বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব

মো. জিল্লুর রহমান: যুদ্ধ কোনো দেশ বা জাতির জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে না। মানুষ যেমন একা বসবাস করতে পারে না, ঠিক তেমনি একটি দেশও কখনও একা চলতে পারে না। বলা যায়, এই বিশ্বটা একটা সংসার, প্রতিটি দেশ তার সদস্য। পারস্পরিক ভালোবাসা ও সম্প্রীতি বজায় রেখে সবাই দেশ পরিচালনা করবে, এটাই সবার কাম্য। কিন্তু বিশ্বের কোথাও যুদ্ধ পরিস্থিতি দেখা দিলে প্রথমেই জ্বালানি পণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হয়। কারণ সরবরাহ ও উৎপাদন ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়। ইউক্রেন সংকট যদি সাময়িক হয়, তবে জ্বালানির বাজার বেশিদিন ঊর্ধ্বমুখী থাকবে না। কিন্তু যদি সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাবে। পেট্রোলিয়াম পণ্য তেল-গ্যাসের দাম বাড়বে। বাংলাদেশের মতো জ্বালানি আমদানিকারক দেশের জন্য এটা আরও খারাপ খবর। সরকার ভর্তুকি সামাল দিতে তেল-গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করতে চাইবে। এমনটি করলে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে। অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন বিশ্ব অর্থনীতির জন্য এক বিশাল ধাক্কা, যা এখনও মহামারির প্রভাব থেকে বিশ্ব পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। সংঘাতটি এরই মধ্যে ১৯৪৫ সালের পর থেকে ইউরোপের জন্য সবচেয়ে গুরুতর সংকট ও আগ্রাসন। রাশিয়ার বাহিনী বিমান হামলা চালাচ্ছে, সেনাঘাঁটি দখল করছে এবং বেসামরিক লোকজন পালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিয়েভের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, যে কোনো সময় রাজধানী কিয়েভের পতন হতে পারে এবং এর বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শেষ হয়ে যেতে পারে। ইউক্রেনে হামলার পর এরই মধ্যে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় বিশ্ব অর্থনীতিতে কম্পন শুরু হয়েছে। ২০১৪ সালের পর প্রথমবারের মতো তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১১৩ ডলার ছাড়িয়েছে, যেখানে ইউরোপীয় প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ৬২ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগ্যানের পূর্বাভাস হচ্ছে, চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ১২৫ ডলারে এবং আগামী ২০২৩ সালে ১৫০ ডলারে উঠতে পারে। এর আগে ২০০৮ সালে জ্বালানি তেলের ব্যারেলপ্রতি দাম ১৪৭ ডলারে উঠেছিল, যা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ।

ইউক্রেন বেঁচে থাকার জন্য সর্বাত্মক লড়াই করছে, পশ্চিমা সরকারগুলোও রাশিয়াকে শাস্তি দেয়ার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। তারা এর মাধ্যমে নিজস্ব অর্থনীতিতে সংঘাতের প্রভাবকে বাড়িয়ে তুলতে চাইছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা এরই মধ্যে রাশিয়ার ব্যাংক, ডলারে বাণিজ্য ও সুইফট নেটওয়ার্কের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা করেছে। করোনা মহামারি এমনিতেই বিশ্ব অর্থনীতিতে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং উদ্বেগজনক আর্থিক বাজার তৈরি করেছে এবং বর্তমান ইউক্রেন যুদ্ধ এ দুটো বিষয়কে আরও খারাপ করবে। এমনিতেই অনেক দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হুমকির মুখে রয়েছে। যে পরিবারগুলো তাদের আয়ের একটি বড় অংশ জ্বালানি এবং খাবারের জন্য ব্যয় করে, তাদের কাছে অন্যান্য পণ্য ও পরিষেবার জন্য নগদ অর্থ কম ব্যয় করার সুযোগ থাকবে। নিমজ্জিত ও ঝুঁকিপূর্ণ বাজার আরেকটি টানাপোড়েন যোগ করবে, সম্পদ ও আত্মবিশ্বাসকে আঘাত করবে এবং ফার্মগুলোর বিনিয়োগের জন্য তহবিল ব্যবহার করা কঠিন করে তুলবে।

বাজার বিশ্নেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ তাদের পশ্চিমা মিত্রদের নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়াও পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে বিশ্ববাজারে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি কমিয়ে দিতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারের দ্বিতীয় বৃহত্তম বা ১০ শতাংশ জ্বালানি তেল সরবরাহ করে রাশিয়া। যদিও সবচেয়ে বেশি পরিমাণ তেল রপ্তানি করে সৌদি আরব। শুধু তেলই নয়, বিশ্বের শীর্ষ প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহকারী দেশও রাশিয়া। যেকোনো সময় ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে দেশটি, এমন আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। এর বড় প্রভাব পড়বে বিশ্ব অর্থনীতিতে। ইউরোপ প্রায় ৩৫ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। ২০২০ সালে রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস রপ্তানির পরিমাণ কমে গিয়েছিল। তখন স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বেড়ে যায়। ফলে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় গ্যাসের দাম। রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ পরিস্থিতি গ্যাসের দামকে আরও ঊর্ধ্বমুখী করতে পারে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, দেশটি রাশিয়ার পরিবর্তে বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে এলএনজি আমদানির কথা ভাবছে। এক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। এতে স্পট মার্কেটে পণ্যটির দাম আরও বাড়বে। ফলে বিপাকে পড়বে বাংলাদেশের মতো এলএনজি আমদানিকারক ছোট দেশগুলো।

প্রভাবিত দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছেÑদাম নিয়ন্ত্রণ করা এবং তাদের অর্থনীতিকে ক্রমবর্ধমান রাখা। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ এবং ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংক এরই মধ্যে তাদের আর্থিক নীতি কঠোর করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা রাশিয়া সংকট পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হচ্ছে। এই সংঘাত বিশ্ব অর্থনীতিতে কতটা বড় ধাক্কা দেবে, তা নির্ভর করবে এর দীর্ঘস্থায়িত্ব এবং পরিধি, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার তীব্রতা ও রাশিয়ার প্রতিশোধ নেয়ার সম্ভাবনার ওপর। ইউক্রেনীয় উদ্বাস্তুদের দেশত্যাগ থেকে রাশিয়ার সাইবার আক্রমণের ঢেউ পর্যন্ত অন্যান্য মোচড়ের সম্ভাবনাও রয়েছে।

আন্তর্জাতিক ব্লুমবার্গ ইকোনমিক্স তিনটি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছে, যেখানে যুদ্ধ কীভাবে মূল্য বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি ও মুদ্রানীতিকে প্রভাবিত করতে পারে তা রয়েছে। প্রথমত, যুদ্ধের দ্রুত সমাপ্তি পণ্য বাজারে আরও ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতাকে বাধা দেয়, যা মার্কিন ও ইউরোপীয় অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে সঠিক পথে রাখে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিকল্পনাগুলোকে পরিবর্তন করতে হয় এবং সেগুলো বাতিল করা যায় না। দ্বিতীয়ত, একটি দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষ, কঠোর পশ্চিমা প্রতিক্রিয়া এবং রাশিয়ার তেল ও গ্যাস রপ্তানিতে বাধা একটি বড় জ্বালানির ধাক্কা দেবে এবং বিশ্ববাজারে একটি বড় ঝুঁকি তৈরি করবে। তৃতীয়ত, সবচেয়ে খারাপ ফলাফল হিসেবে ইউরোপের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে, মন্দার সূত্রপাত ঘটবে, যখন যুক্তরাষ্ট্র উল্লেখযোগ্যভাবে কঠোর আর্থিক অবস্থা, প্রবৃদ্ধির জন্য একটি বড় আঘাত এবং উল্লেখযোগ্যভাবে আরও স্থবির ফেড দেখতে পাবে। যুদ্ধ যদিও সহজাতভাবে অপ্রত্যাশিত, কিন্তু প্রকৃত ফলাফল এই ধরনের সংস্করণগুলোর যে কোনোটির চেয়ে অগোছালো হতে পারে।

রাশিয়া ও ইউক্রেনের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির প্রভাব বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই দুটি দেশ খাদ্যশস্য ও পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদন এবং রপ্তানিতে বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় দেশ। দেশ দুটির মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় আমদানিকারকরা বিকল্প দেশ থেকে পণ্য নিতে চেষ্টা করছে। গম, ভুট্টা ও সূর্যমুখী তেলের সরবরাহে এক ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সারা বিশ্ব যত গম রপ্তানি করে, তার প্রায় ৩০ শতাংশ করে রাশিয়া ও ইউক্রেন। এছাড়া ভুট্টার প্রায় ২০ শতাংশ রপ্তানি হয় এই দুই দেশ থেকে। গম ও ভুট্টা দিয়ে শিশুখাদ্য থেকে শুরু করে প্রাণিজ খাদ্য উৎপাদিত হয়। সূর্যমুখী তেল রপ্তানির ৮০ শতাংশই করে এ দুই দেশ। ফলে ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের উত্তেজনা দীর্ঘস্থায়ী হলে চলতি মৌসুমে গম ও ভুট্টার সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেবে। ফলে এসব পণ্য থেকে উৎপাদিত দ্রব্যের দাম বাড়বে। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম বাড়তে শুরু করেছে। ভুট্টার দামও বেশ চড়া।

ইউক্রেনের ওপর হামলার জের ধরে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপানসহ একাধিক দেশ রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যার বেশিরভাগই অর্থনৈতিক। কোনো দেশে যুদ্ধ শুরু হলে তার প্রভাব কম-বেশি সব ক্ষেত্রেই পড়ে। নানা ধরনের সংকট ও সমস্যা সৃষ্টি হয় এবং এটাই স্বাভাবিক। সামগ্রিকভাবে খাদ্যশস্য, গ্যাস, জ্বালানি তেল, রাসায়নিক সারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের সরবরাহ ব্যাপকভাবে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও রাসায়নিক সারের দাম গত কয়েক বছরের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। এসব পণ্যের দাম বেড়ে গেলে দেশে কৃষি ও শিল্পপণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। বাড়বে পরিবহন খরচও। অনেক দেশের জাহাজ কৃষ্ণসাগরে যেতে চাচ্ছে না, যা সরাসরি দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। এ পথ দিয়ে আমদানি-রপ্তানি করা খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। করোনা মহামারির কারণে এরই মধ্যে বিশ্বের অনেক অঞ্চলের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। ফলে নতুন করে খাদ্যের দাম বাড়লে তা সংকট বাড়াবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইউরোপের ৩৫ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা মেটে রাশিয়া থেকে। যুদ্ধের দামামায় গ্যাসের দাম বাড়তে শুরু করেছে। অন্যদিকে যুদ্ধের ফলে সংকটে পড়তে শুরু করেছে পশ্চিমা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো। কারণ রাশিয়ার সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে রয়েছে তারা। দেশটির সবচেয়ে বড় জ্বালানি তেল উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান রসনেফটে ১৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ মালিকানা রয়েছে যুক্তরাজ্যের বহুজাতিক জ্বালানি প্রতিষ্ঠান বিপির। প্রতিষ্ঠানটির মোট উৎপাদনের তিন ভাগের এক ভাগ আসে রসনেফট থেকে। এই যুদ্ধের কারণে তেলের দাম বাড়ায় সেটারও একটা প্রভাব ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর পড়বে। যুদ্ধের কারণে পণ্যবাহী জাহাজগুলো এখন কৃষ্ণসাগরে যেতে চাইছে না। ফলে রপ্তানিকারকরাও বেশ চিন্তার মধ্যে পড়েছে।

তবে বাংলাদেশের ওপর কী কী প্রভাব পড়তে পারে, তা এখনই পরিষ্কার করে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে এবং রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার আওতা আরও বাড়লে বাংলাদেশ কী করবে, বাংলাদেশকে সেই আগাম পরিকল্পনা নিয়ে রাখতে হবে। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল অবশ্য ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক আগ্রাসনে বৈশ্বিক অর্থনীতি মারাত্মক প্রভাব ফেলবে বলে সতর্ক করেছে। তারা সতর্ক করে আরও বলেছে, এটা নিশ্চিত রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতি চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।

ব্যাংক কর্মকর্তা ও মুক্ত লেখক

zrbbbp@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০