Print Date & Time : 1 July 2025 Tuesday 2:41 pm

ব্যক্তিশ্রেণির আয়করে ছাড় নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেশি এমন অজুহাতে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি। গতকাল জাতীয় সংসদে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ প্রস্তাব করেন। বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা অপরিবর্তিত রাখার ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির করদাতাদের ওপর প্রভাব পড়তে পারে। তবে প্রতিবন্ধী সন্তান রয়েছে, এমন বাবা-মায়ের করমুক্ত আয়সীমা বর্তমানে ২৫ হাজার রয়েছে। তা বৃদ্ধি করে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। এছাড়া বিদ্যমান করহার ও এলাকাভিত্তিক ন্যূনতম করের বিদ্যমান হার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
করমুক্ত আয়সীমা না বাড়ানোর বিষয়ে যুক্তি দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, চলতি অর্থবছর করমুক্ত আয়ের সীমা ছিল দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা। নারী করদাতাসহ বিভিন্ন শ্রেণির করদাতাদের জন্য এ সীমা কিছুটা বেশি ছিল। করমুক্ত আয়ের সীমা কী হবে, তা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। আমরা পর্যালোচনা করে দেখেছি, উন্নত দেশগুলোতে করমুক্ত আয়সীমা সাধারণভাবে মাথাপিছু আয়ের ২৫ শতাংশের নিচে থাকে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে করমুক্ত আয়সামী সাধারণত মাথাপিছু আয়ের সমান বা তার কম থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে করমুক্ত আয়সীমা মাথাপিছু আয়ের প্রায় দ্বিগুণ। আমাদের করমুক্ত আয়সীমা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের তুলনায় অনেক বেশি। করমুক্ত আয়সীমা বেশি হলে কর প্রদানে সক্ষম বিপুল সংখ্যক ব্যক্তি করজালের বাইরে থেকে যায়। এতে করের ভিত্তি দুর্বল থাকে। এসব বিবেচনায় আগামী অর্থবছর করমুক্ত আয়ের সীমা ও করহার অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করছি।
প্রস্তাবে বলা হয়, সাধারণ ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা দুই লাখ ৫০ টাকা। এছাড়া মহিলা ও ৬৫ বছর বয়সের করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা, প্রতিবন্ধী করদাতাদের চার লাখ টাকা, গেজেটেড যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চার লাখ ২৫ হাজার টাকা। আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত কর শূন্য। পরবর্তী চার লাখ টাকা মোট আয়ের ওপর ১০ শতাংশ, পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৫ শতাংশ, ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত ২০ শতাংশ, ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত ২৫ শতাংশ এবং অবশিষ্ট আয়ের ওপর ৩০ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। এছাড়া সিগারেট, বিডি, গুলসহ সব ধরনের তামাকজাত পণ্য প্রস্তুতকারী ব্যবসার আয় থেকে ৪৫ শতাংশ, বাংলাদেশে অনিবাসী ব্যক্তি করদাতাদের আয়ের ওপর ৩০ শতাংশ এবং নিবন্ধিত সমবায় সমিতির অর্জিত আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।
ন্যূনতম করহার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেন, ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য সিটি করপোরেশনের বাইরের অন্যান্য এলাকার কোম্পানি করদাতা ব্যতীত অন্য করদাতাদের যথাক্রমে পাঁচ হাজার, চার হাজার ও তিন হাজার টাকা হারে ন্যূনতম কর দিতে হবে।

দাম কমবে

জীবন রক্ষাকারী ওষুধ: জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম কমিয়ে আনার জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে বিদেশ থেকে আমদানি করা কাঁচামালের শুল্ক কমানো ও কর রেয়াত সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে ওই শিল্পের সক্রিয় কাঁচামাল উৎপাদনে ব্যবহৃত ১১৬টি কাঁচামালের কর রেয়াত সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ক্যানসার নিরোধক ওষুধের দুটি কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান পাঁচ শতাংশ কর প্রত্যাহার করা হয়েছে। এছাড়া ওই শিল্পের কাঁচামালের আমদানি শুল্ক উল্লেখযোগ্য হারে কমানোর প্রস্তাব কমানো হয়েছে। এতে ক্যানসারসহ অন্য জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম কমবে।

গুঁড়ো দুধ: প্রস্তাবিত বাজেটে গুঁড়ো দুধ আমদানির ওপর বিদ্যমান আমদানি শুল্ক কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদ্যমান ২৫ শতাংশের বদলে এখন থেকে গুঁড়ো দুধ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ১০ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক দিতে হবে। এতে গুঁড়ো দুধের দাম কমবে।
হাইব্রিড গাড়ি: পরিবেশ দূষণ ও জ্বালানি খরচ কমিয়ে আনার জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে হাইব্রিড গাড়ির আমদানি উৎসাহিত করা হয়েছে। এজন্য ১৮০০ সিসি পর্যন্ত হাইব্রিড মোটর গাড়ি আমদানি সম্পূরক শুল্ক ৪৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে হাউব্রিড গাড়ির দাম কমতে পারে।

দেশীয় ফ্রিজ-মোটরসাইকেল: দেশে ফ্রিজ ও মোটরসাইকেল উৎপাদনে ব্যবহƒত আমদানি করা যন্ত্রাংশের আমদানি শুল্ক কমানো এবং বিদ্যমান প্রণোদনা প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ফ্রিজের জন্য আমদানি করা সাতটি পণ্যের আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে। আরও কিছু যন্ত্রাংশের আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যদিকে মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা বলবৎ থাকছে। আরও কয়েকটি ক্ষেত্রে শুল্ক কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

দেশি সেলফোন: প্রস্তাবিত বাজেটে সেলুলার ফোন উৎপাদন বা সংযোজনে আগ্রহ বাড়াতে প্রায় ৪০ ধরনের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে এক শতাংশ শুল্ক নির্ধারণের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এতে দেশে উৎপাদিত বা সংযোজিত সেলফোনের দাম কমবে।
কম্পিউটার যন্ত্রপাতি: কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ, সফটওয়্যারসহ ছয় ধরনের পণ্য আমদানিতে বিদ্যমান ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে। সে সঙ্গে বিদ্যমান আমদানি শুল্কও ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে পাঁচ শতাংশ করার প্রস্তাব রয়েছে। এ কারণে কম্পিউটার ও সফটওয়্যারের খরচ কমবে।
বলপয়েন্ট কলম: বলপয়েন্ট কলম উৎপাদনের জন্য বিদেশ থেকে কালি আমদানির জন্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর বিদ্যমান ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে। এতে বলপয়েন্ট কলমের উৎপাদন খরচ ও দাম কমবে।

দাম বাড়বে

রিকন্ডিশন্ড গাড়ি: পুরোনো গাড়ি আমদানি নিরুৎসাহিত করতে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির বিদ্যমান অবচয় সুবিধার পাঁচ শতাংশ কমিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ কারণে আমদানি করা রিকন্ডিশন্ড গাড়ির দাম বাড়বে।

বাইসাইকেল: বাইসাইকেলের ব্রেক ও স্যাডলসহ অনান্য যন্ত্রাংশের আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এতে ওই সব যন্ত্রাংশ আমদানির শুল্ক বাড়লে বাই-সাইকেলের দাম বাড়বে।

এনার্জি ড্রিংক: স্বাস্থ্যঝুঁকির দিক বিবেচনায় এনার্জি ড্রিংকের ব্যবহার কমাতে ওই পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক রয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে ওই সম্পূরক শুল্ক আরও ১০ শতাংশ বাড়িয়ে ৩৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে এনার্জি ড্রিংকের দাম বাড়বে।
প্রসাধনী পণ্য: প্রসাধনী ও ত্বক পরিচর্যায় ব্যবহৃত সামগ্রীর ওপর ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক রয়েছে। ‘বাণিজ্যে সমতা’ আনতে ওই জাতীয় অন্য সামগ্রীর উপরেও ১০ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। সে সঙ্গে শেভের আগে-পরে ব্যবহৃত সামগ্রী, আতর ছাড়া শরীরের দুর্গন্ধ ও ঘাম দূর করতে ব্যবহৃত সামগ্রী এবং সুগন্ধযুক্ত বাথ সল্টসহ সমজাতীয় অন্য পণ্যের ব্যবহার কমাতে ওই পণ্যের সম্পূরক শুল্ক পাঁচ শতাংশ বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে প্রায় সব ধরনের প্রসাধনী পণ্যের দাম বাড়বে।

ব্র্যান্ডের তৈরি পোশাক: দেশীয় নিজস্ব ব্রান্ডের তৈরি পোশাক বিপণনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান চার শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বাড়িয়ে পাঁচ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা ব্রান্ডবিহীন পোশাকের ওপরেও ওই ভ্যাট প্রযোজ্য হবে। এতে দেশের বাজারে তৈরি পোশাকের দাম বাড়বে।

অনলাইন কেনাকাটা: সামাজিক মাধ্যম বা ইন্টারনেটভিত্তিক ‘ভার্চুয়াল বিজনেস’ দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। প্রস্তাবিত বাজেটে অনলাইনে কেনাকাটার ওপর পাঁচ শতাংশ হারে মূসক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে অনলাইন কেনাকাটায় ব্যয় বাড়বে।
বিডি-সিগারেট: বিড়ি ও সিগারেট তৈরিতে ব্যবহৃত কাগজের সম্পূরক শুল্ক পাঁচ শতাংশ বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। কাগজের সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির কারণে বিড়ি ও সিগারেটের দাম বাড়বে।

ছোট ফ্ল্যাট: প্রস্তাবিত বাজেটে এক হাজার ১০০ বর্গফুট পর্যন্ত ফ্ল্যাট কেনার জন্য বর্তমানে দেড় শতাংশ হারে মূসক দিতে হয়। প্রস্তাবিত বাজেটে এক থেকে এক হাজার ৬০০ বর্গফুট ফ্ল্যাটের মূসক দুই শতাংশ নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। তবে এক হাজার ৬০১ বর্গফুটের বড় ফ্ল্যাটের মূসক অপরিবর্তিত থাকছে। সে সঙ্গে পুরাতন ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনে দুই শতাংশ মূসক আরোপের প্রস্তাবও করা হয়েছে। এ কারণে ছোট ফ্ল্যাট কিনতে ক্রেতাদের মূসক বাবদ বাড়তি অর্থ গুনতে হবে।