বৈষম্য রুখতে ভূমি ও বাজার ব্যবস্থায় সংস্কার দরকার

 

নিজস্ব প্রতিবেদক: দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় সামাজিক বৈষম্য বেড়েই চলেছে। এ বৈষম্যের পেছনে বেশকিছু সাধারণ কারণ বিদ্যমান। এসব কারণের মধ্যে সম্পদের প্রাপ্যতায় চরম মাত্রায় অসমতা, বাজার ব্যবস্থায় বৈষম্য ও মানব উন্নয়নে সুযোগের অসমতা অন্যতম। এসব থেকে বের হতে হলে নাগরিক কমিশন গঠন জরুরি।

রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে গতকাল নিজের লেখা ‘চ্যালেঞ্জিং ইনজাস্টিস ইন সাউথ এশিয়া: এ ওয়ার্ক প্রোগ্রাম ফর প্রমোটিং ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থের মোড়ক উšে§াচন ও সংলাপ অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। সরকারের আর্থিক নীতি অনেক ক্ষেত্রে দারিদ্র্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এসব বিষয় থেকে উত্তরণে তিনি কৃষি, বাজার ব্যবস্থা, শিক্ষার প্রাপ্যতা, আর্থিক নীতি ও সম্পত্তির মালিকানা ব্যবস্থায় সংস্কারের ওপর জোর দেন। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় চার বছর গবেষণার পর গ্রন্থটি রচিত হয়েছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। বক্তব্য রাখেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।

বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য গবেষণাগ্রন্থে ছয় ধরনের পরামর্শ তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম পরামর্শ কৃষি খাতে ব্যাপক সংস্কার। এ সংস্কারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে ভূমি প্রশাসনের সংস্কার, ভূমিহীন কৃষকদের চিহ্নিত করে তাদের মাঝে খাসজমির সুষ্ঠু পুনর্বণ্টন এবং দেশের বিদ্যমান কৃষি ব্যবস্থার সংস্কারে একটি জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করা। দ্বিতীয় পরামর্শ হলো বাজার ব্যবস্থায় দরিদ্র কৃষি উৎপাদক শ্রেণির অংশগ্রহণ বাড়ানো, যা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পেতে সহায়তা করবে। এক্ষেত্রে তিনি ভারতের আনন্দ মিল্ক ইউনিয়নের আদলে দেশব্যাপী দুগ্ধ খামার ব্যবস্থা প্রবর্তনের পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে তিনি কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থা পুনর্গঠনের প্রস্তাব দেন।

তৃতীয় পরামর্শ শিক্ষা ব্যবস্থার সুযোগের গণতন্ত্রায়ন। এক্ষেত্রে নি¤œআয়ের পরিবারের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার সুযোগ বাড়ানোর জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় একটি জাতীয় কমিশন গঠন করতে হবে। রোধ করতে হবে নিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থ লেনদেন ও প্রশ্ন ফাঁসের মতো বিষয়। আর ক্যাডেট কলেজ ও এলিট শ্রেণির বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য আসন সংরক্ষণ করতে হবে। আর সর্বজনীন আইটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

চতুর্থ সুপারিশ হলোÑবাজেটীয় নীতির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। এ প্রক্রিয়ায় আয়বৈষম্য দূর করতে হবে। পঞ্চমত, দারিদ্র্য দূরীকরণে আর্থিক নীতি গ্রহণ করতে হবে। এ নীতির আওতায় নি¤œআয়ের উদ্যোক্তাদের জন্য স্বতন্ত্র মিউচুয়াল ফান্ড গঠন করতে হবে। তৈরি পোশাক কারখানায় ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় শ্রমিকদের মালিকানার অংশিদারিত্ব দিতে হবে। আর সর্বশেষ যে সুপারিশ দেওয়া হয়েছে তা হলোÑসমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মাঝে সম্পদের মালিকানা বিস্তৃত করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ তার বক্তব্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে দেশে তিন কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। কিন্তু আরও তিন কোটি মানুষ রয়েছে যাদের আয় দারিদ্র্যসীমার সামান্য ওপরে। প্রতিবছর বাজেট এলেই কর কাঠামো নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়। আমরা মুদ্রানীতিতে মুদ্রা সরবরাহ কমানো-বাড়ানো নিয়ে কথা বলি, কিন্তু মাইক্রো বা প্রান্তিক পর্যায়ের উন্নয়নে তেমন কিছুই বলি না। ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতারা সময়মতো ঋণ পান না, তাদের হয়রানি করা হয়। তিনি বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য ব্যাংকগুলোর মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্তিশালী করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

সংলাপে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ভিশন নিয়ে গোলমাল হয়ে গেছে। সরকারের ভিশন-২০২১, ভিশন-২০৩১, ভিশন-২০৪১ রয়েছে, কিন্তু ভিশন-৭১ গেল কোথায়। তিনি বলেন, কেন মুক্তিযুদ্ধের চার নীতি ভিশন-৭১ বাস্তবায়ন করা হলো না। কমিউনিস্টরা সংস্কারের বিপক্ষে নয়, কিন্তু সংস্কারবাদের বিপক্ষে। আমাদের ৭১-এর ভিশনে ফিরে যেতে হবে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেদিন এক মন্ত্রী বললেন, চালের দাম স্বাভাবিক। আরেক মন্ত্রী বললেন, চালের দাম ৪০ টাকার নিচে নামা ঠিক হবে না। তিনি বলেন, এই দাম কৃষকরা পাচ্ছে না, মধ্যস্বত্বভোগীরা নিয়ে যাচ্ছে। ভূমি সংস্কারের পাশাপাশি ভূমির মালিকানা প্রকৃত কৃষকদের দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়েরে ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমেদ বলেন, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাই সমাজে অসমতা তৈরি করছে। শুধু সরকারি নয়, বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কারের তাগিদ দেন তিনি।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বেসরকারি খাতে দীর্ঘ সময়ের জন্য যে কর অবকাশ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো নিয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া সরকারের দেওয়া রফতানি খাতে নগদ সহায়তার বিষয়গুলোও পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। বাজেটে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ভালো কাজের জন্য পুরস্কার ও মন্দ কাজের জন্য শাস্তির বিধান রাখা প্রয়োজন। তার মধ্যে সব ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রামকেন্দ্রিক হওয়া প্রয়োজন।

গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, দেশে সুষ্ঠু গণতন্ত্র এবং সুশাসন না থাকলে কিছুই হবে না। শনিবার বিএনপির কালো পতাকা মিছিলে পুলিশি বাধার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার যা করেছে সেটির প্রয়োজন ছিল না। সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থার পাশাপাশি বিচারকদের সৎ সাহস থাকা প্রয়োজন। পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের আমলাদের দিয়ে প্রশ্ন ফাঁসের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অর্থাৎ যারা প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত তাদের দিয়েই তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো। যেসব শিক্ষার্থীর শস্তি দেওয়া হচ্ছেÑআমি মনে করি তাদের পুরস্কৃত করা প্রয়োজন, কেননা তারা মেধা দিয়ে এই কাজটি করেছে। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর মতো তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের জন্য রেশন ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। এতে করে তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়বে।

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন সিপিডির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামান ও খুশি কবির, সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ফামিদা খাতুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান প্রমুখ।

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০