Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 5:25 pm

বৈশ্বিক খাদ্য সংকট ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ

শাহ মুনতাসির হোসেন মিহান : মানুষের মানবাধিকার চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য হচ্ছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি উপকরণ, যা আমাদের বেঁচে থাকার জোগান দেয়। বাস্তবতায় যখন খাদ্যের উৎপাদন ও জোগান উভয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয় তখন সৃষ্ট সংকটকে খাদ্য সংকট বলা হয়। খাদ্য সংকটে ফলে একটি রাষ্ট্রের সার্বিক ব্যবস্থা বিঘিœত হয়। রাষ্ট্রের জনগণের মানবাধিকার  অধিকার বিঘিœত হওয়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক, সামাজিক কাঠামো ব্যবস্থা নড়বড়ে হয়ে যায়। দেশীয় বা রাষ্ট্রে যে খাদ্য সংকট তৈরি হয় তখনই যখন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি হয়। এতে রাষ্ট্রে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান কঠিনতর হয়ে বিভিন্ন সমস্যা ঘনীভূত হয়।

করোনা-পরবর্তী বিশ্ব এখন ঘোর ক্রান্তিলগ্ন সময় অতিক্রম করছে। পুরো বিশ্ব এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে হিমশিম খাচ্ছে। অর্থনীতি, সামাজিক, রাজনৈতিক প্রমুখ দৃষ্টিকোণ থেকে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব বিশ্বের প্রতিটি দেশ অবলোকন করেছে। বিশ্বব্যাপী বর্তমানে যে খাদ্য সংকট তৈরি হয়েছে তা সূচনা ঘটে করোনা মহামারির সময়কালে। কিন্তু বিভিন্ন দেশ নিজেদের দেশের তৎকালীন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী সংকট সামাল দিতে পারলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দরুন এই খাদ্য সংকট চরমভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এই খাদ্য সংকট সৃষ্টিতে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। প্রথমত, রাশিয়া শক্তিশালী পারমাণবিক শক্তিনির্ভর একটি দেশ। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর থেকে ইউক্রেনের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব^ রয়েছে। মস্কো ও কিয়েভের মতভেদ ও সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতির দরুন এই দশকের অন্যতম সংকটের সম্মুখীন হয় বিশ্ববাসী।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমা জোট তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া দুই দেশের পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে বিশ্বব্যাপী ক্রমাগত জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের মান অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি ফলে মুদ্রার দরপতন হয়ে মুদ্রাস্ফীতি তৈরি হচ্ছে বিশ্বের অধিকাংশ দেশগুলোয়। যার ফলে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সিংহভাগ দেশগুলোয় জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম ২০২১ সালের এই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (ফাও) তথ্যমতে, ২০২৩ সালে বিশ্বের প্রায় ৪৫টি দেশ চরম খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হবে। যার মধ্যে একটি দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। অর্থনীতিবিদদের মতে, ১৯৩০ সালের মতো আরও একটি সাল দেখতে চলেছে বিশ্ব। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি খাদ্য সংকটের আরও একটি কারণ। ইউরোপীয় খরা পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের (ইডি) তথ্যানুসারে, আর্দ্রতা হারিয়ে ইউরোপের ৪৭ শতাংশ এলাকার মাটি শুকিয়ে গেছে। ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তাতে খাদ্য সংকটে বিশ্ব আরও অগ্রসর হচ্ছে।

রাশিয়া ও ইউক্রেন দুই দেশের কৃষি খাত যথেষ্ট স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই দুই দেশকে এগ্রিকালচারাল পাওয়ার হাউস বলা হয়। বিশ্বে হাতেগোনা অল্পসংখ্যক দেশ এগ্রিকালচারাল পাওয়ার হাউসের অন্তর্ভুক্ত। তার মধ্যে এই দুটি দেশ অন্যতম। বিশ্বজুড়ে গম সরবরাহের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের জোগান দেয় রাশিয়া ও ইউক্রেন। সয়াবিনের ৮০ শতাংশই সরবরাহ করে রাশিয়া ও ইউক্রেন। পুরো বিশ্বের মোট গমের ৩০ শতাংশই উৎপাদিত হয় রাশিয়ায়। ১০ শতাংশ উৎপাদিত হয় ইউক্রেনে। সূর্যমুখী তেলের ৬৫ শতাংশ উৎপাদিত হয় রাশিয়ায়। এতে সহজেই অনুধাবন করা যায় যে সারাবিশ্বের খাদ্য ব্যবস্থায় রাশিয়ার ভূমিকা কতখানি। কিন্তু যুদ্ধের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়া থেকে প্রাপ্ত খাদ্য শস্য সরবরাহ ও রপ্তানি কার্যক্রম ব্যাহত রয়েছে বিভিন্ন দেশে। বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত সারের ২৫ শতাংশই রাশিয়া সরবরাহ করে। এর প্রভাব ফেলছে বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের পাশাপাশি বৈশ্বিক কৃষি সংকটেও।

রাশিয়া ও ইউক্রেনের খাদ্য শস্যের ওপর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক নির্ভরশীল। ইউক্রেনের উৎপাদিত শস্যগুলো কৃষ্ণসাগরের বন্দর দিয়ে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়। কিন্তু যুদ্ধের ফলে ইউক্রেনের কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলো রুশ নৌবাহিনী অবরোধ করে রাখায় এ রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। আবার যুদ্ধের দরুন ইউক্রেনে ও খাদ্যশস্য উৎপাদন অনেক কমে গেছে। ফলে উৎপাদিত ফসল রপ্তানিতে পোহাতে হচ্ছে নানা বাধা। যার ধাক্কা বাংলাদেশেও পড়েছে। এতে লাগামহীনভাবে প্রয়োজনীয় পণ্যের বাড়ার ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন কঠিন দাঁড়িয়েছে।

বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের দরুন আসন্ন বছরে বিশ্বে দুর্ভিক্ষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড অকেজো হয়ে পড়েছে। বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও আমদানিকৃত শস্যের মজুদ এবং সংগ্রহ রাশিয়ার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু যুদ্ধের ফলে সেই কার্যক্রম অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। তাছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পুরো বিশ্বে জ্বালানি তেলের ঘাটতি সৃষ্টি হয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কম হচ্ছে। আমাদের দেশে ও একই চিত্র আমরা দেখতে পেরেছি। সম্প্রতি আমাদের দেশে জাতীয় গ্রিডে যে বিপর্যয় ঘটে তার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন না হওয়া।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের পরিস্থিতি আরও অবনতি হবে। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। উপরন্তু আরও সংকট সংকট সৃষ্টি হয়ে বিশ্বে মানবিক বিপর্যয় বাড়বে। যুদ্ধ কখনও দীর্ঘস্থায়ী ফলদায়ক কোনো কিছু বয়ে আনে না। বরং এতে বিভিন্ন বিশ্বায়নমুখী সমস্যা বেড়ে যায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কবে সমাপ্ত হবে বা আরও কতদিন চলমান থাকবে তা বলা মুশকিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের রেশ আমাদের দেশেও পড়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যে চলমান যুদ্ধের কারণে ২০২১ সালের তুলনায় এই বছর সার আমদানির জন্য প্রায় ৪ গুণ বেশি পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হয়েছে আমাদের দেশকে। বিশ্বের বহুলাংশ দেশই এই যুদ্ধের নেগেটিভ ইমপ্যাক্টের শিকার হয়েছে।

বর্তমান প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি অনুযায়ী বেশি জরুরি বাংলাদেশসহ দেশগুলোর অর্থনীতি কোন পর্যায়ে রয়েছে, সে অনুযায়ী সংকট মোকাবিলায় ইতিবাচক ও জনবান্ধব পদক্ষেপ গ্রহণ করা বাঞ্চনীয়। বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের প্রভাব বাংলাদেশে সরাসরি না পড়লেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। আসলে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আমাদের দেশ সকল শঙ্কা, সংকট, বাজে পরিস্থিতি সফলভাবে সামাল দিয়েছে। ইতোমধ্যে আমাদের দেশ কিছু কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে সংকট মোকাবিলায়। এর পাশাপাশি আমাদের দেশের আমাদানি নির্ভরতা কমিয়ে ফেলতে হবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ঢেলে সাজাতে হবে। ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক কাঠামো ব্যবস্থায় মনোনিবেশ করতে হবে। কৃষি শিক্ষার প্রসার করতে হবে। ক্ষুদ্র কুটিরশিল্পের উন্নয়ন করতে হবে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষা ও সেবার মান উন্নীত করতে হবে। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। কর্মমুখী শিক্ষার প্রাধান্য দিতে হবে। তাতে উন্নয়নশীল দেশগুলো কর্মমুখী শিক্ষায় কোন কারিকুলাম অনুসরণ করে, তা প্রয়োগ করতে হবে। বিদেশ থেকে প্রবাসীরা যে রেমিট্যান্স প্রেরণ করে তা বাড়াতে নিয়মনীতি শিথিল করতে হবে। রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতির অন্যতম একটি হাতিয়ার। তাই এই খাতকে সর্বদা সচল রাখতে হবে। তাছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কার মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতির অবমূল্যায়ন হয়ে যে নাজেহাল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় তা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বাকি দেশগুলোর জন্য একটা সতর্কবার্তা। তাই আমাদের দেশের মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতিতে বিশেষ নজর রাখতে হবে। বাজেটে কৃষি খাতের বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। এতে মৌলিক চাহিদা নিশ্চায়নে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা হবে বিশ্বমানের এবং বিশ্ব পরিমণ্ডলে স্বাধীন ও অকৃত্রিম লাল-সবুজের শান্তির মশাল চলতে থাকবে যুগ থেকে যুগান্তরে।

শিক্ষার্থী

সমাজকর্ম বিভাগ

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়