বৈদেশিক মুদ্রার বাজার শান্ত হবে কবে?

রোহান রাজিব: চলতি বছরের মে মাস থেকে দেশের মুদ্রা বাজারের অস্থিরতা চলছে। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপেও অস্থিরতা থামছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার এখন বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে এখন ডলারের দাম প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে আন্তঃব্যাংক ফের জোরদার হতে শুরু করেছে। এতে করে ডলারের দাম খুব দ্রুত ওঠানামা করছে। কিন্তু তাতে সংকট কাটেনি। তাই সবার মনে প্রশ্নÑ বৈদেশিক মুদ্রার বাজার কবে শান্ত হবে?

সংশ্লিষ্টরা ও অর্থনীতিবিদের মতে, বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে চলমান সংকট কাটাতে বাফেদা ও এবিবি যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা কোনো সমাধান নয়। এতে অনেক ধরনের সমস্যা তৈরি হবে। এমন অভিন্ন রেট পৃথিবীর কোথাও নেই। তাই সহজে ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা আসবে না। ডলার বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো ভূমিকা কাজে আসছে না। তাই তারা এখন বিষয়টি বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। এতে আন্তঃব্যাংক লেনদেন চালু হয়েছে। এটা একটা ভালো দিক বলে উল্লেখ করেছেন পর্যবেক্ষকরা। তবে বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে অভিন্ন বিনিময় হার একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে তারা মনে করেন।

জানা গেছে, আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ে ডলার বিনিময় ক্ষেত্রে দামের ব্যাপক পার্থক্যের ফলে আমদানিকারকরা বিপাকে পড়েছেন। একই দরে পণ্য আমদানি করলেও শুধু ব্যাংক ভিন্ন হওয়ায় আমদানিকারক ভেদে খরচের বড় তারতম্য হচ্ছে। এ ব্যবধানের ফলে বাজারে পণ্যমূল্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকে ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, একটা বড় সমস্যা ছিল আন্তঃব্যাংক বাজারটা এতদিন অকার্যকর ছিল। যেটা বাফেদা ও এবিবি বাংলাদেশ ব্যাংককে রাজি করে চালু করতে পেরেছে। তবে বাফেদা ও এবিবি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা কোনো টেকসই সমাধান নয়। কারণ এমন অভিন্ন রেট পৃথিবীর কোনো দেশে নেই। তাই রেট বাঁধার প্রক্রিয়া থেকে সরে আসতে হবে। তা না হলে বাজার স্থিতিশীল করা সম্ভব হবে না।

তিনি বলেন, তাদের অভিন্ন রেটের কারণে রপ্তানির ডলার কেনা হচ্ছে ৯৯ টাকায়, আর রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে ১০৮ টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এ হার ৯৬ টাকা। আবার বাজার বিবেচনায় নিয়ে আন্তঃব্যাংক ডলারের রেট ভিন্ন। এত পার্থক্য রেখে ডলারের দাম স্থিতিশীল করা যাবে না। প্রবাসী আয়ে দাম কমাতে হবে, রপ্তানিতে দাম বাড়াতে হবে। এভাবে সব ক্ষেত্রে ডলারের দাম এক করে ফেলতে হবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলে বাজার স্থিতিশীল হবে। এ ফরমুলা থেকে যতদিন সরে না আসবে ততদিন বাজার স্থিতিশীল হবে না।

বাফেদা ও এবিবির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রবাসী আয়ে ডলারের বিনিময় হার হবে ১০৮ টাকা এবং রপ্তানি আয়ে ৯৯ টাকা। এই দামেই ডলার কিনছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে ব্যাংকগুলোর ডলারের কেনাবেচার গড় দাম প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, মঙ্গলবার ব্যাংকে ডলারের গড় ক্রয়মূল্য ছিল ১০১ টাকা ৬৭ পয়সা, যা গত বুধবার বেড়ে হয় ১০২ টাকা ৩৭ পয়সা। আর ব্যাংকগুলোর বিক্রয়মূল্য বেড়ে হয়েছে ১০৬ টাকা ৯০ পয়সা, যা গত মঙ্গলবার ছিল ১০৬ টাকা ১৫ পয়সা।

ব্যাংকগুলোর ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালী ব্যাংক গতকাল আমদানি দায় নিষ্পত্তিতে প্রতি ডলারে ১০৬ টাকা ৮০ পয়সা নিয়েছে। অগ্রণী ব্যাংক নিয়েছে ১০৬ টাকা। অথচ রূপালী ব্যাংক নিয়েছে ১০৭ টাকা ৩০ পয়সা। আর জনতা ব্যাংক ১০৬ টাকা ৫০ পয়সা নিয়েছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর চেয়ে কম রেটে এলসি নিষ্পত্তি করেছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। বেসরকারি খাতের ইস্টার্ন ব্যাংক নিয়েছে ১০৩ টাকা। ব্র্যাক ব্যাংক যেখানে আমদানি নিষ্পত্তি করেছে ১০৪ টাকা ৮০ পয়সায়। সাউথইস্ট ব্যাংক নিয়েছে ১০১ টাকা ৮৮ পয়সা। ব্যাংকের ডলার কেনার গড় খরচের ভিত্তিতে এ দর ঠিক করা হয়েছে। গড় দরের ভিত্তিতে আন্তঃব্যাংকে ডলার কেনাবেচা হচ্ছে।

??এদিকে নগদ ডলারের চরম সংকট চলছে খোলাবাজারে। বাড়তি মূল্য দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না ডলার। গতকাল খোলাবাজার পরিদর্শনে দেখা যায়, ডলার কেনার ক্ষেত্রে ১০৭ টাকা এবং বিক্রির ক্ষেত্রে ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা লিখে সাইনবোর্ড দিয়েছে অধিকাংশ এক্সচেঞ্জ হাউস। কিন্তু তাদের কাছে কোনো ডলার নেই। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ফকিরাপুলের মনডিয়াল মানি এক্সচেঞ্জের এক প্রতিনিধি জানান, ডলার পাওয়া যাবে, তবে অন্য হাউস থেকে এনে দিতে হবে। এর জন্য গুনতে হবে বাড়তি অর্থ। ওই প্রতিনিধি বলেন, ‘আজ (গতকাল) আমরা ১১২ টাকা ৫০ পয়সাতে ডলার কিনছি এবং বিক্রি করছি ১১৩ টাকা ৪০ পয়সা দরে।’

এর আগে ডলার বাজার অস্থিরতা কমাতে কয়েকবার বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক, এবিবি ও বাফেদা। সর্বশেষ গত ৮ সেপ্টেম্বর এবিবি ও বাফেদার প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করে। সেদিন সিদ্ধান্ত হয় ডলারের দাম নির্ধারিত হবে চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে। ব্যাংকগুলো নিজেই এ দাম নির্ধারণ করবে। প্রবাসী ও রপ্তানি আয়, আমদানি বিল নিষ্পত্তিসহ প্রতিটি লেনদেনে ডলারের দাম হবে পৃথক। তবে সব ব্যাংক প্রতি লেনদেনেই একই দামে ডলার কেনাবেচা করবে। কেনাবেচায় মুনাফা হবে সর্বোচ্চ এক টাকা। সেদিনের সিদ্ধান্তের ফলে গত ১১ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে এবিবি ও বাফেদার শীর্ষ কর্মকর্তারা এক সভায় বিভিন্ন লেনদেনে ডলারের সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ করেন।

সম্প্রতি ডলার কেনাবেচায় অতি মুনাফা করায় এখন পর্যন্ত দেশি-বিদেশি ১৩ ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ছয় ব্যাংকের এমডিদের নোটিশ দেয়া হয়েছে, সরিয়ে দেয়া হয়েছে ট্রেজারি বিভাগের প্রধানদের।

এই ব্যাংকগুলো হলোÑস্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, প্রাইম, ব্র্যাক, দি সিটি, ডাচ্-বাংলা ও সাউথইস্ট ব্যাংক। এ ছাড়া ব্যাখ্যা চাওয়া ব্যাংকগুলো হলো এইচএসবিসি, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), এনসিসি ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া ও ইস্টার্ন ব্যাংক।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০