আমির আসহাব: আমরা ১ থেকে ১২তম বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিবন্ধিত শিক্ষক। ২০০৫ সালে গঠিত হয় বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। প্রতিষ্ঠালগ্ন হতে এনটিআরসিএ’র কাজ ছিল শুধু প্রত্যয়ন প্রদান করা, শিক্ষক নিয়োগ হতো ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে। কিন্তু ২০১৫ সাল থেকে ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ করে এনটিআরসিএ-কে নিয়োগ সুপারিশের অনুমতি দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। স্নাতক-স্নাতকোত্তর করা তরুণ-তরুণীরা নিয়োগ পরীক্ষা দিয়ে ‘নিবন্ধন সনদ’ অর্জন করেছে এবং শিক্ষক হিসেবে শুধু তাদেরই নিয়োগ দেয়া হবে। কাজেই শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার কাজটা স্বচ্ছ এবং সহজ হওয়ার কথা। কিন্তু এনটিআরসিএ’র সিস্টেম-দুর্নীতি, প্রহসনে গণবিজ্ঞপ্তি (নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি), সাবেক শিক্ষামন্ত্রীদ্বয়ের মিথ্যা আশ্বাস, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও স্বেচ্ছাচারিতায় ১ থেকে ১২তম নিবন্ধিত বৈধ সনদধারীরা বারবার নিয়োগ বঞ্চিত। অন্যদিকে ৬০ হাজার অবৈধ সনদধারী চাকরিরত, সরকারি বেতন-ভাত পাচ্ছেন।
প্রতিষ্ঠানভিত্তিক আবেদনের বিপরীতে সুপারিশ কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায়, কেউ কেউ ৪০ মার্কেও চাকরি পেয়েছে, আবার কেউ কেউ ৮০ মার্ক পেয়ে হয়েছেন নিয়োগ বঞ্চিত। এন্ট্রি লেভেলের শিক্ষকদের সঙ্গে ইনডেক্সধারী (ইতোমধ্যে এমপিওপ্রাপ্ত) শিক্ষদের আবেদনের সুযোগ রাখায় ইনডেক্সধারী শিক্ষক দ্বারা অধিকাংশ পদই পূরণ হতো। ফলে ইনডেক্সধারীরা নতুন শূন্যপদে যোগদান করলে আগের পদটি শূন্য হতো, আর অপেক্ষাকৃত ভালো পদ মনে না করলে, যোগদান না করলে শূন্যপদ শূন্যই থাকত। হাজার হাজার শূন্যপদের বিপরীতে (ঋণ করে, সম্পত্তি বিক্রি করে, গহনা বন্ধক রেখে) আবেদন করে লাখ লাখ টাকা খরচ করে নিবন্ধিতরা হয়েছে সর্বস্বান্ত।
১ থেকে ১২তমদের (এন্ট্রিলেভেল মার্ক-৪০ পেলেই নিয়োগ যোগ্য বিবেচিত হওয়ায়) বেশি নম্বরের প্রতি কারও তেমন আগ্রহ ছিল না, ফলে ৯০ ভাগেরই অবস্থান তালিকার পেছনের দিকে। অন্যদিকে ২০১৫ সালে সুপারিশ প্রক্রিয়া এনটিআরসিএ’র হাতে আসায় ১৩তম থেকে ১৭তমরা প্রতিযোগিতা করে বেশি নম্বরসহ উত্তীর্ণ হয়ে সুপারিশের সম্ভাবনাকে কাজে লাগায়। অথচ ১ থেকে ১২তমরা ক্ষতিগ্রস্ত ও নিয়োগ সুপারিশ বঞ্চিত হতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে আদালতের দ্বারস্ত হয়ে রিট করেন। ১২ জুন ২০১৮ তারিখের আগে যারা নিবন্ধন সনদ পেয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে আপিল বিভাগের ৩৯০০/২০১৯ রায় অনুযায়ী বয়সসীমা শিথিলযোগ্য এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশে, সনদের মেয়াদ পাঁচ বছর বাক্যটি বিলুপ্ত করে, আজীবন করা হয়। কিন্তু বর্তমানে এমপিও নীতিমালা অনুসারে ৩৫ ঊর্র্ধ্বদের শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশের সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। অথচ পরীক্ষার মাধ্যমে উত্তীর্ণকালে কারও বয়স ৩৫ ঊর্র্ধ্ব ছিল না। যথেষ্ট শূন্যপদ থাকার পরও নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে নিয়োগ সুপারিশ না করা, এনটিআরসিএ’র অদক্ষতা বা অপারগতায় নিবন্ধিত শিক্ষকেরা বঞ্চিত।
এতে কয়েকটি বিষয়ে বঞ্চনা লক্ষণীয় ক. প্রতি গণবিজ্ঞতিতেই এক-চতুর্থাংশ পদও পূরণ করতে পারেনি এনটিআরসিএ। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে কৃত্রিম শিক্ষক সংকট। তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনকৃত প্রার্থীর আবেদনের বিপরীতে শূন্যপদ পূরণ না করে, চতুর্থ গণবিজ্ঞতিতে আবার শিক্ষক চাহিদা নেয়া হয়েছে। একইভাবে চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনকৃত প্রার্থীর আবেদনের বিপরীতে শূন্যপদ পূরণ না করে, চতুর্থ গণবিজ্ঞতিতে আবেদন নেয়া হয়েছে। পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিও এর ব্যতিক্রম নয়। এভাবে বারবার নিবন্ধিত শিক্ষকেরা হয়েছে নিয়োগ বঞ্চিত;
খ. বছরের পর বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চাহিদা দিয়েও শিক্ষক পাচ্ছে না, বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক চাহিদা দিয়েও শিক্ষক না পাওয়ায় অধিকাংশ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অ্যাডহক শিক্ষক দিয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, ফলে কচিকাঁচা শিক্ষার্থীরা হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত। অথচ এবারও ৯৭ হাজার শূন্যপদের মধ্যে ফাঁকা থাকছে বা রাখা হয়েছে প্রায় ৮০ হাজার পদ;
গ. বছরে একাধিকবার পরীক্ষা নিয়ে নিবন্ধনধারীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এনটিআরসিএ চেয়ারম্যানের ড্রাইভার ও সিস্টেম অ্যানালিস্ট অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে উচ্চমার্কের সনদ এবং নিয়োগ সুপারিশ করে প্রকান্তরে বৈধ সনদধারীদের নিয়োগ বঞ্চিত করে রেখেছে। এনটিআরসিএ যে উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছিল তা যথাযথভাবে পালন করলে শিক্ষাক্ষেত্র বিরম্বনাময় ব্যর্থ অধ্যায় না হয়ে, হতে পারত সাফল্য গাঁথা।
বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় কৃত্রিম শিক্ষক সংকট দূরীকরণ, জাল সনদ প্রদানকারী সংঘবদ্ধ চক্র এবং নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের চাকরিচ্যুতসহ অবৈধ নিয়োগের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এনটিআরসিএ’র কৌশলে বারবার বঞ্চিত এক ঝাঁক স্নাতক-স্নাতকোত্তর করা বিষয়ভিত্তিক নিবন্ধিত প্রকৃত মেধাবীদের এন্ট্রিলেভেল বয়স বিবেচনা করতে হবে।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও স্বেচ্ছাচারিতায় একেক সময় একেক প্রজ্ঞাপন দ্বারা বৈষম্যের শিকার (প্রথম থেকে পঞ্চম) গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনকৃত (ওয়েবসাইটে নিবন্ধিত সনদধারীর সংখ্যা ৬ লক্ষাধিক হলেও চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে স্কুল-কলেজ মিলে আবেদন মাত্র ৮১ হাজার, কারণ একেকজনের গড়ে চার থেকে পাঁচটি করে সনদ রয়েছে। এর মধ্যে অনেকেই নিয়োগ প্রাপ্তহলেও অর্জিত অন্যান্য সনদ বিদ্যমান রয়েছে। প্যানেল প্রত্যাশী নিবন্ধিত শিক্ষক সংগঠনের আয়োজনে নিয়োগ বঞ্চিতদের সংখ্যা প্রায় ২১ হাজার, বর্তমানে শূন্যপদ রয়েছে ৯৭ হাজার) নিয়োগ বঞ্চিতদের এসব শূন্যপদে আত্মনিয়োগের সুযোগ প্রদান করে বৈষম্যমুক্ত শিক্ষা ও জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষাব্যবস্থা কলঙ্কমুক্ত করতে হবে।