অনিল মো. মোমিন: দেশে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে মাঝেমধ্যে আলোচনায় হলেও এ নিয়ে মূলত ঝড় ওঠে কিউএস প্রকাশের পরই। তবে এই আলোচনা-সমালোচনা অবশ্য হাতেগোনা শিক্ষক-শিক্ষার্থী, শিক্ষাবিদ আর গণমাধ্যমের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা ইউজিসির কারও কাছে এসব র্যাংকিয়ের খবর পৌঁছায় কি না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এবারের কিউএস র্যাংকিংয়ে সেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাংলাদেশের একটিও নেই। দেশের ৫২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাবি ও বুয়েট র?্যাংকিংয়ে ৮০১ থেকে ১০০০-এর মধ্যে রয়েছে টানা পাঁচ বছর ধরে। অন্যদিকে কিউএস র?্যাংকিংয়ে ৫০০-এর মধ্যে ভারতের ৯টি ও পাকিস্তানের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। দেশে বর্তমানে মোট ১৬০টি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যা আনুপাতিক হারে ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে সংখ্যায় অনেক বেশি। তবুও কেউ র্যাংকিংয়ে আসতে পারেনি, উন্নতিও করতে পারেনি। এরপরও নতুন বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পাচ্ছে। শিক্ষার মান নিশ্চিত না করে এত বিশ্ববিদ্যালয় কেন গড়তে হবে, তা সংশ্লিষ্টরাই ভালো জানেন।
শিক্ষকরাই-বা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে কী ধারণা রাখেন? তারা থাকেন রাজনীতিতে, নীল-সাদা দলে, শাপলা-কমলা ফোরামে। নানা মিটিং-সিটিং শেষে যান ক্লাসে, যেন খণ্ডকালীন কাজ! কেউ আবার যথাসময় ক্লাস না নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শিক্ষার্থীদের বসিয়েও রাখেন। কখনও ক্লাস না নিয়ে ছেড়ে দেন। কারও কারও ক্লাসগুলোও যেন মনমরা। আবার কোনো শিক্ষক শিট দেখে দেখে বাংলা অনুবাদ করেন। গৎবাঁধা কিছু আলোচনা করেন আর শিট ধরিয়ে দেন। লেকচারের মান দেখেই বোঝা যায়, তিনি ওই ক্লাসের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে আসেননি। কোনো শিক্ষক রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও যেতে বলেন। ভিসিরা ক্যাম্পাসে না এসে অফিস করেন রাজধানীতে বসে। আছে ভিসিদের এমন নানা কেলেঙ্কারি। কেউ আবার দিনের ক্লাস নেন শেষ রাতে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রশাসক কখনও ছাত্রকে থাপড়ে সোজা করে দিতে চান। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ কাজের সমাধান পেতে যেতে হবে ‘লাঞ্চের পর’। এসব ঘটনার কোনোটা কি বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার সঙ্গে যায়?
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবে বিকশিত হতে প্রধান অন্তরায় রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি। বিশ্বজুড়ে ‘খ্যাতিসম্পন্ন এদেশের রাজনীতি (!) ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে। অপরাজনীতির থাবায় ছিন্নবিচ্ছিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার শিক্ষা। তাই আমরা দেখি রাজনীতির ছোবলে প্রাণ দিতে হয় শিক্ষার্থীদের। এক শিক্ষার্থী হয়ে যায় আরেক শিক্ষার্থীর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী। পড়াশোনার পরিবর্তে হাতে তুলে নেয় লাঠিসোটা আর অস্ত্র। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যখন এই হাল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা সেখানে আরও করুণ। এগুলো যেন উচ্চশিক্ষা বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এখানে পড়ালেখার নামে দেদার চলছে সনদ বিক্রি। অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নেই গবেষণা, নেই ল্যাবরেটরি। লাইব্রেরি, পর্যাপ্ত ক্লাসরুম, এমনকি পরিবহন ব্যবস্থাও নেই। আছে শুধু নানা ফাঁদে শিক্ষার্থীর কাছ থেকে টাকা আদায়ের চোখধাঁধানো কলাকৌশল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আরেকটি সীমাবদ্ধতা হলো এখানে মুক্ত চিন্তার স্বাধীনতা নেই।
কিউএস র?্যাংকিংয়ের ভিত্তি হচ্ছে আটটি সূচক। সূচকগুলো হলো অ্যাকাডেমিক খ্যাতি, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, শিক্ষকপ্রতি গবেষণা-উদ্ধৃতি, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী অনুপাত, আন্তর্জাতিক শিক্ষক অনুপাত, চাকরির বাজারে সুনাম, আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক ও কর্মসংস্থান। এসব সূচকের আলোকে চিন্তা করলে দেখি আমাদের দেশে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই নেই। বিশ্বব্যাপী উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাতের ন্যূনতম মানদণ্ড ধরা হয় ১:২০। অর্থাৎ প্রতি ২০ শিক্ষার্থীর জন্য একজন করে শিক্ষক থাকতে হবে। অথচ গণমাধ্যমের তথ্য অনুসারে আমাদের সরকারি-বেসরকারি ৫৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই মানদণ্ড নেই। শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে আন্তর্জাতিক মান নেই স্বয়ং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েরও। এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৫৪। বেসরকারি ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৫০।
এদেশে রাজনীতি, স্বজনপ্রীতি বা টাকার বিনিময় প্রভাবে নিয়োগ যোগ্যতার সর্বনি¤œ শর্তাবলিতে কিংবা শিট মুখস্থ করে উচ্চ সিজিপিএ ধারণকারী শিক্ষার্থীরাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। এতে এসব শিক্ষকের একদিকে শিক্ষার্থীদের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকে কম, অপরদিকে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণেও থাকে আলসেমি। অনেকের গবেষণা উদ্দেশ্য থাকে আবার বেতন স্কেল বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। ফলে আমরা দেখতে পাই, সেসব গবেষণায় থাকে প্লেগারিজম। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী নেই বললেই চলে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুসংখ্যক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী থাকলেও বাকি অনেক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়তো জানেই না যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী না থাকলে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা ক্ষুণœ হয়। যদি র?্যাংকিংয়ে না থাকে, না থাকে যদি মানসম্মত শিক্ষা, তাহলে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী আসবেই বা কীভাবে! আর আন্তর্জাতিক শিক্ষকও নেই। আন্তর্জাতিক শিক্ষক নিয়োগের আগ্রহও নেই এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর।
ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২০-এ অনেক কিছু উঠে এসেছে। ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয় ২০২০ সালে গবেষণা খাতে এক টাকাও ব্যয় করেনি। এক লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে ৪৪টি বিশ্ববিদ্যালয়। একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যারা বছরজুড়ে দু-চারটি প্রকাশনা ব্যতীত অন্য কোনো গবেষণা করেনি। আবার গবেষণায় খরচ করেও কোনো প্রকাশনা বের করতে পারেনি ইবি, বেরোবি ও রাবিপ্রবি। সোয়া কোটি টাকার বেশি ব্যয় করে হাবিপ্রবির প্রকাশনা ছিল একটি। নোবিপ্রবি, যবিপ্রবি এবং ববি দুটি করে প্রকাশনা প্রকাশ করেছে। আর কর্মক্ষেত্রের দিকে নজর দিলে দেখা যায়, দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেও চাকরি হচ্ছে না। এমনকি চাকরির কোনো নিশ্চয়তাও নেই। পাঁচ বছরের একাডেমিক পড়াশোনার পাঁচ ভাগও চাকরি পরীক্ষায় কাজে আসে না। শিক্ষার সঙ্গে নেই কর্মক্ষেত্রের মিল। এদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বকীয়তা টিকিয়ে রাখতে সরকার ও ইউজিসির সম্মিলিত সদিচ্ছা প্রয়োজন।
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়