রেজাউল করিম খোকন: বিশ্ব অর্থনীতি এখন কোন পথে যাচ্ছেÑএককথায় এর উত্তর দেয়াটা সহজ নয়। সাধারণত পরপর দুই প্রান্তিকে অর্থনীতি সংকুচিত হলে তাকেই মন্দা বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে পরপর দুই প্রান্তিকেই অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে, যদিও এখনও মন্দার ঘোষণা আসেনি। তবে মন্দা যে আসছে, তাতে সবাই কমবেশি একমত। সুতরাং প্রশ্ন হচ্ছে, অর্থনীতি কি মন্দার পথে, নাকি ফিরে যাচ্ছে মন্দা পেরিয়ে মহামন্দার দিকে? চলতি বছরের শেষ নাগাদ বা আগামী বছরের শুরুতে বিশ্বমন্দার ঝুঁকি আরও গুরুতর হবে। ব্লুমবার্গের অর্থনৈতিক মডেল বলছে, ২০২৪ সালে মন্দা দেখা দেয়ার শঙ্কা শতভাগ। জার্মানির ডয়েচে ব্যাংকের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মন্দা দেখা দেবে ২০২৩ সালের মাঝামাঝিতে। যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ওয়েলস ফারগো অ্যান্ড কোম্পানির মতে, মন্দা হবে ২০২৩ সালের শুরুতে, আর জাপানের আর্থিক কোম্পানি নমুরা হোল্ডিং বলছে, মন্দা দেখা দেবে চলতি ২০২২-এর শেষ দিকেই। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিলে বাংলাদেশকেও মেনে নিতে হবে। সুতরাং এর অভিঘাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় বা কৌশল ঠিক করাই হবে প্রধান কাজ। ১৯৭০ সালের মন্দার পর বৈশ্বিক অর্থনীতি এখন সবচেয়ে সংকটে রয়েছে। ‘বিশ্বে কি মন্দা আসন্ন’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। অর্থনৈতিক সংকটে বিশ্ব। দিন দিন বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নীতি সুদহার একযোগে বাড়িয়েই চলেছে। এর জেরে বিশ্ব অর্থনীতি ২০২৩ সালে মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বে অর্থনৈতিক শক্তির দিক দিয়ে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপ। এই তিন শক্তির অর্থনীতির চাকা দ্রুত গতি হারাচ্ছে। এর মধ্যে আগামী বছরে বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর মাঝারি কোনো আঘাত এলেও তার পরিণতি গড়াতে পারে মন্দায়। এই মন্দায় মারাত্মক পরিণতি ভোগ করবে মূলত উঠতি বাজার ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যেভাবে একযোগে সুদের হার বাড়াচ্ছে, তা গত পাঁচ দশকে আর দেখা যায়নি। এই প্রবণতা আগামী বছরও থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে করোনা মহামারির আগে মূল্যস্ফীতি যে পর্যায়ে ছিল, সেখানে ফিরে যেতে এসব পদক্ষেপ যথেষ্ট নাও হতে পারে। ২০২৩ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার বাড়িয়ে চার শতাংশ করলে ২০০১ সালের গড় হারের দ্বিগুণের বেশি হবে। বিশ্বমন্দা হলে রপ্তানির ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস এ নিয়ে বলছেন, বিশ্বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ব্যাপকভাবে কমে আসছে। ভবিষ্যতে যখন বিভিন্ন দেশ মন্দার কবলে পড়বে, তখন এই গতি আরও কমে আসতে পারে। তার শঙ্কা, প্রবৃদ্ধি কমে আসার যে হাওয়া বইছে, তা অব্যাহত থাকবে। বিশ্বব্যাংকের দেয়া তথ্য বলছে, সরবরাহ ব্যবস্থার সংকট এবং শ্রমবাজারের ওপর থাকা চাপ যদি প্রশমিত না হয়, তাহলে ২০২৩ সালে জ্বালানি খাত বাদে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়াবে পাঁচ শতাংশে। এই অঙ্কটা করোনা মহামারির আগের পাঁচ বছরের গড় মূল্যস্ফীতির প্রায় দ্বিগুণ। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সুদের হার অতিরিক্ত দুই শতাংশ বাড়ানোর প্রয়োজন পড়তে পারে। তবে চলতি বছরে এরই মধ্যে এ হার গড়ে দুই শতাংশের বেশি বাড়িয়েছে তারা। বিশ্বব্যাংকের শঙ্কা, একে তো চলছে অর্থনৈতিক সংকট, তারপর সুদের হার বৃদ্ধির এই পরিমাণ ২০২৩ সালে বিশ্বে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ কমিয়ে দিতে পারে বা শূন্য দশমিক চার শতাংশ মাথাপিছু আয় সংকোচন করতে পারে। এমন পরিস্থিতিকেই সংজ্ঞাগতভাবে বৈশ্বিক মন্দা বলা হয়ে থাকে।
আসন্ন মন্দার ঝুঁকি এড়াতে ভোগ কমানোর চেয়ে বরং উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দেয়া উচিত। একই সঙ্গে বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে, বাড়াতে হবে উৎপাদনশীলতা। আগের বিভিন্ন সময়ের মন্দা আমাদের দেখিয়েছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যখন দুর্বল থাকে, তখন লম্বা সময় ধরে মূল্যস্ফীতি বাড়তে দেয়া কতটা ঝুঁকির হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ১৯৮২ সালের মন্দার উদাহরণ দেয়া যায়। তখন বিভিন্ন দেশের ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা হারানোর ৪০টির বেশি ঘটনা ঘটেছিল। এ ছাড়া উন্নয়নশীল অনেক দেশ এক দশক ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হারিয়েছিল। সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের আর্থিক ও রাজস্ব-সংক্রান্ত নীতিমালা আরও কঠোর করা হয়েছে। এই কৌশল মূল্যস্ফীতি কমাতে কাজে লাগতে পারে। তবে এসব পদক্ষেপের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেগুলো পরিস্থিতি জটিল করে তুলতে পারে এবং বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির গতি আরও কমিয়ে দিতে পারে। সমস্যা সমাধানে কিছু পরামর্শও দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তারা বলছে, মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে তাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত আরও সুস্পষ্টভাবে জানাতে হবে। একই সঙ্গে নীতিনির্ধারকদের এমন সব মধ্যমেয়াদি রাজস্ব পরিকল্পনা করতে হবে, যেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা থাকবে এবং দরিদ্র ও দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে আছে এমন পরিবারকে সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে। বিশ্বব্যাংক গবেষণায় মূলত বৈশ্বিক প্রবণতাকেই তুলে ধরেছে। সেখানে নির্দিষ্ট কোনো দেশের কথা উল্লেখ নেই। তবে বিশ্বমন্দা হলে বাংলাদেশ এর বিরূপ প্রভাব থেকে বাইরে থাকতে পারবে না। তবে বৈশ্বিক মন্দা বাংলাদেশকে কিছু সুবিধাও দেবে। এজন্য প্রয়োজনীয় নীতি ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশ্বমন্দা হলে রপ্তানির ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আবার মন্দা হলে জ্বালানি তেলের দাম হয়তো কিছু কমবে, বিশ্ববাজারে পণ্যের দরও কমবে, যা বাংলাদেশের জন্য ভালো দিক। তবে বৈশ্বিক সুদহার বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগ বা বিদেশি পুঁজি ব্যয়বহুল হবে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ বেড়ে যাবে। আমরা জানি, আমাদের বেসরকারি খাতের দুই হাজার ৫০০ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ রয়েছে। এ ক্ষেত্রেও সুদহার বাড়বে। এতে আমাদের খরচও বেড়ে যাবে। আর ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে আমরা দুটি জায়গায় পিছিয়ে ছিলাম। যেমন বিনিময় হার ও সুদহার বৃদ্ধি। এর মধ্যে বিনিময় হারে অবমূল্যায়ন ঘটছে, কিন্তু সুদহার বাড়ানো যাচ্ছে না। এটা একটা সমস্যা। কিন্তু অন্যান্য দেশ ঠিকই পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে নীতির সমন্বয় করছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা আছে।
কভিডকালে এমনকি রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ-পরবর্তী সময়ে বিশ্বে সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় পণ্য সরবরাহ বাধার মুখে পড়েছে। দেশে দেশে সরবরাহ ও উৎপাদন ব্যবস্থায় সংকটের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে এবং মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে গিয়ে প্রায় সব দেশেই সুদের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব বিবেচনায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, বিশ্বব্যাংক কয়েক মাস ধরেই বিশ্বব্যাপী মন্দার আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছে। এমনকি বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় এ বিষয়ে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন। বিশ্বমন্দা হলে অনেক ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভর বাংলাদেশও তার বিরূপ প্রভাব এড়াতে পারবে না। অন্যদিকে বৈশ্বিক মন্দা বাংলাদেশকে কিছু সুবিধাও দিতে পারে। এজন্য প্রয়োজনীয় নীতি ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশ্বমন্দা হলে ক্রেতা-দেশে ক্রয়ক্ষমতা কমে গেলে আমাদের রপ্তানির ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আবার মন্দা হলে জ্বালানি তেলের দাম হয়তো কিছু কমবে; বিশ্ববাজারে পণ্যের দরও কমবে, যা বাংলাদেশের জন্য ভালো। তবে বৈশ্বিক সুদহার বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগ বা বিদেশি পুঁজি ব্যয়বহুল হবে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ বেড়ে যাবে। পত্রিকান্তরে জানা গেছে, বর্তমানে আমাদের বেসরকারি খাতের প্রায় দুই হাজার ৫০০ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ রয়েছে। এ ক্ষেত্রেও সুদহার বাড়বে। এতে আমাদের খরচ বেড়ে যাবে। সুদের হার বাড়ানোর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যবস্থা ও সরবরাহ শৃঙ্খল সচল রাখা, উৎপাদক শ্রেণিকে সর্বতোভাবে সহায়তা করা। প্রয়োজন বৃহৎ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এবং উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে সঠিক সময়ে খাদ্য আমদানি ও নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ মনোযোগ দেয়া। সমান মনোযোগ থাকতে হবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ওপরেও। সার্বক্ষণিক খাদ্য মজুত পরিস্থিতির ওপরেও নজর রাখতে হবে।
এমন অনেক কারণ রয়েছে, যা মন্দার আগেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই লক্ষণগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে মন্দা আসার জন্য অপেক্ষা না করে এর প্রভাব হ্রাস করার জন্য কোন ব্যবস্থাগুলো বাস্তবায়ন করা যেতে পারে, তা জানা গুরুত্বপূর্ণ। মন্দা যখন দেখা দেয় তখন বেকারত্বে দেশের প্রবণতা হয়ে ওঠে। বেকারত্বের হার বৃদ্ধির কারণে ক্রয় ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। ব্যবসায় প্রক্রিয়ার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্যক্তিরা দেউলিয়া হয়ে যায়, তাদের আবাসন সম্পত্তি হারায়। কারণ তারা আর ভাড়া পরিশোধ করতে পারে না। বেকারত্ব তরুণদের শিক্ষা ও ক্যারিয়ার পছন্দের জন্য নেতিবাচক। উৎপাদন শিল্পে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। নির্মাতারা বড় অর্ডার পাওয়ার পরও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অর্ডার কমে যায়, নির্মাতারা লোক নিয়োগ বন্ধ করে দেয়। ভোক্তাদের চাহিদা পায়। বিক্রয় হ্রাস পায়। মন্দার বিপদ এড়াতে সবার আগে অপ্রয়োজনীয় খরচ কমাতে হবে। খরচ কমিয়ে জরুরি তহবিল গঠন করা খুবই জরুরি। অন্তত বেঁচে থাকার জন্য প্রতি মাসে আপনার কত টাকা প্রয়োজন তা হিসাব করতে হবে। ক্রেডিট কার্ড ও ধারে লেনদেন এড়িয়ে চলা জরুরি। শেয়ারবাজার, ক্রিপ্টোর মতো অস্থির খাতে বিনিয়োগ এড়িয়ে চলতে হবে। ২০০৭ ও ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের সময় এবং এমনকি মহামারিতেও বাংলাদেশ মন্দার মুখোমুখি হয়নি। কিন্তু বর্তমানে দেশের অর্থনীতি বিভিন্ন কারণে চাপের মধ্যে পড়েছে। যেহেতু বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার ইউরোপের ওপর অতি নির্ভরশীল, ফলে ইউরোপে মন্দা দেখা দিলে দেশের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। পশ্চিম ইউরোপে স্বল্প দক্ষ শ্রমের চাহিদা বেড়েছে এবং অনেক বাংলাদেশি সেই সুযোগ ব্যবহার করছেন। এ বিষয়টিও প্রভাবিত হতে পারে। বিশ্বব্যাপী আরেকটি মন্দা আঘাত হানুক বা না হানুক, যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি এরই মধ্যে থমকে গেছে। চীনও চাপের মুখে আছে কভিডের কারণে। ইউরোপে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কার্যত শূন্য। তাই বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান ইঞ্জিন যে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই। যদি আশঙ্কা বাস্তবে পরিণত হয়, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রভাবিত হবে। আমদানিভিত্তিক পণ্যের উচ্চমূল্য এবং রপ্তানি পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রভাবিত হবে। প্রথমত, দেশে পণ্যের মূল্য বাড়তে পারে এবং দ্বিতীয়ত, রপ্তানি আয় কমে যেতে পারে। যেহেতু বাংলাদেশ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কম দামি তৈরি পোশাক রপ্তানি করে এবং এগুলো মৌলিক চাহিদারই অংশ, তাই রপ্তানি খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত নাও হতে পারে। তবুও আগামী বাজেটে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পদক্ষেপ নেয়া দরকার। অতিরিক্ত খরচ কমাতে হবে। বাংলাদেশও প্রণোদনা হিসেবে কম সুদে ঋণ দিয়েছে। সহজে পাওয়া এসব ঋণের একটি অংশ খেলাপি হয়ে গেছে, অর্থাৎ উৎপাদনে ব্যবহার হয়নি। বেশ কিছু সাশ্রয়ী পদক্ষেপও নেয়া হয়েছে, যদিও অর্থনৈতিক তত্ত্ব বলে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাজস্বনীতি নয়, মুদ্রানীতিই বেশি কার্যকর। তবে বৈশ্বিক প্রভাবের সঙ্গে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থনৈতিক অব্যবস্থা দায়ী। দুর্নীতি, দেশ থেকে মুদ্রা পাচার, রাজনৈতিক বিরোধের ফলে পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিরোধীদের মতের অসহযোগিতাÑসব মিলিয়ে যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। দেশীয় জ্বালানি অন্বেষণ না করে বিদেশি জ্বালানিনির্ভর হওয়া, ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও অর্ধ লাখ কোটি টাকা প্রদান, তথ্যমতে, ১১ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার প্রভৃতি মাত্রা যোগ করেছে। অধিকন্তু, বাংলাদেশের ২০১৫ সালের চার হাজার ৯১০ কোটি বৈদেশিক ঋণ ২০২২ সালে এসে বহু গুণ বেড়ে ৯৭ হাজার ৭৪০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এই ঋণের বেশিরভাগই মেগা প্রজেক্টের জন্য যা এখনও সম্পূর্ণ হয়নি, ফলে এই প্রজেক্ট থেকে কোনো বেনিফিট শিগগিরই আসছে না। অথচ ২০২৩ সাল থেকেই এর সুদসহ ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে। এ অবস্থায় অর্থনীতির চাপ সামলাতে আগামী দিনগুলোয় সরকারকে গভীর মনোযোগ রাখতে হবে বিশ্ব অর্থনীতির দিকে। পণ্যমূল্য কমতে শুরু হলেও তা অর্থনীতির মন্দার লক্ষণ। তৈরি পোশাক খাতও ক্রয়াদেশ আগের তুলনায় কম পাচ্ছে। প্রবাসী আয় আগের মতো আসছে না। আমদানি বেড়েই যাচ্ছে, যদিও সরকার আমদানি কমানোর বিভিন্ন উদ্যোগ এরই মধ্যে নিয়েছে। তারপরও বৈদেশিক বাণিজ্যের পাশাপাশি চলতি হিসাবে হচ্ছে বিশাল ঘাটতি। আমদানি ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত কমাতে গেলে দেশজ উৎপাদন ব্যাহত হয়ে রপ্তানিতে প্রভাব পড়তে পারে; তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে বিদ্যুতে লোডশেডিং। সুতরাং বৈশ্বিক ঘাটতির সঙ্গে অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থা মিলে এক কঠিন অবস্থার পূর্বাভাস দিচ্ছে দেশের অর্থনীতি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের চাপ কমাতে সরকার আইএমএফের কাছে ঋণসহায়তা পেতে চিঠি দিয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে, আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা ও ঋণ পাওয়ার শর্ত নির্ধারণ করা। শর্তের মধ্যে যদি থাকে জ্বালানির দাম বাড়ানো, ভর্তুকি কমানো, তাহলে তা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে, সীমিত আয়ের মানুষদের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হবে। অন্য দিকে করব্যবস্থা ও আর্থিক খাত নিয়ে বড় ধরনের সংস্কার অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে, যদিও এ ক্ষেত্রে বাধা আসবে প্রভাবশালীদের দিক থেকে। সুতরাং বিশ্ব অর্থনীতির অভিঘাত থেকে দেশের অর্থনীতিকে কতটুকু রক্ষা করা যাবে, তা পুরোটাই নির্ভর করছে দেশের নীতিনির্ধারকদের ওপর।
অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক