্ছে কি না- জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘মূলত বাজেটীয় অব্যবস্থাপনার কারণে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে এমন বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এ অব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও নানা মাত্রা রয়েছে। প্রথমত, দেশটির সরকার অধিক জনপ্রিয়তা পাওয়ার লক্ষ্যে ব্যাপক হারে কর হ্রাস করেছে। কিন্তু সরকারি ব্যয় নির্বাহের জন্য বিকল্প অর্থ সংস্থানের ব্যবস্থা করেনি। এক্ষেত্রে অর্থের প্রয়োজন মেটাতে নতুন করে ব্যাপক হারে নোট ছাপানো হয়েছে। এতে করে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ এমন কিছু করেনি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কোনো ঝুঁকির মধ্যে নেই।’

যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ও জিডিপির অনুপাত কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইআরডির তথ্যমতে, স্বাধীনতা-উত্তরকালে (১৯৭৪-৭৫ অর্থবছর) বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ-জিডিপি অনুপাত ছিল মাত্র সাত শতাংশ। তবে পরের কয়েক বছরে তা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরেই দেশের বৈদেশিক ঋণ-জিডিপি অনুপাত ২৫ শতাংশ অতিক্রম করে। পরের দুই অর্থবছর তা আরও বেড়ে যথাক্রমে ৩২ ও ৩৩ শতাংশে পৌঁছে। তবে ১৯৭৯-৮০ অর্থবছরে এ অনুপাত কমে ১৮ শতাংশে নেমে আসে। এর পর মোটামুটি ঊর্ধ্বমুখীই ছিল দেশের বৈদেশিক ঋণ-জিডিপি অনুপাত। ১৯৯২-৯৩ ও ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছর তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল। ওই দুই বছর এ অনুপাত ছিল ৪৫ শতাংশের ওপরে।

এর পর থেকে বৈদেশিক ঋণ-জিডিপি অনুপাত মোটামুটি নিম্নমুখী ছিল। এতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে অনুপাতটি ১৩ শতাংশে নেমে আসে। পরের কয়েক বছর যদিও তা একটু একটু করে বাড়ছে। এতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ-জিডিপি অনুপাত ১৫ শতাংশ অতিক্রম করে। আর সর্বশেষ অর্থবছর তা ছিল প্রায় ১৭ শতাংশ। মূলত মেগা বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ গ্রহণ বৃদ্ধিকেই এজন্য দায়ী করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক এ ধারার সঙ্গে শ্রীলঙ্কার আর্থিক দুরবস্থার দ্বিতীয় কারণটি কিছুটা সংগতিপূর্ণ বলে মনে করেন ড. জাহিদ হোসেন। এ বিষয়ে এখনই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন উল্লেখ করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, শ্রীলঙ্কার দুরবস্থার দ্বিতীয় কারণটি হলো অনেক বড় বড় ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ। আর শ্রীলঙ্কা এসব বড় প্রকল্পে দ্বিপক্ষীয় উৎস থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছে। এসব প্রকল্পের বেশ কয়েকটির তেমন কোনো প্রয়োজনই ছিল না। আর যেসব ঋণ নেয়া হয়েছে, সেগুলোর সিংহভাগের ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। ফলে যে কাজের জন্য ঋণে নেয়া হয়েছে, সে কাজে অর্থ ব্যয় না হয়ে অন্যদিকে চলে গেছে, যা শ্রীলঙ্কার দুরবস্থার অন্যতম কারণ।’

তিনি বলেন, ‘এখন বাংলাদেশও অনেক বড় বড় প্রকল্প নিচ্ছে এবং এক্ষেত্রে কিছু অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পও এডিপিতে (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) ঢুকে পড়ছে। এসব প্রকল্পে কঠিন শর্তের ঋণও নেয়া হচ্ছে। এসব ঋণের অনেকগুলোর রিপেমেন্ট (পরিশোধ) খুব দ্রুত শুরু হবে। তখন ঋণ পরিশোধের অর্থের জোগান দিতে গিয়ে বাজেটের ওপর চাপ পড়তে পারে। তাই বাংলাদেশ যাতে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতির সম্মুখীন না হয়, সেজন্য এখন থেকেই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।’

এদিকে হঠাৎ করে রাসায়নিক সার আমদানি বন্ধ করে দেয়া শ্রীলঙ্কার সংকটের পেছনে তৃতীয় বড় কারণ বলে মনে করেন ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, মূলত জৈব (অগ্রানিক) পদ্ধতির চাষাবাদ ব্যবস্থা চালুর লক্ষ্যে দেশটি রাসায়নিক সার উৎপাদন ও আমদানির ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। এতে দেশটিতে খাদ্য উৎপাদন ব্যাপক হারে কমে গেছে। ফলে একদিকে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে, অন্যদিকে খাদ্যে মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে ব্যাপক হারে। এদিক থেকেও বাংলাদেশ নিরাপদে আছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শ্রীলঙ্কার এই সংকটের কোনো প্রভাব পড়বে কি না- জানতে চাইলে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শ্রীলঙ্কা সংকটের সরাসরি যে প্রভাব পড়তে পারে তা হলো, বাংলাদেশ দেশটিকে যে ২৫ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে, তা ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০