রেজাউল করিম খোকন: এমন বিজয় বাংলাদেশের মানুষ আগে দেখেনি, এমন পতনও তারা দেখেনি। দাম্ভিকতা, অহমিকা, আমিত্ব, বিরোধী মতের মানুষকে কোনোভাবেই সš§ান মর্যাদা না দিয়ে অপমান তুচ্ছতাচ্ছিল্য করায় প্রবণতা, চাটুকার পরিবেষ্টিত হয়ে সর্বনাশা সিদ্ধান্ত গ্রহণ শেখ হাসিনাকে ভয়ংকর পতন ও মারাত্মক পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। নিজের সর্বনাশ ডেকে আনছেন এটি তিনি উপলব্ধি না করে আরও বেপরোয়া, আরও ভয়ংকর হয়ে উঠেছিলেন। তার শেষ দিককার কর্মকাণ্ড দেশের সব মানুষকে চরমভাবে বিক্ষুব্ধ করে এক কাতারে নিয়ে এসেছিল। তখন শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন স্বৈরাচারী-স্বেচ্ছাচারী শেখ হাসিনার দুঃশাসনের অবসান এবং তার বিদায়ের এক দফা দাবিতে পরিণত হয়। যার চূড়ান্ত পরিণতি তার পদত্যাগ এবং দেশে ছেড়ে পলায়ন। সবশেষে পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় গ্রহণ। একজন জননেত্রী থেকে ভয়ংকর স্বৈরাচারী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়ে দেশ-বিদেশে নিন্দনীয় হয়েছেন আরও আগেই। বাংলাদেশের মানুষ রক্ত দিয়ে শেখ হাসিনার সব কৌশল ব্যর্থ করে দিয়েছে।
তার নির্দেশে যত বেশি সংখ্যক মানুষ হত্যা করা হয়েছে তত বেশি মানুষ এই আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। নারীরা তাদের সন্তানদের সঙ্গে রাস্তায় নেমে আসে। ছাত্রীরা আরও বেশি এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়। তারা বুঝতে পারে তাদের ভাইদের হত্যা ও নিপীড়ন ঠেকাতে হলে শেখ হাসিনার বিদায় ছাড়া সম্ভব নয়। ফলে ছাত্র আন্দোলন শেখ হাসিনার পতনের এক দফার আন্দোলনে রূপ নেয়। এটি হয়ে ওঠে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ছাত্র-জনতার আন্দোলন। ছাত্র আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ বাংলাদেশের নতুন এক রাজনৈতিক শক্তি প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
শেখ হাসিনা তার ১৮ বছরের স্বৈরশাসনে বাংলাদেশে মানুষের সব ধরনের মৌলিক অধিকার হরণ করেছিলেন। তার শাসনের মূল চাবিকাঠি ছিল ভয় দেখানো। এই ভয় দেখানোর কাজটি করা হতো প্রশাসন, আদালত এবং তার দলের পেটোয়া বাহিনীর মাধ্যমে। ফলে বাংলাদেশের বহু মানুষ ভয়ে অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। তিনি ভেবেছিলেন দেশের মানুষ তার নিপীড়নমূলক শাসন মেনে নিয়েছে। কিন্তু এ দেশের মানুষ কখনোই তার ফ্যাসিস্ট শাসন মেনে নেয়নি তারা ঐক্যবদ্ধ আওয়াজের অপেক্ষায় ছিলেন। ছাত্ররা মানুষের কথা বলার সেই পরিবেশ তৈরি করে দেয়। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটিকে শেখ হাসিনা একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের মতো করে পরিচালনার চেষ্টা করেছেন। সাধারণ মানুষ যে রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক তা তিনি কখনোই মনে করতেন না। তিনি মনে করতেন, তার পিতা ও তার পরিবার এ দেশের মানুষকে একটি রাষ্ট্র এনে দিয়েছে। ফলে গণভবনে বসে এই দেশ শাসন করার একমাত্র এখতিয়ার হচ্ছে তার পরিবারের।
তিনি কার্যত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে একটি জমিদারিতে পরিণত করতে চেয়েছেন, যার একমাত্র শাসক হচ্ছে তার পরিবার। ফলে তার পতনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আক্রোশের প্রকাশ ঘটে গণভবনে। সেখানে হাজার হাজার মানুষ ঢুকে পড়ে। পতনের উল্লাস প্রকাশ করে। এ দেশের মানুষের ওপর নিপীড়নমূলক শাসন চাপিয়ে দিয়ে তারা পরিবার বিদেশে বিলাসী জীবনযাপন করে গেছেন। শেখ হাসিনার ১৮ বছরের দুঃশাসনে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, প্রশাসন পরিচালনা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তি পূজার এক অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস চাপা দিয়ে তার বাবা ও পরিবারকে বাংলাদেশের একমাত্র মহানায়ক হিসেবে হাজির করেছিলেন। তার বাবার নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এ নিয়ে এ দেশের মানুষের মধ্যে কারও কোনো দ্বিমত নেই।
পৃথিবীর ইতিহাসে চীনের তিয়েন আনমেন স্কোয়ারে ছাত্র আন্দোলনের পরই জীবনহানি সংখ্যার বিবেচনায় বাংলাদেশের এ ছাত্র আন্দোলনকে দ্বিতীয় বৃহত্তম ছাত্র আন্দোলন বলা যায়। মানুষ হত্যাকাণ্ডের যে দৃশ্যাবলি দেখেছি, নৃশংস ও নির্মমতার দিক দিয়ে তা কেবল মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের হাতে বাঙালি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেই তুলনা চলে। সাভারের কাছে পুলিশের আর্মার্ড পারসোন্যাল কেরিয়ার অথবা এপিসির ওপর থেকে গুরুতর আহত একজন শিক্ষার্থীকে পুলিশ সদস্যরা যেভাবে রাস্তার ওপর ফেলে দিয়েছে, তা দেখে মানুষ স্তম্ভিত হয়ে গেছি।
শিক্ষার্থীটি হয়তো গুলি অথবা পুলিশের পিটুনি খেয়ে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন। রাস্তায় পড়ার পর আহত শিক্ষার্থীটিকে নড়াচড়া করতে দেখা গেছে। তিনি টেনে টেনে নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করছিলেন। পুলিশ শিক্ষার্থীটিকে ছুুড়ে ফেলেই শান্ত হয়নি। পশুর মতো টেনেহিঁচড়ে রাস্তার মাঝ বরাবর নিয়ে যায়, তারপর সড়ক ডিভাইডারের ওপর দিয়ে রাস্তার ওপর পাশে আছাড় মেরে ছুড়ে ফেলে। ততক্ষণে ছেলেটি মরেই গেছে। আহত শিক্ষার্থীকে এভাবে মেরে ফেলার দৃশ্যটি এখনো নেট দুনিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। দুনিয়ার যে কেউ এ নির্মম দৃশ্য দেখে নিজেকে স্থির রাখতে পারবেন না। শিক্ষার্থীটি তো আহত ছিলেন, পুলিশের উচিত ছিল এমন পাশবিক আচরণ না করে তাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী, যুদ্ধক্ষেত্রেও আহত শত্রুকে চিকিৎসা দেয়া রেওয়াজ আছে। এটি যুদ্ধক্ষেত্রও নয়। শিক্ষার্থীটির হাতে কোনো মারণাস্ত্রও ছিল না। তাহলে এমন করে তাকে মেরে ফেলা হলো কেন? আরও একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, পুলিশের তাড়া খেয়ে একজন তরুণ রামপুরার একটি নির্মাণাধীন ভবনে জালানার কার্নিশে আত্মরক্ষার জন্য আশ্রয় নেন।
পুলিশের একজন সদস্য তার পিছু পিছু এসে দেখতে পেয়ে খুব কাছ থেকে তিন থেকে চারটি গুলি করে মারাত্মকভাবে জখম করে চলে যায়। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করেছি, তার পরপরই অন্য একজন পুলিশ সদস্য এসে আরও কয়েক রাউন্ড গুলি করে তরুণটির মৃত্যু নিশ্চিত করে চলে যান, যা ছিল খুবই নির্মম ও বর্ণনাতীত। অথচ পুলিশ অতি সহজেই তরুণটিকে গ্রেপ্তার করতে পারতেন। কারণ তরুণটির জানালার কার্নিশ থেকে অন্য কোথাও পালিয়ে যাওয়ার পথ ছিল না। সম্ভবত পাশের ভবন থেকে কেউ একজন এ দৃশ্য ধারণ করে নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেন, যা দেখে সবাই স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। পুলিশের এ বর্বর আচরণ পৃথিবীর সব মানবতাবিরোধী অপরাধকে ছাড়িয়ে গেছে। পুলিশ সদস্যদের এমন বর্বর আচরণ দেখে মনে মনে ভেবেছি, ওরাই কি আমার দেশের পুলিশ? আমারই মতো বাংলায় কথা বলেন? ওরা কি এ দেশেরই সন্তান? বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শিশু মৃত্যুর হার দেখে জাতিসংঘের শিশু ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। প্রশ্ন উঠেছে, আইনবহির্ভূতভাবে একে সিরিজের অ্যাসল্ট রাইফেলের মতো প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্রের নির্বিঘ্ন ব্যবহার নিয়ে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও এসব অস্ত্রের বেআইনি ব্যবহার নিয়ে অভিযোগ তুলেছে। অথচ এসব অস্ত্র পুলিশের ব্যবহারের জন্য অন্তর্ভুক্ত করা ঠিক হয়নি।
কারণ প্রাণঘাতী অস্ত্র কখনো নিরস্ত্র মানুষের বিক্ষোভ দমনে ব্যবহার করা হয় না। মানুষের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। অথচ সরকার ও পুলিশের তরফ থেকে সহিংসতায় রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতার কথা বারবার বলা হলেও বেশির ভাগ সাধারণ মানুষই গ্রেপ্তার হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী এবং সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যাই বেশি। সরকারের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত বৈষম্যবিরোধী এ আন্দোলনকে এত দূর টেনে এসেছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কবি-লেখক, অভিনয় শিল্পীসহ শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরাও তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। আন্দোলন এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে সরকারের আশঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, একটি নিয়মতান্ত্রিক কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী এমন অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো কেন? এর পেছনে সরকারের নেয়া কিছু ধারাবাহিক পদক্ষেপ এমন অস্থির পরিস্থিতি তৈরির জন্য দায়ী। প্রথমেই সরকার যে মারাত্মক ভুলটি করেছে তা হলো, অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ ক্যাডার ও পুলিশ দিয়ে জোরপূর্বক আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা। ফলে রংপুরের আবু সাঈদসহ ছয়জন শিক্ষার্থীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
এ মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই আন্দোলন অন্যদিকে মোড় নিতে শুরু করে। শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের পাশাপাশি সরকারের কাছে নতুন করে ৯ দফা দাবি পেশ করে। দ্বিতীয়ত, আন্দোলন চলাকালে ঢাকার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। একইসঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীসহ আরও অধিকসংখ্যক মানুষ নিহত হয়েছেন। অথচ সরকার মৃত্যুর ঘটনায় তেমন গুরুত্ব না দিয়ে, স্থাপনা ধ্বংসের বিষয়গুলোকে বেশি হাইলাইট করে বক্তৃতা ও বিবৃতি দেয়া শুরু করে, যা আন্দোলনকারীদের মনে আরও ক্ষোভের সৃষ্টি করে। তৃতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী হাসপাতালে ভর্তি আহতদের দেখতে না গিয়ে, প্রথমেই গেলেন ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপনা পরিদর্শনে, যা শিক্ষার্থীসহ দেশের সাধারণ মানুষ ভালো চোখে দেখেনি। এ নিয়ে নেট দুনিয়ায় তীব্র সমালোচনাও হয়। যদিও পরদিন তিনি আহত ব্যক্তিদের দেখতে হাসপাতালে যান। কিন্তু ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার তাই হয়ে গেছে।
চতুর্থ, শিক্ষার্থীদের পেশ করা ৯ দফা দাবি নিয়ে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি না করে সরকার উলটো বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের হেফাজতের নামে ডিবি অফিসে তুলে নিয়ে গেছে। তারপর সমন্বয়কারীদের নিয়ে ডিবি অফিসে যা হয়েছে তা বরং আন্দোলনকারীদের আরও উসকে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতও হেফাজতের বিষয়টি নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন। পঞ্চমত, হত্যাকাণ্ডের মামলাগুলো নিয়ে পুলিশ যা করেছে, তা নিয়ে সরকারের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে মানুষের ভেতর সন্দেহের দানা বেঁধেছে। রংপুরের সর্বাধিক আলোচিত আবু সাঈদসহ দেশের অন্যান্য স্থানের হত্যাকাণ্ডের এজাহারে পুলিশের গুলি করার কথা উল্লেখ না করে, এসব হত্যাকাণ্ডের দায় তৃতীয় পক্ষের ওপর চাপানোর যে চেষ্টা চলেছে, তা জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। অবশ্য পরে এ হত্যার দায়ে একজন এসআই ও একজন কনস্টেবলকে বরখাস্ত করা হয়। যেসব ছাত্রলীগ ও যুবলীগের অস্ত্রধারী নেতাকর্মীর নাম ও ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তাদের গ্রেপ্তার করে আইনি কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের মন্ত্রীরা শিক্ষার্থীদের হয়রানি করা হবে না মুখে বললেও দেশের বিভিন্ন জেলায় সশস্ত্র ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণ করেছে। ফলে সরকারের ওপর থেকে জনগণের আস্থা চলে যায়। দেশের নাগরিকরা আর শেখ হাসিনা সরকারের ওপর ভরসা রাখতে পারেনি। এরই ধারাবাহিকতায়, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির প্রতিবাদী মানুষ একে একে আন্দোলনে গিয়ে যোগ দিয়েছেন। ক্ষমতা স্থায়ী নয়। জোর করে ক্ষমতায় আসা যায়, অনেক দিন থাকাও যায়। কিন্তু এক সময় বিদায় অনিবার্য হয়। জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত হতে হয়। শেখ হাসিনার করুণ বিদায়ের মধ্য দিয়ে তা আরেকবার প্রমাণ হলো।
বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা হারানোর ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করলেন। টানা ১৬ বছরের শাসনে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে; পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেলসহ নানা স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। তা ছাপিয়ে উঠেছে মন্ত্রী-এমপিদের বিত্তবৈভবের প্রতিযোগিতা; বেনজীর-মতিউরদের লুটপাটের কিচ্ছা-কাহিনি। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তার একজন পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। কিন্তু আমজনতার আয় বাড়েনি, ব্যয় বেড়েছে। একদা এমপি-মন্ত্রীরা জনগণের কাছে আসতেন, তাদের কথা শুনতেন। জনগণ বলতে পারতেন, জিনিসপত্রের দাম না কমলে, ছেলেমেয়েদের চাকরি না হলে ভোটের বাক্সে জবাব দেব। শেখ হাসিনার শাসনামলে সে সুযোগ তিরোহিত হয়। নেতারা বলতেন-নৌকা মার্কা পেলেই চলবে, ভোট লাগবে না। ভোটে জিততে ভোটার লাগে না, দরকার ক্যাডার আর আমলা-পুলিশের। তাই ভোট দিতে না পারার যন্ত্রণা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, লুটপাট, দুর্নীতি, কর্তৃত্ববাদী শাসনের ফলে জনমনে যে ক্ষোভ জমাট বেঁধেছিল, তা আছড়ে পড়েছিল শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে। তারা বিস্মৃত হয়েছিলেন, অবকাঠামোগত উন্নয়নই কেবল উন্নয়ন নয়; জনগণের জীবনমানের উন্নয়নই আসল কথা। পাকিস্তান আমলে প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ১০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তার শাসন আমলেই রাস্তা-ঘাটসহ ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছিল।
শহর ও গ্রামে, রাজনীতিক ও আমলাদের মধ্যে একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী জš§ নিয়েছিল। তারাই ছিল আইয়ুবের তল্পিবাহক। ১৯৬৮ সালে ঘটা করে উন্নয়ন দশক পালন করেছিল। সাধারণ মানুষের গায়ে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। ‘উন্নয়ন দশক’-এর এক বছরের মাথায় জনগণের সেই পুঞ্জীভূত ক্ষোভের আগুন জ্বলেছিল ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে, যা স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের বিদায় ঘণ্টা বাজিয়েছিল। ৫৫ বছর পর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। স্বাধীন বাংলাদেশে গণআন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতন ঘটল আরও করুণভাবে। তিনি হেলিকপ্টারযোগে দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। একদা যাদের ভোটাধিকার কেড়েছিলেন; ন্যায়সংগত দাবি অগ্রাহ্য করেছিলেন, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলে উপহাস করেছিলেন।
ভুলে গিয়েছিলেন সেই অমোঘ বাণী, ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা।’ সেই জাগ্রত জনতার ভয়ে শেখ হাসিনাকে পালিয়ে যেতে হলো। প্রমাণিত হলো দেশের মালিক জনগণ। জনগণের শক্তিই বড় শক্তি। শেখ হাসিনার বিদায়, জনতার জয়। এখন যে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার আসছে, তাদের সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আজ ভূলুণ্ঠিত। একাত্তরের চেতনায় বৈষম্যহীন বাংলাদেশ আমরা গড়তে পারিনি। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্ন আমরা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা কায়েম করা যায়নি। ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি সুশাসন। আমরা কি ২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর সেই বাংলা ফিরে পাব, যেখানে সবাই মেধা ও যোগ্যতায় চাকরি পাবে, অর্থনীতিতে সাম্য আসবে? শেখ হাসিনার পতনের পর সারাদেশের মানুষ রাস্তায় নেমে এসে উল্লাসে মেতে উঠেছে। কিন্তু একই সঙ্গে মানুষের দৃষ্টি, কারা রাষ্ট্রের দায়িত্বে আসছে? সেখানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কী হবে। আশার কথা হলো- বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেনি।
যদিও সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিলেও মানুষ হয়তো তাতে স্বাগত জানাত। কিন্তু সেনাবাহিনী প্রাথমিকভাবে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সব রাজনৈতিক দলকে সেনাসদরে আমন্ত্রণ জাননো হয়। সেনাপ্রধান স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, সবার সঙ্গে আলোচনা করে অর্ন্তবর্তী সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্যটি এসেছে ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের কাছ থেকে। তারা জানিয়ে দিয়েছেন, অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে তারা নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের নাম প্রস্তাব করেছেন। তিনি এ দায়িত্ব পালন করতে রাজি হয়েছেন। ড. ইউনূস ছিলেন শেখ হাসিনার প্রতিহিংসার শিকার। ড. ইউনূসের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের নতুন যাত্রা শুরু হতে পারে। সত্যিকার অর্থে হয়তো তার নেতৃত্বে বিভাজনের রাজনীতির অবসান ঘটে বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।
যে শ্রম ও কর্মজীবী মানুষ শিক্ষার্থীদের পাশে থেকে এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের জীবনে কি শান্তি ও স্বস্তি ফিরে আসবে? ছাত্র আন্দোলনের মধ্যদিয়ে শেখ হাসিনার পতন যেমন নতুন এক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার সম্ভবনা তৈরি করেছে তেমনি বাংলাদেশ রাষ্ট্র ভয়ানক এক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। গণআন্দোলনে শেখ হাসিনার পতনের কারণে বাংলাদেশের রাজনীতি ও প্রশাসনে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এখন দ্রুত একটি অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠা করে সে সরকারকে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে নতুন নির্বাচনের পথে যেতে হবে।