Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 8:36 pm

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

মো. মিজানুর রহমান: করোনা মহামারির কারণে সারা বিশ্ব অর্থনীতিতে যে ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়েছে এবং তার থেকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো যখন হিমশিম খাচ্ছে, ঠিক তখনই আবারও বিশ্ব অর্থনীতিতে অন্ধকারের কালো ছায়া নেমে এসেছে। রাশিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যকার অহেতুক যুদ্ধ সারা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলোর মোট খাদ্যদ্রব্যের চাহিদার একটি বিশাল অংশের জোগান আসে শুধু ইউক্রেন থেকেই। আর রাশিয়া তার জ্বালানি ও গ্যাসের সরবরাহ কমিয়ে দেয়ায় সারা পৃথিবীতে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনীতির এ বেহাল অবস্থায় বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ইউরোপিয়ন ইউনিয়ন, বিশ্ব খাদ্য সংস্থাসহ প্রায় সব আন্তর্জাতিক সংস্থা ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে বিশ্ব অর্থনীতি নিশ্চিতভাবে আগামীতে অর্থনৈতিক মন্দার দিকেই ধাবিত হচ্ছে।

গত সেপ্টেম্বরে বিশ্ব ব্যাংক তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বিশ্ব অর্থনীতি ২০২৩ সালে সুস্পষ্টভাবে বিশ্ব মন্দার দিকে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিবেদন আমেরিকা-কানাডাসহ বিশ্বের তাবত শক্তিশালী রাষ্ট্রের সরকার প্রধান ও অর্থনীতিবিদদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক খুব সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে, এ যুদ্ধ যদি দ্রুত শেষ না হয় তাহলে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে সারা পৃথিবীর খাদ্যদ্রব্য ও জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবে। ফলে দেখা দেবে উচ্চ মূল্যস্ফিতি। সংস্থাটি সন্দেহ করছে, আসন্ন বিশ্ব মন্দার সঙ্গে সঙ্গে যদি প্রতিটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হারও বাড়িয়ে দেয় তাহলে প্রতিটি দেশের মোট দেশজ প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ কমে যেতে পারে। ফলে অনেক দেশ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ ক্ষমতা হারাতে পারে।

ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী দেশ জার্মানির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বুন্ডেসব্যাংক সাম্প্রতিককালে বলেছে, উচ্চ মূল্যস্ফিতির কারণে আগামী বছর জার্মানি অর্থনৈতিক মন্দার ঝুঁকিতে রয়েছে। যার ফলে দেশটিতে গ্যাস সরবরাহ তীব্রভাবে বিঘিœত হতে পারে এবং দেশটির সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

আমেরিকার মতো উন্নত দেশও ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফিতির সমস্যা মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে। গত ৪০ বছরে আমেরিকার জনগণ এর আগে কখনও এত উচ্চ মূল্যস্ফিতি প্রত্যক্ষ করেনি। এমনকি করোনা মহামারির সময়ও না। ইউরোপিয়নভুক্ত দেশগুলোর মূল্যস্ফিতি ৮% এর ওপর। আমদানি ব্যয় পরিশোধ করার জন্য অনেক দেশ তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমিয়ে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে। মূল্যস্ফিতির সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য স্টেট ব্যাংক অব ইংল্যান্ড সুদের হার ১.২৫% থেকে ১.৭৫% এ বৃদ্ধি করেছে, যা গত ২৭ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। যদিও ইংল্যান্ডের অর্থনীতিবিদরা মনে করেন এখন দেশটির সামগ্রিক মূল্যস্ফিতি ৯% হলেও বছর শেষে তা ১৩%-এ গিয়ে দাঁড়াবে। উন্নতদেশগুলো যেখানে উচ্চ মূল্যস্ফিতির ভারে ভারাক্রান্ত, সেখানে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবস্থা তো আরও ভয়ংকর। জিম্বাবুয়েতে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফিতি ২২৫%, ভেনেজুয়েলাতে ১৫৫%, লেবাননে ৩২৫%, শ্রীলঙ্কায় ৮০%, ইরানে ৮৬% আর আর্জেন্টিনায় ৬৬%। মোট কথা এই দেশগুলোর অর্থনীতি অনেকাংশেই ভেঙে পড়েছে এবং আমদানি ব্যয় মিটাবার জন্য বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থেকে ব্যয় করতে বাধ্য হচ্ছে।

বাংলাদেশের ওপর এই আসন্ন মন্দার কী রূপ প্রভাব পড়বে তা সুনির্দিষ্ট করে এখনই বলা না গেলেও এটা সত্য যে সারা বিশ্ব যেখানে এই মন্দা নিয়ে চিন্তিত, সেখানে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যে এর প্রভাব যথেষ্ট গভীর হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।

সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের অর্থনীতিও খুব একটি ভালো যাচ্ছে না। যেহেতু বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত আমদানি নির্ভর এবং রপ্তানিযোগ্য পণ্যের পরিমাণ এখানে খুবই অল্প। ফলে ডলার সংকটের কারণে আগামী দিনগুলোতে ব্যাংকে এলসি খুলতে সমস্যা হতে পারে। আমদনি করা পণ্যের দাম আরও বৃদ্ধি পাবে। ঋণাত্মক প্রভাব পড়তে পারে তৈরি পোশাক শিল্পেও। তাছাড়া বর্তমানে জ্¡ালানির অভাবে বিদ্যুতের উৎপাদন মোট চাহিদার অর্ধেকে নেমে আসায়, লোডশেডিং মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। কোনো কোনো জায়গায় সারা দিনে ৭-৮ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং থাকে। ফলে শিল্পকারখানায় উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। আর তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় জেনারেটর দিয়েও উৎপাদন চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থা যদি সামনে আরও কিছু দিন অব্যাহত থাকে, তাহলে নিঃসন্দেহে দেশের উল্লেখযোগ্য পরিমাণের শিল্পকারখানা আগামীতে বন্ধ হয়ে যাবে।

আমাদের সামনে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা। আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় ইতোমধ্যেই খাদ্যদ্রব্যের দাম অনেকাংশেই বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া আগামীতে আমাদের খাদ্য উৎপাদনও অনেকাংশেই কমে যাবে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে কৃষক জমিতে সময়মতো সেচ ও সার না দিতে পারায়। ইতোমধ্যেই গ্যাসের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে দেশের অন্যতম বৃহৎ সার কারখানা যমুনা ও ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এবং কবে নাগাদ এই কারখানাগুলো পুনরায় চালু হবে তাও অনিশ্চিত। গ্যাস সংকটে এভাবে যদি একের পর এক সার কারখানা বন্ধ হয়ে যায় তাহলে নির্দিধায় বলা যায়, ভবিষ্যতে আমরা খাদ্য নিরাপত্তার হুমকিতে পড়তে যাচ্ছি।

আমাদের সামনে আরেকটি চ্যালেঞ্জ হবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা। যেহেতু আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আসে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত আমাদের প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যন্সি থেকে।  এছাড়া কিছু অংশ আসে রপ্তানি আয়, বৈদেশিক ঋণ আর অনুদান থেকে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে প্রবাসীদের উপার্জন কমে যাওয়ায় গত সেপ্টেম্বরে গত সাত মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম রেমিট্যান্স এসেছে। ফলে গত বছর যেখানে দেশের মোট রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, সেখানে গত ২০ অক্টোবর মোট রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৫.৯৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আমদানি দায় ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের জন্য প্রায় প্রতিদিনই রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

আমাদের প্রধানমন্ত্রীও বেশ কিছুদিন ধরে আগামী বছরের সম্ভাব্য মন্দা মোকাবিলা করার জন্য দেশবাসীকে আগাম প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। তিনি অপ্রয়োজনীয় খরচ না করে বরং কিছু কিছু করে ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করতে বলেছেন। শুধু তাই নয়, শুধু সরকারের ওপর নির্ভর না করে, যার যতটুকু সাধ্য আছে তার মাঝেই উৎপাদন করতে বলেছেন। সম্ভাব্য বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য ইতোমধ্যেই সরকার সব প্রকার বিলাসদ্রব্য আমদানি বন্ধ করেছে এবং বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণেও নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেছে। সরকার কর্তৃক গৃহীত এই ব্যবস্থাগুলো অবশ্যই প্রশংসনীয়। আমাদের ঠিক এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ রিজার্ভ আছে তা নিয়ে হয়তো খুব বেশি দুশ্চিন্তা করার খুব একটা কারণ নেই। কারণ আগামী পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য এটি মোটামুটি বেশ যথেষ্ট। কিন্তু রাশিয়ার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে তার কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে ২০২৬ সাল থেকে। আর চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে নির্মিত কর্ণফুলী টানেলের কিস্তি এ অর্থ বছর থেকেই শুরু হবে। ফলে এতদ্সংক্রান্ত বিষয়াদি মাথায় নিয়ে আমাদের অবশ্যই রিজার্ভের ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। চলমান উন্নয়ন প্রকল্প বাদে অন্য কোনো নতুন প্রকল্পে এখন কোনোভাবেই হাত দেয়া উচিত হবে না।

তবে এই সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে খেটে-খাওয়া নি¤œ আয়ের মানুষ। আমাদের সামনের দিনগুলোতে ব্যয় সংকোচন নীতি অবলম্বন করতে হবে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রচলিত ‘অ্যালোপ্যাথি’ চিকিৎসার ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ভারতের মতো নিজস্ব দেশজ চিকিৎসাকে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এক জরিপে দেখিয়েছে, ভারতের মোট জনসংখ্যার ৭০% তাদের নিজস্ব দেশজ চিকিৎসা গ্রহণ করে। ভারত ‘আইয়ুর্ভেদা, ইয়গা, ইউনানি, সিদ্ধা ও হোমিও’ এগুলোর সংমিশ্রণে ডিপার্টমেন্ট অব আইয়ুশ গঠন করেছে ১৯৯৫ সালে। এরকম একটি ডিপার্টমেন্ট যদি বাংলাদেশেও খোলা যায় তাহলে যতই মন্দা আসুক না কেন দেশের নি¤œ আয়ের একটি মানুষও বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে না বা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হবে না। প্রয়োজনে কমিউনিটি হাসপাতালগুলোতে ‘অ্যালোপ্যাথি’ চিকিৎসকের পাশাপাশি একজন করে হোমিও/ আইয়ুর্বেদ চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। কারণ শুধু ‘অ্যালোপ্যাথি’ দিয়ে গরিব মানুষের চিকিৎসা দেয়া অসম্ভব ব্যাপার। আর বর্তমান বিশ্বে হারবাল পণ্যের ব্যবসা হলো ৬০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ জš§সূত্রেই একটা হারবাল দেশ। ফলে আমরা খব সহজেই এই হারবাল পণ্য উৎপাদন ও বিপণনে প্রবেশ করতে পারি। 

আমাদের ব্যয় সংকোচনের জন্য দেশের বিভিন্ন অফিসে কর্মরত বিদেশিদের বাদ দিয়ে সেখানে আমাদের দেশের মেধাবী ছেলে-মেয়েদের বসাতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশে অবস্থানরত মেধাবীদের বিশেষ প্রণোদনা দিয়ে হলেও দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। মোট কথা দেশের টাকা দেশেই রাখতে হবে, কোনোভাবেই বিদেশে যেতে দেয়া যাবে না। এক্ষেত্রে আমরা কাজাখস্তানকে অনুসরণ করতে পারি। সাম্প্রতিককালে চীন ও ভারত তাদের মেধাবী ছেলে-মেয়েদের দেশে ফিরিয়ে আনছে, আমাদেরও একই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

প্রবাসীদের কষ্টার্জিত উপার্জন যেন ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে আসতে পারে সেজন্য প্রয়োজনে যত রকম প্রণোদনা দেয়া দরকার তা দিতে হবে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক সুদের হার বাড়ানোর চেয়ে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যবস্থা ও সরবরাহে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। উৎপাদক শ্রেণিকে সব রকম সহযোগিতা করতে হবে। বিশ্ব মন্দার সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির মজুতদার যেন অবৈধভাবে মজুত না করে বাজারে কৃত্রিম সংকট না তৈরি করতে পারে সে দিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। সর্বোপরি বাজার মনিটরিং করতে হবে।

সহযোগী সদস্য, দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ