বোর্ড ও ম্যানেজারস

মিজানুর রহমান শেলী: বিনিয়োগী কোম্পানির সিইওদের কর্মনৈপুণ্য আমার খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছি। দেখা গেছে তাদের অনেক সিইও’র মধ্যে স্পষ্ট বৈপরীত্য। সৌভাগ্যক্রমে আমরা এটা খুব নিরাপদ দূরত্বে থেকে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। কিছু কিছু সময় দেখা গেছে এসব সিইও স্পষ্টভাবে কাজে বহাল নেই। কিন্তু তাদের পদ-পদবি রয়েছে বহাল তবিয়তে। ব্যবসায় ব্যবস্থাপনার সর্বোচ্চ দণ্ড ক্ষমতা হলো একজন অযোগ্য সিইও’র পক্ষেও তার চাকরি ধরে রাখাটা অনেক সহজ ব্যাপার,; কিন্তু তার অধস্তনদের জন্য অতটা সহজ নয়।
মনে করুন, একজন সচিব ভাড়া করে আনা হলো কাজের জন্য, নির্ধারণ হলো তাকে অবশ্যই মিনিটে ৮০ শব্দ লেখার যোগ্যতা থাকতে হবে। কিন্তু দেখা গেল তিনি ৫০টির বেশি শব্দ লিখতে পারেন না। তবে তিনি মুহূর্তের মধ্যে কোনো কথা ছাড়াই তার চাকরি হারাবেন। এ ধরনের চাকরির একটি যৌক্তিক কাঠামো রয়েছে। তাই সহজে কর্মীর কর্মনৈপুণ্য পরিমাপ করা যায়। এ মাপের মধ্যে যদি আপনি না পড়েন, তবে কর্মী হিসেবে আপনি অবশ্যই বহিষ্কার হবেন। একইভাবে ব্যবসায় পণ্য বিক্রির জন্য যেসব নতুন সেলসম্যান নিয়োগ দেওয়া হলো, তারা আশানুরূপ বিক্রি দেখাতে পারল না দ্রুততর সময়ের মধ্যে, তাহলে তাদের বিদায় করে দেওয়া হবে। সেক্ষেত্রে বদলি করা বা শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে অন্য কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো সুযোগই থাকবে না।
অথচ একজন সিইও’র ক্ষেত্রে বিষয়টি একেবারেই ভিন্ন। ধরা যাক একজন সিইও’র কর্মনৈপুণ্য খারাপ। আবার তিনি মাঝেসাঝেই এই মন্দ যোগ্যতাকে প্রমাণ করে থাকেন। তবুও তিনি তার চাকরি ধরে রাখতে সক্ষম হবেন। কেননা, একজন সিইও’র কর্মযোগ্যতার কোনো নির্দিষ্ট কাঠামো থাকে না। কদাচিত সিইও’র সাধারণ কোনো যোগ্যতাকে বিবেচনা করা হয়। তারা যখন কাজ করতে থাকেন, তখন মাঝে মাঝে তাদের কাজে অস্পষ্টতা তৈরি হয়। এ সময় তাদের এই অযোগ্যতাকে সাধারণ কথায় মওকুফ করা হতে পারে অথবা হালকা কিছু কৈফিয়ত চাওয়া হতে পারে। এমনকি এই মন্দ কর্মণৈপুণ্য যদি প্রকট হয়ে দাঁড়ায় এবং বারবার ঘটতে থাকে, তবুও এটাই ঘটে। আশ্চর্য হতে হয়, অনেক অনেক কোম্পানির বস তাদের ব্যবস্থাপনা কর্মকৌশলের তীর ছুঁড়ে দেন, তারপর সেই তীর যেখানেই পড়ে, সেখানেই একটি গবাক্ষ বা ষাঁড়ের চোখ এঁকে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটায়।
তবে কখনও কখনও সিইও’দেও যোগ্যতা মূল্যায়ন করা হয়। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বটে। দেখা যায় সিইও’র যোগ্যতা যাচাই করতে গিয়ে একজন পদাতিক বা নি¤œস্তরের কর্মীর সঙ্গে তার পার্থক্য বা স্বাতন্ত্র্য নির্ণয় করা হয়। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায় ওই কোম্পানিতে একজন সিইও’র ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা থাকেন না। ফলে সিইও তার নিজের যোগ্যতা নিজেই পরিমাপ করেন। আবার একজন সেলস ম্যানেজার যদি এক ঝুড়ি লেবু দ্রুততর সময়ে বিক্রি না করে তার কর্মীবাহিনীর কাছে রেখে দেন, তবে নিজেই সেগুলোকে গরম পানিতে ঢালবেন শিগগিরই। কেননা, তিনি নিজেই এই আপদগুলোকে দূর করতে চান। নইলে তাকেই দূর হয়ে যেতে হবে। আবার একজন অফিস ম্যানেজার যদি কিছু অদক্ষ সহকারী নিয়ে আসেন, তবে তিনিও একই আচরণের শিকার হবেন।
আবার সিইও’র বস হলেন একজন বোর্ড অব ডিরেক্টর। তাই তিনি নিজেই সিইও’র যোগ্যতা মূল্যায়ন করে। যদি করপোরেট পারফরমেন্স নিকৃষ্ট মানের হয়, তবে কখনও কখনও তার জবাবদিহিতা করতে হতে পারে। তবে বোর্ড যদি ভুল করে, আবার সে ভুলকে জিইয়ে রাখে, তবে তাতে কী আসে যায়? আবার বোর্ড যদি ভুল করে, আর সে কারণে কোম্পানি যদি অন্য কারও তত্ত্বাবধানে চলে যায়, তবে সবকিছুর লাভের অঙ্ক বাইরে থাকা বোর্ড সদস্যদের ওপর বর্তায়। আসলে নরম লোকেরা পড়ে যান, বড়রা স্থায়ী হন।
সর্বোপরি বোর্ড ও সিইও’র মধ্যকার সম্পর্ক সহজাত হবে বলে আশা করা হয়। বোর্ড সভায় সিইও’র কর্মনৈপুণ্য নিয়ে সমালোচনা করাকে সামাজিক পরিবেশে ঢেকুর তোলার মতো মনে করা হয়। তবে কোনো অফিস ম্যানেজার থেকে শুরু করে নিকৃষ্ট মানের টাইপিস্টদের যোগ্যতা মূল্যায়নে এমন শরম পাওয়ার কিছু থাকে না।
এ বিষয়গুলো সিইওদের প্রতি চোখ বন্ধ করে সন্দেহের তীর ছুঁড়ে দেওয়ার মতো সাধারণ বিশ্লেষণ বা সমালোচনা নয়। বেশিরভাগ সিইও অনেক বেশি পরিশ্রমী ও যোগ্যতাসম্পন্ন। এমনকি অসংখ্য সিইও আছেন যারা অসাধারণ যোগ্যতার অধিকারী। কিন্তু চার্লি ও আমি ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা দেখেছি। সে থেকেই আমরা শিক্ষা গ্রহণ করেছি। ফলে আমাদের তিনটি হোল্ডিংসকে একত্রিত করতে পেরেছি। এ তিনটি হোল্ডিং তাদের ব্যবসাকে ভালোবাসে, তারা মালিকের মতো চিন্তা করে এবং তারা তাদের ঐক্য ও সক্ষমতা দেখাতেও সক্ষম হয়।
আমাদের বার্ষিক সভায় কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, যদি কোনো ট্রাক আপনাকে আঘাত করে, তবে এ জায়গার কী হবে? আমি খুব আনন্দিত তারা এখনও এ প্রশ্ন একইভাবে করে থাকেÑকী হবে এ জায়গার যদি কোনো ট্রাক তোমাকে আঘাত না করে? এ প্রশ্ন উত্থাপন হতে আর বেশিদিন বাকি নেই।
যে কোনো অনুষ্ঠানে এমন প্রশ্ন উত্থাপন হলেই আমার জন্য করপোরেট প্রশাসন নিয়ে আলোচনা করা জরুরি হয়ে পড়ে। এটা ছিল গত বছরের একটি হট টপিক। সাধারণভাবে আমি বিশ্বাস করি, ডিরেক্টররা যখন থেকে তাদের কোমর শক্ত করে দাঁড়িয়েছেন, তখন থেকেই শেয়ারহোল্ডাররা আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ প্রকৃত মালিক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন। এ রকম পরিস্থিতি আগে কখনও ঘটেনি। যাহোক, করপোরেট প্রশাসনের সমালোচকরা খুব কমই জনগণের মধ্যে বণ্টিত শেয়ার কোম্পানির তিনটি মৌলিক পার্থক্যসম্পন্ন ম্যানেজার বা মালিকদের মধ্যে পৃথককরণ করে থাকেন। যদিও ডিরেক্টরদের বিধিবদ্ধ দায়দায়িত্ব একই; তবুও নিজ নিজ যোগ্যতায় তারা একে অন্যের চেয়ে স্বতন্ত্র। সাধারণত প্রথম দেখাতেই দৃষ্টি আটকে যায়। কেননা, এর মাধ্যমে করপোরেট চেহারা উপস্থাপন করে। যেহেতু বার্কশায়ার দ্বিতীয় দশায় অবস্থান করে এবং মাঝে মাঝে তৃতীয় দশায়ও নেমে পড়ে, তাই এ তিনটি দশা নিয়ে আলোচনা করা হবে।
প্রথমটি: এই দশাতে বোর্ডের মধ্যে কোনো নিয়ন্ত্রিত শেয়ারহোল্ডার থাকেন না। এটা অনেক বেশি প্রচলিত। এ কারণে আমি বিশ্বাস করি ডিরেক্টরদের মনে করা উচিত বোর্ডে কিছু অনুপস্থিত মালিক রয়েছেন। তাদের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থগুলো যথাযথ উপায়ে আরও সামনে এগিয়ে নেওয়া উচিত। দুর্ভাগ্যক্রমে ‘দীর্ঘ মেয়াদ’ বিষয়টি ডিরেক্টরদের একটি অস্থির পরিস্থিতিতে ফেলে দিতে পারে। যদি তারা ঐক্যের অভাব বোধ করেন কিংবা স^াধীনভাবে চিন্তা করার অভাব বোধ করেন, তাহলে ডিরেক্টররা শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে চরম হিংস্রতা দেখাতে পারেন; কেননা এ সময় লাগাতার শেয়ারহোল্ডাররা নিজেদের দীর্ঘমেয়াদি মুনাফার দাবি জানাতে থাকে। কিন্তু স্বাভাবিক চোখেই দেখা যায় বোর্ড খুব ভালোভাবেই কাজ করে যাচ্ছে। এরকম সংকটের সময় বোর্ড ব্যবস্থাপনার সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থাপনার কাজে যদি ভালো-মন্দ কোনো মূল্যায়ন করা সম্ভব না হয়, অথবা খারাপই হয় উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবস্থাপনা দলের সঙ্গে বসতে হবে। এরপর ডিরেক্টররা প্রয়োজনে ওই ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন করতে পারেন। কার্যত একজন বিচক্ষণ মালিক এ কাজটিই করবেন। আবার ব্যবস্থাপক যদি হন যোগ্য কিন্তু লোভী, তবে তিনি একটু অতিরিক্ত ‘সফলতা’ বয়ে আনতে পারেন। তিনি নিয়ত শেয়ারহোল্ডারদের পক্ষে উৎখননের চেষ্টা করবেন, এমনকি সুযোগ পেলে তাদের পকেটের গভীর থেকে আরও গভীরে যাবেন। এক্ষেত্রে ডিরেক্টররা অবশ্যই সেসব ম্যানেজারের হাতের ওপর চপেটাঘাত করবেন।

এই দর্শন রচনাবলি সম্পাদনা করেছেন
লরেন্স এ. কানিংহ্যাম
অনুবাদক: গবেষক, শেয়ার বিজ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০