দেশের ব্যবসায়ীদের প্রভাবশালী সংগঠনের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে বৈদেশিক লেনদেন সংক্রান্ত যে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, তা উদ্বেগের। তারা জানিয়েছেন, গত বছরের জুলাই থেকে নভেম্বরে চলতি হিসাবে যে ঘাটতি দেখা গেছে, তা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এ সময়ে চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল ৭২ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০১১-১২ অর্থবছরে এটি ছিল ৪৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার। মূলত রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস ও প্রত্যাশার চেয়ে কম রফতানির কারণেই এমনটি ঘটেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের এ যুক্তি যে যথার্থ, তাতে সন্দেহ নেই। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, উল্লিখিত সময়ে রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ; আমদানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল সাড়ে ৯ শতাংশ। আর রেমিট্যান্সে এ সময়ে প্রবাহ কমেছে ১৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
এটা ঠিক, রফতানির তুলনায় আমদানি প্রবৃদ্ধি বেশি হলে বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়। কিন্তু এ সময়ে আমদানি প্রবৃদ্ধি এত বাড়লো কেন, সেটাও চিন্তার বিষয়। উল্লিখিত সময়ে বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদনে লক্ষ করা গেছে, দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ ভালো না থাকায় পুঁজি পাচার করছেন কেউ কেউ। আমদানি প্রবৃদ্ধির যে হার অর্জিত হয়েছে, তা থেকে সংগত কারণেই সন্দেহ জোরালো হয়। সাধারণত এমনটি করা হয় ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে। আমদানি প্রবৃদ্ধি বেশি হওয়ার পেছনে এটা ‘কারণ’ হিসেবে কাজ করছে কি না, আমরা খতিয়ে দেখতে বলবো সংশ্লিষ্টদের। এও ঠিক, একটি নির্দিষ্ট সময়ে হঠাৎ দেশের রফতানির উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব নয়। এজন্য উপযুক্ত পরিকল্পনা ও সময় প্রয়োজন। আমরা চাইবো, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রফতানি বাড়ানোর ব্যাপারে দ্রুতই পদক্ষেপ নেওয়া হোক। এজন্য যে অবকাঠামোগত সহায়তা দরকার, তাও সংশ্লিষ্টদের জোগানো হোক কাক্সিক্ষত সময়ের মধ্যে। আয় সক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে এখন বিদেশমুখী প্রবণতা বেড়ে উঠেছে মানুষের মধ্যে; বেড়েছে বিলাসদ্রব্য আমদানি। কাঠামোগত পদ্ধতি ব্যবহার করে সাময়িকভাবে এগুলোকে নিরুৎসাহিত করা যায় কি না, তাও ভেবে দেখতে বলবো সংশ্লিষ্টদের। তবে এর মাধ্যমে যেন মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি বাধাগ্রস্ত না হয়, সেটিও রাখতে হবে বিবেচনায়।
আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার উল্লেখযোগ্য অংশ আসে প্রবাসী আয় থেকে। কারও অজানা নয়, নিকট অতীতে সেটি কমে এসেছে এবং এ ধারা রয়েছে অব্যাহত। এর পেছনে কিছু কারণ অবশ্য রয়েছে। তবে এর কোনো কোনোটির ব্যাপারে সমাধান দেশে থেকেই যে সম্ভব, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। সহযোগী এক দৈনিকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যাংকের তুলনায় অনানুষ্ঠানিক খাতে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বেশি। এজন্য বেড়েছে ব্যাংকবহির্ভূত চ্যানেলে প্রবাসী আয় পাঠানোর প্রবণতা। এর প্রভাবও যে বৈদেশিক লেনদেনে গিয়ে পড়ছে, সংশ্লিষ্টদের তা জানা। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যেসব বাস্তবতা রেমিট্যান্স প্রবাহে প্রভাব ফেলছে, রাতারাতি সেগুলো পাল্টানো সম্ভব নয়। কিন্তু দেশীয় নীতি-পদ্ধতি শক্তিশালী করে যেসব ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিলে এ ব্যাপারে অগ্রগতি অর্জন সম্ভব, সেগুলোও নিতে বলবো সরকারকে।
মনে রাখা দরকার, বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্যহীনতা অর্থনীতিকে দুর্বল করে। এ ধারা বেশিদিন অব্যাহত থাকলে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারও হয়ে উঠবে অস্থিতিশীল। এর প্রভাব আরও নানাভাবে গিয়ে পড়বে জনজীবনে। বস্তুত এ অবস্থায় নীতি প্রণয়ন ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া গেলে উল্লিখিত সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন নয়। আমরা মনে করি, এ সমস্যা থেকে উত্তরণের পদক্ষেপগুলো শিগগির নেওয়া দরকার। ২০২১ সালকেন্দ্রিক সরকারি লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আমাদের মোট দেশজ উৎপাদন বাড়াতে হবে। উল্লিখিত পদক্ষেপগুলো ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এক্ষেত্রেও। নিকট ও দূরযাত্রায় ভিন্ন ধরনের প্রস্তুতি নিতে হয় যাত্রীকে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দূরযাত্রার যে লক্ষ্য সরকার ইতোমধ্যে ব্যক্ত করেছে, সেই গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্যই বর্তমানের সমস্যাগুলো এড়িয়ে চলা যাবে না।
Add Comment