ইয়াছিন আরাফাত: ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই ছোট্ট দেশ বাংলাদেশ। এই দেশের সুবিস্তীর্ণ সবুজ প্রকৃতি সত্যিই মনোমুগ্ধকর। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলে ভরপুর, সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমি, নাতিশীতোষ্ণ এই দেশটি পৃথিবীর বুকে এক অনন্য। ১৯৭১ সালে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বের হয়ে আজ দীর্ঘ ৫৩ বছর অতিবাহিত করছে। কিন্তু কত শাসক এলেন, কত শাসক গেলেন দেশ, এখনও পিছিয়েই থেকে গেল।
১৬ বছর গণতন্ত্রের আবরণে স্বৈরশাসকের কালো থাবায় পড়ে, দেশটি যখন একরকম বিপন্ন হওয়ার পথেই পথ চলছিল, ঠিক তখনই দেশের হাজারও ছাত্রজনতার রক্তের বদৌলতে ফিরে এসেছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বিজয়। স্বাধীনতা পাওয়ার পর আবার স্বাধীনতা। এই বিজয় ছাত্রদের, এই বিজয় সব প্রকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে গণবিপ্লব। এবং এই বিজয় সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণ করার শপথের। যেটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে। ৩৬ দিনের বিরামহীন ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের আকাশে জমে থাকা স্বৈরাচারের জুলুমের কালো মেঘ দূরীভূত হয়েছে। এই বিজয় অর্জনে শহীদি মিছিলে শামিল হয়েছে ৩২টি নিষ্পাপ ফুটন্ত গোলাপ সাদৃশ ছোট্ট শিশুসহ হাজারও শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ। আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করেছে ১০ হাজারেরও অধিক শিক্ষার্থী।
১৯৭১ সালের দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর বাংলার জনগণ মনে করেছিল তাদের মনের দুঃখগুলো মুছে যাবে। দেশে উন্নতি হবে। মানুষেরা অনাহারে অর্ধহারে আর দিন কাটাবে না। কিন্তু তা আর হলো না। যুগে যুগে বিভিন্ন স্বৈরশাসক এসে আমাদের এই স্বাধীনতাকে বারবার ক্ষতবিক্ষত করে স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল আমাদের ছুঁইতে দেয়নি। বরং স্বাধীনতাকে করেছে বারংবার প্রশ্নবিদ্ধ আর পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ।
তরুণদের এই বিজয়ে বাংলার আপামর জনতা বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে। জনগণের চাওয়া হলো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে: সাংবিধানিকভাবে দেশে ন্যায়বিচারের ধারা উল্লেখ থাকলেও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাবে তা আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আশা করি, এই বিজয়ের হাত ধরে দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে যা এখন সর্বসাধারণের গণদাবিতে রূপ নিয়েছে। কেননা ভিন্নমত ও পথের মানুষ দেশে থাকতেই পারে, তাই বলে কি দেশে অন্যায় অবিচার করা হবে? যা কখনোই বাংলাদেশের নিরীহ জনগণ প্রত্যাশা করেনি এবং করবেও না। তাদের আশা আকাক্সক্ষা হলো দেশের সর্বত্র যেন সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রকৃত অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি দিতেই হবে। অপরাধী শাস্তি না পেলে অত্যাচারিত ব্যক্তির প্রতি অন্যায় হবে এবং অপরাধী বেপরোয়া হয়ে উঠবে।
দারিদ্র্যবিমোচন: পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশের মানুষ অনেক বেশি পরিশ্রমপ্রিয়। কিন্তু কর্মঠ হলেও দেশ থেকে আজও দারিদ্র্যবিমোচন হয়নি। এছাড়াও এই দেশে আরও রয়েছে অপার সম্ভাবনাময় সব অর্থনৈতিক উৎস। ধান, পাট, চিংড়ি, পোশাক তার অন্যতম। দারিদ্র্যবিমোচন না হওয়ার প্রধান কারণ ছিল আয়ের বৈষম্য, দুর্নীতি ও বিদেশে অর্থপাচার। মোটা দাগে এই তিনটি সমস্যার মূলে কুঠারাঘাত করে দেশ থেকে দারিদ্র্যবিমোচন করতে হবে যা মানুষকে মুক্তির পথ দেখাবে। দেশের প্রতিটি মানুষ তাদের মৌলিক পাঁচটি অধিকার থেকে কখনোই বঞ্চিত হতে পারবে না। প্রতিষ্ঠিত সরকারের উচিত হবে জনগণের এই প্রত্যাশা পূরণে সর্বোচ্চ অগ্রণী ভূমিকা পালন করা।
শিক্ষা ও গবেষণায় সমৃদ্ধি অর্জন: একটি দেশকে উন্নয়নের রোল মডেলে পৌঁছাতে হলে শিক্ষা ও গবেষণার সমৃদ্ধি অর্জনের বিকল্প অন্য কিছু নেই। বাংলায় একটি প্রচলিত প্রবাদ হলো, যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সেই জাতি তত বেশি উন্নত। শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে যেন একজন শিক্ষার্থী লেখাপড়া শেষ করে দেশের বোঝা না হয়ে দেশের সম্পদে পরিণত হয়। মেধাবীদের যথাযথ মূল্যায়ন হলে বিদেশে মেধা পাচারের হাত থেকে মুক্তি দেবে। তথ্য প্রযুক্তি ও জীবনমুখী শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষার দিকেও সদা সর্বদা সুদৃষ্টি রাখতে হবে। একজন সৎ, দক্ষ, দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরি করতে ধর্মীয় শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উন্নত গবেষণার সুন্দর পরিবেশ তৈরির যথাযথ উদ্যোগ নিয়ে শিক্ষার মান সংরক্ষণ করতে হবে।
অন্যায় অবিচার বিলুপ্ত করা: দেশের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে রাষ্ট্রে অন্যায় অবিচার বিলুপ্ত করা খুব জরুরি। দেশের সর্বোচ্চ প্রধান থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন প্রজা পর্যন্ত সবাই অন্যায়-অবিচার থেকে দূরে থাকা। সব ধরনের মারামারি হানাহানি, কাটাকাটি আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করা। অন্যায়ের সঙ্গে জড়িতদের উপযুক্ত শাস্তির বিধান কার্যকর করে দেশের জনগণকে সচেতনতা গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা। এক্ষেত্রে ধর্মীয় নিয়মনীতির চর্চা করা। মানুষের মন মগজে অন্যায়ের প্রতি আপসহীন ও ঘৃণার প্রভাব বিস্তার করা।
সুখী সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলাদেশ গড়া: বাংলার মানুষ দেখতে চায় একটি সমৃদ্ধ, ক্ষুধামুক্ত, নিরক্ষরমুক্ত, স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। যে রাষ্ট্রের মানুষেরা নিরাপদে তাদের সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাবে বিদ্যা অর্জনের জন্য, যেখানে মেয়েরা সম্মান সম্ভ্রম দর কর্মস্থলে নিরাপদে নির্বিঘ্নে কাজ করে দিনশেষে পরিবারের কাছে ফিরে যাবে। কারও মনে কোনো প্রকার জীবননাশের ভয়ভীতি থাকবে না। দেশের মাটি ও মানুষ সুখী ও সমৃদ্ধ হতে নিজেদের জায়গা থেকে সর্বাত্মক ভূমিকা পালন করবে। দেশে কোনো প্রকার দুর্নীতি থাকবে না। যা দেশের সমৃদ্ধির পথে বাধা সৃষ্টি করে। উন্নত চিকিৎসা সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে যেন কেউই দেশের টাকা দিয়ে বিদেশে চিকিৎসা নিতে না হয়।
সর্বোপরি, নতুন বিজয় দেশের ইতিহাসে যেনতেন কোনো বিজয় নয়, এই বিজয় স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ছাত্রজনতার বিজয়। তাই এই বিজয়ের প্রত্যাশা পূরণে দায়িত্বশীল মহলে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা থাকতে হবে, যেন এই বিজয়ের সুফল সত্যিকার অর্থে উপভোগ করা যায়। এই বিজয়ের প্রত্যাশা অসীম। তাই যা বলা হয়েছে, আর যা বলা হয়নি সবকিছু মিলিয়ে এই বিজয়ে জণগণের প্রত্যাশা পূরণে প্রত্যেক নাগরিকরে যত্নশীল ও দায়িত্বশীল হতে হবে।
বিজয়ের প্রত্যাশা তখনই বাস্তবায়ন হবে, যখন বাংলাদেশিরা গর্ব করে বলবে, দেশ আজ স্বাধীন সার্বভৌম, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য, নিরক্ষর, দুর্নীতি, সন্ত্রাস এবং স্বৈরাচারমুক্ত।
শিক্ষার্থী, আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষক ও ছাত্রের সম্পর্ক
কেমন হওয়া উচিত
মাহবুবুর রহমান
সূর্যের আলো পুরো পৃথিবীকে আলোকিত করে। পৃথিবীর রূপ-বৈচিত্র্য আমাদের সামনে দৃশ্যমান করে। তেমনি, শিক্ষা থেকে অর্জিত জ্ঞান আমাদের মন ও জীবনকে আলোকিত করে। জšে§র পর একটি শিশুর শিক্ষা গ্রহণের প্রথম পাঠ শুরু হয় তার পরিবারে। কিš‘ তার পরেই তাকে শিক্ষাদানের মহান দায়িত্ব অর্পিত হয় শিক্ষকের ওপর। শিক্ষক তার নিজের অর্জিত শিক্ষা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে গড়ে তোলেন তার শিক্ষার্থীকে। নিজের সমস্ত জ্ঞান তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। এই শিক্ষা দান ও গ্রহণের মধ্য দিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে গড়ে ওঠে সম্পর্কের এক অটুট বন্ধন। যে সম্পর্কের সামনে শ্রদ্ধায়, ভালবাসায় মাথা নত করি আমরা সবাই।
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক: যিনি শেখান তিনি শিক্ষক, যিনি শেখেন তিনি শিক্ষার্থী বা ছাত্র। তাই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে দাতা-গ্রহীতার সম্পর্ক বিদ্যমান। তবে সেই দান ও গ্রহণের বিষয় হলো শিক্ষা ও জ্ঞান। যুগে যুগে যত নবী রাসুল এসেছেন, সবাই শিক্ষক ছিলেন। সব নবী রাসুল তার অনুসারীদের শিক্ষা দিয়েছেন। তাদের সম্পর্ক ছিল সুমধুর। একজন শিক্ষার্থীর কাছে তার শিক্ষক সর্বো”চ সম্মানিত আসনে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি। আবার শিক্ষকের কাছে তার শিক্ষার্থীরা সন্তানের মতো প্রিয়। নিজের বিদ্যা-বুদ্ধি ও শ্রম দিয়ে একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীকে গড়ে তোলেন এবং নিজেকে সেই শিক্ষার্থীর আলোকিত জীবনের গর্বিত অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। শিক্ষার্থীরাও তাদের শিক্ষা জীবন এমন কি ব্যক্তি জীবনেরও প্রতিটি পদক্ষেপে, সাফল্যে-ব্যর্থতায় শিক্ষককে স্মরণ করে। শিক্ষক যেমন ছাত্রকে সফল করেন তেমনি ছাত্রের ব্যর্থতার দায়ভারও তিনি নিজের কাঁধে তুলে নেন। তাই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক হলো সাফল্য-ব্যর্থতা, গ্লানি কিংবা গর্বে সমান অংশীদারিত্বের সম্পর্ক।
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের স্বরূপ: খুব আশ্চর্য সুন্দর একটি সম্পর্ক হলো ছাত্র ও শিক্ষকের সম্পর্ক। এই সম্পর্ক একই সাথে খুবই সাবলীল, মধুর, স্বতঃস্ফুর্ত আবার গাম্ভীর্যপূর্ণ। শিক্ষক প্রয়োজনে শিক্ষার্থীর ওপর অবিভাবকসুলভ কঠোরতা, শাসন আরোপ করেন। আবার কখনো বা বন্ধুর মতো ভালবাসেন, পরামর্শ দেন, উৎসাহ যোগান, সব সময়ই পাশে থাকেন। শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে অবিভাবকের মতো সম্মান করে, আদেশ-উপদেশ মেনে চলে, শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। শিক্ষকের সাথে ছাত্রের সম্পর্ক পথ-প্রদর্শক আর পথিকের সম্পর্কের মতো। শিক্ষক পথ দেখান, ভবিষ্যতের দিক-নির্দেশনা দেন। আর শিক্ষার্থী সেই দেখানো পথে চলে, নির্দেশনা মেনে চলে। উদারতা স্নেহের, মায়া, ভালবাসা আর শাসনের মধ্য দিয়ে একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের ভেতরে স্বপ্নের বীজ বপন করেন। শিক্ষার্থীরা সেই স্বপ্নকে লালন করে। তাই ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্বপ্ন স্রষ্টারও।
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের গুরুত্ব: শিক্ষক হলেন মানুষ গড়ার কারিগর। তাই শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকের সম্পর্ক যত বেশি ভাল হবে, সুন্দর হবে, বন্ধুত্বপূর্ণ হবে শিক্ষক তার শিক্ষার্থীকে তত ভাল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবেন। শিক্ষকের সান্নিধ্যে এসে শিক্ষার্থীরা জীবনকে জনতে, চিনতে ও বুঝতে শেখে। সব কিছুকে নতুন করে দেখতে শেখে। শিক্ষক শিক্ষার্থীর দেখার চোখ খুলে দেয়, জ্ঞানের দরজা খুলে দেয়। তাদেরকে জ্ঞানের পথে, আলোর পথে নিয়ে যায়। শিক্ষক জীবন সম্পর্কে যে দর্শন চিন্তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয় তার ভিত্তিতেই তারা তাদের জীবনের ব্রত ঠিক করে। একজন ভাল শিক্ষক একজন বখে যাওয়া শিক্ষার্থীকেও সঠিক পথে নিয়ে আসতে পারেন, তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন।
সম্পর্ক যেমন ছিল: আগের দিনে ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক ছিল অকৃত্রিম। শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষককে শ্রদ্ধা করত দেবতার মতো। শিক্ষকের এক একটি আদেশ-উপদেশকে তারা বেদবাক্য বলে মনে করত। শিক্ষকেরাও শিক্ষার্থীদেরকে ভালবাসত আপন সন্তানের মতো। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের নির্দেশনা অলঙ্ঘনীয় মনে করে অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করতো। শিক্ষকদের সেবা করাও তাদের শিক্ষার অংশ ছিল। শিক্ষকেরাও তার শিক্ষার্থীকে সঠিক শিক্ষা দিতে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অটুট বন্ধনের উদাহরণ পাওয়া যায় মহাভারতে। পঞ্চপান্ডব তাদের গুরু অর্থাৎ শিক্ষককে এত শ্রদ্ধা করতো যে শত্রুপক্ষে থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্রত্যাগ করে তারা তাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। গুরুও তাদের বিজয়ী হওয়ার আশীর্বাদ করেন। ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কের নজির ¯’াপনকারী বাদশা আলমগীরের কথাও আমরা জানি। দ্বিগ¦ীজয়ী আলেকজান্ডারের শিক্ষক ছিলেন দার্শনিক এরিস্টটল। তাদের মধ্যে ছিল দৃঢ় সম্পর্ক। তাই আলেকজেন্ডার তার শিক্ষককে তার হƒদয় দিয়ে সর্বো”চ শ্রদ্ধা করতেন। এরিস্টটলও তাকে ভীষণ ভালবাসতেন। আর তাইতো আলেকজেন্ডারের মৃত্যুতে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন।
সম্পর্কের বর্তমান প্রেক্ষাপট: ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে এখন প্রবেশ করেছে কৃত্রিমতা, ব্যক্তিগত স্বার্থ আর লাভের হিসেব। একটা সময় ছিল যখন ছাত্ররা নিজ হাতে শিক্ষকের পা ধুয়ে দিত। আজ সেই হাতে তারা শিক্ষককে লাঞ্ছিত করে। আবার শিক্ষক যে হাত আশীর্বাদে, উৎসাহে, শুভকামনায় ছাত্রের মাথায় রাখত, সেই হাতে তারা কোমলমতি শিক্ষার্থীকে বেত্রাঘাতে ক্ষতবিক্ষত করছে। শিক্ষার্থীরা এখন শিক্ষককে ব্যবহার করতে চায় অসদুপায়ে ভাল ফল লাভের আশায়। অন্যদিকে শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদেরকে ব্যবহার করে অর্থ লাভের হাতিয়ার হিসেবে। আগে যেখানে শিক্ষকতা মহান পেশা ছিল এখন তা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে এখন স্বার্থের সম্পর্ক বিদ্যমান। ছাত্র শিক্ষক উভয়ই এখন শিক্ষাঙ্গনের রাজনীতিতে যুক্ত। ফলে সেখানেও তাদের মধ্যে রয়েছে আপোসের সম্পর্ক। তবে প্রতিটি ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক এমন নয়। এখনও সৎ শিক্ষক ও ভাল ছাত্ররা আছে। তবে তাদের পরিমাণ দিন দিন কমে যা”েছ।
সম্পর্কে অবনতির কারণ: শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কে যে চরম অবনতির সৃষ্টি হয়েছে তার অন্যতম প্রধান কারণ হলো মানুষের সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। একজন শিক্ষক তার মূল্যবোধকে ভুলে গিয়ে, নীতি নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে ছাত্রদেরকে শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের জন্য ব্যবহার করছেন। ছাত্রদেরকে জিম্মি করে তাদের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা আদায় করছেন। এমনকি শিক্ষার্থীরা তাদের পাশবিকতারও শিকার হ”েছ। যাকে মানুষ গড়ার কারিগর বলা হয় তিনি তার নীতি ভুলে ছাত্রদের ডিগ্রী লাভের শর্টকার্ট উপায় বলে দি”েছন। শিক্ষক এবং ছাত্রের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা নেই। অবিভাবকেরাও সচেতন নন। ফলে ছাত্ররা বিনাশ্রমে সর্বো”চ ফলাফলের জন্য শিক্ষকের সঙ্গে আঁতাত করছে। শিক্ষক-ছাত্রের লেনদেনের সম্পর্কের কারণে সৃষ্টি হ”েছ প্রশ্ন ফাঁসের মতো অপরাধ।
শিক্ষকের কাছে প্রত্যাশা: একজন শিক্ষকের কাছে তার শিক্ষার্থীর প্রত্যাশা হলো শিক্ষক তাকে জীবনোপযোগী, যুগোপযোগী শিক্ষা দেবেন। তাকে জ্ঞান অর্জনের পথ দেখাবেন, আলোর পথের যাত্রী করবেন। শিক্ষক তার ছাত্রের ভেতর জ্ঞান লাভের, অজানাকে জানার, অদেখাকে দেখার এবং চেনা-জানা বিষয়গুলোকে নতুন করে চেনার আকাক্সক্ষা সৃষ্টি করে দেবেন, ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনা দেবেন। তাদেরকে উৎসাহ, প্রেরণা, শক্তি যোগাবেন। সব সময় ছায়া হয়ে মাথার ওপরে থাকবেন। শিক্ষক তাদেরকে ভাল-মন্দ, ভুল-সঠিকের দৃষ্টিভঙ্গি শেখাবেন। সর্বোপরি শিক্ষকের কাছে প্রত্যাশা হলো তিনি তার ছাত্রকে ভালমানুষ হিসেবে, সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবেন।
ছাত্রের কাছে প্রত্যাশা: শিক্ষক জ্ঞানদাতা, তাই বলে তিনি কেবল দিয়েই যাবেন তা নয়। বরং শিক্ষার্থীর কাছে তারও কিছু প্রত্যাশা থাকে। শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষকের সব চেয়ে বড় প্রত্যাশা হলো শিক্ষার্থীরা তার দেয়া শিক্ষায় প্রকৃত অর্থেই শিক্ষিত হবে। তার দেখানো পথে চলবে। ছাত্ররা তাকে সম্মান করবে, শ্রদ্ধা করবে, শিক্ষক হিসেবে তার প্রাপ্য মর্যাদা দেবে। শিক্ষক যেমন ছাত্রের অনেক বড় শুভাকাক্সক্ষী। তেমনি শিক্ষক প্রত্যাশা করেন তার ছাত্ররাও তাকে ভালবাসবে, তার প্রতি অনুগত থাকবে।
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক উন্নয়নে করণীয়: একজন শিক্ষক তখনই সফল হন যখন তিনি নিজ শিক্ষায় তার ছাত্রকে শিক্ষিত করতে পারেন। আর ছাত্রও তখনই সফল হয় যখন সে সেই শিক্ষাকে আত্ম¯’ করতে পারে, উপলব্ধি করতে পারে। আর এ জন্য প্রয়োজন ছাত্র শিক্ষক সুসম্পর্ক। কিš‘ বর্তমানে এই সম্পর্ক খুবই নাজুক। তাই এই সম্পর্কোন্নয়নে কয়েকটি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে। ক. শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে অবশ্যই পরস্পরের উপর অর্পিত দায়িত্ব-কর্তব্যগুলো পালন করতে হবে; খ. পরস্পরের কাছে যে প্রত্যাশাগুলো রয়েছে সেগুলো পুরণ করতে হবে; গ. কোনো পরি¯ি’তিতেই কেউ কারো প্রতি অসাদাচরণ করবে না। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে। শিক্ষক তাদের প্রতি স্নেহশীল থাকবেন; ঘ. শিক্ষকদের আর্থিক অব¯’ার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। তাদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে যাতে তারা স্ব”ছল জীবনযাপন করতে পারে; ঙ. শিক্ষকের দ্বারা শিক্ষার্থী অনেক বেশি প্রভাবিত হয় তাই শিক্ষকের উচিত নিজের গুণাবলীগুলো শিক্ষার্থীর ভেতরে ছড়িয়ে দেয়া; চ. শিক্ষকতাকে শুধু মহান পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেই হবে না বরং তা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে; ছ. অভিভাবকের উচিত সন্তানকে নৈতিক শিক্ষা দেওয়া যেন তারা শিক্ষককে সম্মান করে; জ. সর্বোপরি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে সকলেরই উচিত একসাথে কাজ করা।
একজন ভাল শিক্ষক একজন ছাত্রের জীবন আমূল বদলে দিতে পারেন। তাকে নবজš§ দিতে পারেন। সম্ভাবনা আর সাফল্যের দুয়ারে পৌঁছে দিতে পারেন। তাই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ভিত্তি মজবুত ও দৃঢ় হওয়া প্রয়োজন। স্মেহভালবাসা আর শ্রদ্ধা-সম্মানে যে সম্পর্ক রচিত হয় সেই সম্পর্ক যেন সর্বদাই অটুট থাকে। ছাত্র-শিক্ষকের পবিত্র সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখা সকলেরই নৈতিক দায়িত্ব।