রহমত রহমান: দেশে প্রতিনিয়ত বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স নেয়ার সংখ্যা বাড়ছে। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেয় সরকার। কোনো সাধারণ মানুষ বা ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স নিতে পারেন না। মূলত যেসব ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের ভালো আয় রয়েছে তারাই কেবল আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স নিতে পারে। তবে লাইসেন্সপ্রাপ্ত বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র নেয়া মালিকদের বেশিরভাগই তাদের প্রকৃত আয় ও সম্পদ আয়কর রিটার্নে দেখায় না। সেজন্য অস্ত্রের লাইসেন্স নেয়া করদাতাদের আয়কর রিটার্নের তথ্য, বিশেষ করে আয় যাচাইয়ের উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সে জন্য কর অঞ্চলের কাছে বৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সপ্রাপ্ত করদাতাদের দুই বছরের রিটার্নের তথ্য চাওয়া হয়েছে। আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ই-মেইল ও ডাকযোগে ছক আকারে তথ্য দিতে চিঠি দেয়া হয়েছে। এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা ৫০ হাজার ৩১০টি। এর মধ্যে বেশিরভাগ মালিক সঠিকভাবে রিটার্নে আয় ও সম্পদ দেখায় না। আবার অনেকে রিটার্ন দেয় না। আয়কর আইন অনুযায়ী, লাইসেন্স প্রাপ্তি ও নবায়নে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণক বা পিএসআর যাচাইয়ের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই তথ্য নেয়ার মাধ্যমে একদিকে পিএসআর যাচাই হবে, অন্যদিকে কোনো মালিক কর ফাঁকি দিয়েছেন কি নাÑতা বের হয়ে আসবে।
এনবিআর সূত্রমতে, ১২ ডিসেম্বর সব কর অঞ্চলের কমিশনারকে এই চিঠি দেয়া হয়েছে। মূলত আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সপ্রাপ্তি ও বহাল রাখার ক্ষেত্রে লাইসেন্স গ্রহণকারী করদাতাদের আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র (পিএসআর) যাচাইয়ের জন্য এই চিঠি দেয়া হয়েছে। এনবিআরের দ্বিতীয় সচিব (কর ফাঁকি ও আইটিপি রেজি.) মীর মো. আরিফ হোসেন সই করা চিঠিতে বলা হয়েছে, আয়কর আইন, ২০২৩ এবং অর্থ আইন, ২০২২-এর বিধান অনুসারে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স গ্রহণ ও বহাল রাখার ক্ষেত্রে লাইসেন্স গ্রহণকারী ব্যক্তি প্রতি বছর আয়কর রিটার্ন দাখিল করে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণক (পিএসআর) জমার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেজন্য আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সপ্রাপ্তি এবং বহাল রাখার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট লাইসেন্স গ্রহণকারী ব্যক্তির ই-টিআইএন, আয়কর রিটার্ন দাখিল ও দাখিলকৃত আয়কর রিটার্ন মোতাবেক আয়কর পরিশোধ, আয়কর আইনের যথাযথ পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে। আগ্নেয়াস্ত্র গ্রহণকারী ব্যক্তি যথানিয়মে আয়কর রিটার্ন দাখিল নিশ্চিতকরণ-সংক্রান্ত তথ্য সংযুক্ত ছক মোতাবেক আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ই-মেইল ও হার্ড কপি এনবিআরে প্রেরণের জন্য অনুরোধ করা হলো।
সূত্রমতে, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ই-মেইল ও ডাকযোগে আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্সপ্রাপ্ত বা গ্রহণকারী করদাতাদের তথ্য এনবিআরে পাঠাতে চিঠিতে কর কমিশনারদের অনুরোধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, অর্থ আইন, ২০২২ ও আয়কর আইন, ২০২৩ অনুযায়ী আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সপ্রাপ্ত বা গ্রহণকারী করদাতাদের ছক আকারে তথ্য দিতে হবে। ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ কর বছরের তথ্য দিতে হবে। এতে করদাতার এই দুই কর বছরে প্রদর্শিত আয় ও নিরূপিত আয় এবং প্রদত্ত করের পরিমাণ। এছাড়া এনবিআর থেকে চিঠির সঙ্গে দেয়া ছকে আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্সপ্রাপ্ত করদাতার নাম, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা, ই-টিআইএন, জাতীয় পরিচয়পত্র নাম্বার, লাইসেন্সপ্রাপ্ত অস্ত্রের বিবরণ, মডেল নাম্বার, লাইসেন্স আবেদন ও লাইসেন্সপ্রাপ্তির তারিখের তথ্য দিতে হবে।
অপরদিকে, আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা, ২০১৬ অনুযায়ী ব্যক্তি পর্যায়ে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স নিতে হলে ওই ব্যক্তিকে (বাংলাদেশি নাগরিক) ‘ব্যক্তি শ্রেণির’ আয়করদাতা হতে হবে। আবেদনকারীকে আবেদনের পূর্ববর্তী তিন বছর ধারাবাহিকভাবে পিস্তল, রিভলবার, রাইফেলের ক্ষেত্রে ন্যূনতম তিন লাখ এবং শর্টগানের ক্ষেত্রে ন্যূনতম এক লাখ টাকা আয়কর দিতে হবে। আবেদনকারী কর্তৃক পরিশোধিত আয়করের পরিমাণ উল্লেখসহ এনবিআর কর্তৃক ইস্যুকৃত প্রত্যয়নপত্র আবেদনের সঙ্গে দাখিল করতে হবে। আর প্রবাসী বাংলাদেশি বা বাংলাদেশি দ্বৈত নাগরিকের ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্সের জন্য আবেদনের যোগ্যতা হিসেবে ধারাবাহিকভাবে সর্বশেষ তিন বছরে প্রতিবছর ন্যূনতম ১২ লাখ টাকা হারে রেমিট্যান্স এবং বিদেশে আয়কর প্রদানের প্রমাণপত্র থাকতে হবে। রেমিট্যান্সকৃত অর্থ শুধু যেসকল সরকারি বা বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়েছে, ওই সব ব্যাংকের প্রত্যয়নপত্র দাখিল করতে হবে।
অন্যদিকে, নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে আগ্নেয়াস্ত্র নিতে হলে প্রতিষ্ঠানের ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধন ১০ কোটি টাকা হতে হবে। নীতিমালায় বলা হয়েছে, যেকোনো সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ১০ কোটি টাকা এমন যেকোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বুঝাবে। আর ডিলিং লাইসেন্স নিতে হলেও প্রতিষ্ঠানের মালিককে ব্যক্তি পর্যায়ে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার সাধারণ যোগ্যতা সম্পন্ন হতে হবে। নীতিমালায় বলা হয়েছে, ডিলিং লাইসেন্সের আবেদনকারীকে বিগত তিন বছরে ধারাবাহিকভাবে ব্যক্তি শ্রেণির আয়করদাতা হিসেবে পাঁচ লাখ টাকা আয়কর প্রদান করতে হবে। নীতিমালা অনুযায়ী, সকল আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স জেলা প্রশাসক বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর আবেদন করতে হয়। যাচাই শেষে লাইসেন্স প্রদান করা হয়।
পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) তথ্যভাণ্ডার ফায়ার আর্মস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (এফএএমএস) অক্টোবরের তথ্যমতে, দেশে বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা ৫০ হাজার ৩১০টি। এর মধ্যে ব্যক্তির মালিকানায় ৪৫ হাজার ২২৬টি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে ৫ হাজার ৮৪টি অস্ত্র রয়েছে। ব্যক্তির মধ্যে রাজনীতিবিদদের হাতে আছে ১০ হাজার ২১৫টি আগ্নেয়াস্ত্র। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে ৭ হাজার ৫৪৯টি, বিএনপির নেতাকর্মীদের কাছে ২ হাজার ৫৮৭টি এবং জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাছে আছে ৭৯টি।
এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে জানিয়েছেন, বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র মালিকদের কাছ থেকে এনবিআর খুব বেশি আয়কর পায় না। ব্যক্তি পর্যায়ে আগ্নেয়াস্ত্র যারা নেন, তাদের বেশিরভাগ ঠিকাদার বা অন্যান্য ব্যবসায়ী। এসব ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীদের বিপুল পরিমাণ উৎসে কর কর্তন করা থাকে। লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ওই ব্যক্তির কর সার্কেলে চিঠি দেয়া হয়; যাতে জানতে চাওয়া হয়, ওই ব্যক্তি রিটার্ন দিয়েছেন কি না অথবা আবেদনের সঙ্গে যে আয়কর সনদ দাখিল করেছেন তা সঠিক কি না। কর অফিস যাচাই করে জানিয়ে দেয়। তবে আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স নেয়া বেশিরভাগ করদাতা তার রিটার্নে আয় ও সম্পদ প্রদর্শন করে না।
কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা ৫০ হাজার ৩১০টি। এসব অস্ত্র মালিকদের কে কী পরিমাণ কর দেয়, তাদের রিটার্নে দেখানো আয় ও সম্পদ যাচাই করা হবে। আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে যে, বেশিরভাগ বৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের মালিক সঠিকভাবে কর দেন না। আয়কর রিটার্নে আয়, সম্পদ গোপন করে তারা অস্ত্রের লাইসেন্স নিচ্ছেন এবং নবায়ন করছেন। এই তথ্য যাচাইয়ের মাধ্যমে কোন আগ্নেয়াস্ত্র মালিক কর ফাঁকি দিচ্ছে তা উঠে আসবে। নতুন আয়কর আইনে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণক বা পিএসআর দেয়া বাধ্যতামূলক। সেই পিএসআর যাচাই করতেই এই চিঠি দেয়া হয়েছে। এছাড়া কোনো করদাতা রিটার্ন দাখিল না করলে সেটা উঠে আসবে।