বোর্ডের সঙ্গে দ্বন্দ্ব নাকি নিরাপদ প্রস্থান!

রোহান রাজিব: ব্যাংক ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ পদ হচ্ছে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। সব ব্যাংকারের স্বপ্ন থাকে এমডি হওয়ার। তবে সম্প্রতি সময়ে এমডি পদ থেকে হঠাৎ পদত্যাগের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। গত দেড় মাসেই তিনটি ব্যাংকের এমডি পদত্যাগ করেছেন। সবাই ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন।

যদিও এমডিদের পদত্যাগের কারণ নিয়ে রয়েছে নানা গুঞ্জন। তারা শুধুই কি ব্যক্তিগত কারণে নাকি বোর্ডের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে পদত্যাগ করছেন এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। তবে বোর্ডের সঙ্গে দ্বন্দ্বে বা চাপেই এমডিরা পদত্যাগ করেছেন বলে ব্যাংকগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

জানা যায়, গত ২৬ জুলাই ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আরিফ বিল্লাহ আদিল চৌধুরী পদত্যাগ করেছেন। এমডি হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার মাত্র আট মাসের মাথায় তিনি এই পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। একটি ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনকে কেন্দ্র করে তিনি পদত্যাগপত্র জমা দেন বলে ব্যাংকটির একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

এ ঘটনার এক মাস পর আরও দুটি ব্যাংকের এমডি পদত্যাগ করেন। গত সপ্তাহে পদত্যাগ করেন পদ্মা ব্যাংকের এমডি তারেক রিয়াজ খান। গত বছরের মার্চে তারেক রিয়াজ খান তিন বছরের জন্য পদ্মা ব্যাংকে এমডি হিসেবে যোগ দেন। ফলে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত তার মেয়াদ ছিল। দেড় বছরের বেশি মেয়াদ থাকতেই পদত্যাগ করলেন তিনি।

এদিকে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের এমডি হাবিবুর রহমান পদত্যাগ করেছেন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। তবে ব্যাংকটির জনসংযোগ বিভাগ থেকে জানানো হয়, তা সত্য নয়।

এর আগে চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংকের এমডি পদ থেকে পদত্যাগ করেন মো. মেহমুদ হোসেন। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে তিনি আবার ন্যাশনাল ব্যাংকে ফেরেন। ফলে চলতি বছর তিনজন এমডি পদত্যাগ করলেন। এত কম সময়ে এতজন এমডির পদত্যাগ আগে হয়নি। তাই এসব বিষয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। এসব এমডি ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করলেও পরিচালকদের চাপেই তারা পদ ছাড়তে বাধ্য হন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ব্যাংক খাতের বিশ্লেষকরা মনে করেন, এমডিরা পদত্যাগে ব্যক্তিগত কারণ দেখালেও তা সঠিক নয়। অধিকাংশ সময়ই বোর্ডের চাপে পদত্যাগ করেন তারা। কারণ বোর্ড পরিচালকদের অনেক অনৈতিক চাহিদা থাকে, যা এমডিরা দিতে না চাইলে তখন তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। তাই বলা যায় এক প্রকার চাপে পড়েই এমডিরা পদত্যাগ করেন। এভাবে এমডিদের পদত্যাগ ব্যাংক খাতের জন্য ভালো খবর নয়। বর্তমানে ব্যাংক খাতে অস্থিরতা বিরাজমান করছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, চাপে পড়েই এমডিরা পদত্যাগ করতে পারেন। অথবা পরিচালকদের সঙ্গে তাদের মিলছে নাÑএমনটিও হতে পারে। আবার কাজের ভালো পরিবেশ না থাকার কারণেও হতে পারে। অপরদিকে এমডিরা যে ধরনের কাজ করতে চাচ্ছেন, তা পরিচালকদের পছন্দ হচ্ছে নাÑএমনটিও ঘটে অনেক সময়। আবার ব্যাংকের অবস্থা উন্নতি হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে নানা রকম চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। ভবিষ্যতে অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে। এমন পরিস্থিতি দেখেও পদত্যাগ করতে পারেন তারা।

তিনি আরও বলেন, ‘যথাযথ কারণ ছাড়া এমডিদের পদত্যাগ ব্যাংক খাতের জন্য ভালো বার্তা নয়। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও কঠোরভাবে বিষয়টি দেখা উচিত। কেন পদত্যাগ করতে চান, কোনো পক্ষের চাপ আছে কিনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে এসব ব্যাখ্যা চাওয়া উচিত।’

এর আগেও ব্যাংকের এমডিদের পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে। ২০২১ সালের নভেম্বরে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শাহ সৈয়দ আবদুল বারী পদত্যাগ করেন। ২০২০ সালে প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাহেল আহমেদও পদত্যাগ করেন। ২০১৭ সালের নভেম্বরে মেঘনা ব্যাংক থেকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ নূরুল আমিন পদত্যাগ করেন। একই বছর ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল মোহাম্মদ আবদুল মান্নানকে।

এ ছাড়া বেসরকারি খাতের সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিকুল ইসলাম চৌধুরী ও মো. গোলাম ফারুক মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পদত্যাগ করেন। ২০২০ সালের তারিকুল ইসলাম চৌধুরী ও ২০১৭ সালে মো. গোলাম ফারুক।

জানতে চাইলে বেসরকারি ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক এমডি ফারুক মঈনউদ্দীন শেয়ার বিজকে বলেন, ব্যক্তিগত কারণে এতগুলো এমডির পদত্যাগ সঠিক নয়। বোর্ডের সঙ্গে এমডিদের মিলছে না। অথবা কোনো বোর্ড এমডিকে পছন্দ করছে না। আবার অনেক সময় বোর্ড অনৈতিক কিছু করতে চায়, যা করলে পরবর্তীতে এমডি বিপদে পড়তে পারে। তাই ঝুঁকি বিবেচনা নিয়ে পদত্যাগ করতে পারেন।

তিনি আরও বলেন, এভাবে একের পর এক এমডির পদত্যাগ বিষয়টি স্বস্তিদায়ক নয়। এর ফলে বুঝা যায় এমডিরা স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না বলে নানা কারণে পদত্যাগ করছেন।

এদিকে এমডিদের পদত্যাগ এড়াতে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেন। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কোনো এমডি স্বেচ্ছায় পদ ছাড়তে চাইলে এক মাস আগে পদত্যাগের কারণ জানিয়ে নিজ ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া কারও চুক্তি বাতিল বা কাউকে পদত্যাগে বাধ্য করা যাবে না।

যদিও এ সুরক্ষা আইন শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। কারণ ওই সুরক্ষা আইনের পরও একাধিক এমডিকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। এসব ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকর নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি, তখনও কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীরব ভূমিকায় ছিলেন।

সম্প্রতি এমডি পদত্যাগের ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, তিনটি ব্যাংকের এমডি পদত্যাগ করলেও কেউ বাংলাদেশ ব্যাংকে এক মাস আগে জানায়নি। ব্যাংক জানানোর পরেই আমরা জানতে পারি।

এদিকে পদত্যাগ করা এমডিদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর অংশ হিসেবে গতকাল সোমবার সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক (এসবিএসি) হাবিবুর রহমান ও পদ্মা ব্যাংকের এমডি তারেক রিয়াজ খানের সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনা করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার ও ডেপুটি গভর্নর আবু ফরাহ মো. নাছের।

বিষয়টি নিশ্চিত করে তারেক রিয়াজ খান শেয়ার বিজকে বলেন, স্ত্রী অসুস্থ থাকায় তার পক্ষে ব্যাংককে সময় দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। প্রায় সময় ভারতে যেতে হয়। তাই এমডির দায়িত্ব থেকে সেটা সম্ভব হচ্ছে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, বর্তমান আর্থিক সংকটের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে চাইছে না, নতুন করে কোনো ব্যাংকে সংকট তৈরি হোক। এছাড়া ব্যাংকের এমডিরা যাতে পেশাদারিত্বের সঙ্গে ব্যাংক পরিচালনা করতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০