নিজস্ব প্রতিবেদক: স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে অগ্রযাত্রার গর্ব নিয়েই বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে জাতির সূর্যসন্তানদের স্মরণ করল সর্বস্তরের মানুষ। গতকাল সকাল থেকে ফুল আর ব্যানার হাতে মানুষের ঢল নামে মিরপুরের শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে। শোক আর শ্রদ্ধায় জাতি স্মরণ করে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রান্তে নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার, আল বদর, আল শামস সদস্যরা শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মীসহ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ করতে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসের সকালে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ হাজির হন বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মী এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। সেই সঙ্গে এই অগ্রযাত্রাকে আরও অর্থবহ করতে দুর্নীতি, অনিয়ম প্রতিরোধ করে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার জন্য নীতি নির্ধারকদের তাগিদ দেন।
কবি মাহিদুল ইসলাম মাহি বলেন, ‘যে আকাক্সক্ষা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের আত্মোৎসর্গ করেছেন, সেই জায়গায় বাংলাদেশকে পৌঁছাতে হবে। ৫০ বছরে আমাদের অনেক সাফল্য আছে, কিন্তু অনেক ধরনের সমস্যা আছে, যেগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে। তা না হলে সত্যিকারের বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধা জানানো হবে না। আমাদের দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে, অর্থ আত্মসাতের ঘটনাগুলো যেন না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অর্থ আত্মসাৎ হয়ে গেলে আমাদের দেশ তো পিছিয়ে পড়বে।’
অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়ার কারণে দেশ আরও অনিয়মের চক্রে ঢুকে পড়ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। কিছু মানুষ যখন দুর্নীতি করে পার পেয়ে যায়, তখন অন্য মানুষ সেদিকে প্রলুব্ধ হয়। সে জায়গাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে রাষ্ট্র আরও এগিয়ে যেতে পারবে। … আগামী প্রজন্ম যদি দুর্নীতিবাজদের আস্ফালন দেখে, তখন কিন্তু তারা দেশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে না।
দুর্নীতিমুক্ত ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ দেখার আশার কথা বললেন ছড়াকার, লেখক আসলাম সানীও। তিনি বলেন, ‘শোষিত মানুষের মুক্তি দেখতে চাই। ধনী ধনীই হবে, গরিব গরিবই হবে, তা যেন না হয়। ফাপা কোনো অগ্রগতি নয়, আমি নজরুলের বাঙালি থাকতে চাই, রবীন্দ্রনাথের বাঙালি থাকতে চাই। আমাদের শহিদরা, আমাদের বুদ্ধিজীবীরা যে কারণে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে, সেটা যেন অক্ষুণœ থাকে। আমরা যেন মনে-প্রাণে বাঙালি থাকতে পারি সেটা লালন করতে হবে আমাদের।’
শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে আসা ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন আহমেদ বললেন, ‘আমরা দুর্নীতিমুক্ত একটা দেশ চেয়েছিলাম। কিন্তু সে স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে। কিছু সেক্টরে অনেক বেশি দুর্নীতি হচ্ছে। সাধারণ মানুষ ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ সঠিকভাবে করাতে পারছে না। আমরা ছোটো-খাট একটা ব্যবসা করতে গেলে চাঁদা দিতে হচ্ছে। যখন ঘুষ নিয়ে একটা চাকরি নিতে হচ্ছে, তখন সেখানেও ঘুষ খেতে হচ্ছে। এই কালচার রয়েই যাচ্ছে। এই ঘুষের কারণে প্রকৃত মেধাবীরা চাকরি পায় না। ফলে তারা বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। এটা থেকে উত্তরণ খুব জরুরি।’
শিক্ষিক তারিন ইকরাম তার দুই সন্তানকে নিয়ে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ আর শহিদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তাদের জানাতে, তাদের স্মৃতিতে এ দিনের ইতিহাস পোক্ত করে দিতে। তিনি বলেন, ‘সবদিক দিয়ে দেশটা এগিয়ে যাক সেটাই চাই, সেটা অর্থনৈতিক হোক, রাজনৈতিক হোক। চাই সৎভাবে দেশ এগিয়ে যাক। অসমতা, নির্যাতন, সহিংসতামুক্ত বাংলাদেশ চাই।’
শহিদ মিনার উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফারজানা ইসলাম দেশকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে দেখতে চায়। সে বলল, ‘নারী-পুরুষ কারোই নিরাপত্তা নাই। … আমরা নিরাপত্তা চাই। নারীরা নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারছে না। এ দিকগুলোতে নজর দেয়া দরকার।’
মিরপুরের শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ঘুরে ঘুরে পতাকা বিক্রি করছিলেন জাহাঙ্গীর আলম নামে একজন। আক্ষেপ করে তিনি বললেন, ‘দেশের অনেক উন্নয়ন হইছে, কিন্তু আমাগো তো এখনও খাওনের কষ্ট রইয়া গেছে। আমাদের মতো গরিবরা তো গরিবই আছি। বড়লোকরা ঠিকই বড়লোক হইছে। বড়লোকরা কত কত টাকা মাইরা খায়, আর আমরা দুইটা ট্যাকা বেশি চাইলেই কত কথা শুনতে হয়। সবকিছুর দাম বাড়ছে, আমাদের তো ইনকাম বাড়ে নাই।’

বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে আসা মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির রুমাইসা জান্নাত জানালো, সরকার শিশুদের অধিকার রক্ষায় বিশেষ নজর দেবে, সেটাই সে চায়। আমি আমার দেশকে সবচেয়ে উঁচুতে দেখতে চাই। শিশুদের নিরাপত্তার দিকটা দেখতে হবে। শিশুশ্রম এখনও রয়ে গেছে। সেটা যেন না থাকে, সেজন্য কাজ করতে হবে।
প্রতিবছর সন্তানদের নিয়ে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন শিউলি আক্তার, এবারও এসেছেন। তিনি বলেন, ‘আসলে দেশের অনেক উন্নয়ন হয়েছে, অবকাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে। তবে আমাদের যে দিকটায় জোর দিতে হবে, সেটা হচ্ছে তারা প্রকৃত শিক্ষাটা পাচ্ছে কি না। তাদের সততা ও নিষ্ঠা শেখাতে হবে। প্রকৃত মূল্যবোধে গড়ে তুলতে হবে। দেশের সঠিক ইতিহাস তাদের জানাতে হবে। তারা যেন ভুল কিছু না শেখে, ভুল কিছু না জানে সেটা আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে।’