Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 12:35 am

ব্যক্তি খাতের ঋণে বিনিময় হার ও পণ্যমূল্য বৃদ্ধির খড়্গ

নিজস্ব প্রতিবেদক: মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার ধারাবাহিক অবমূল্যায়ন ও বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের ব্যক্তি খাতের ঋণে। আপাতদৃষ্টিতে ব্যক্তি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়লেও ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার হ্রাস পাওয়ায় প্রকৃত ঋণ প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। বাড়তি পণ্যমূল্যের কারণে ঋণপত্র খুলতে আগের তুলনায় বেশি ডলার প্রয়োজন হচ্ছে। আর বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় ডলার কিনতেও আগের তুলনায় বেশি টাকা গুনতে হচ্ছে। এতে করে দ্বিমুখী সংকটে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।

গতকাল ‘বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের ঋণের ওপর বিনিময় হার এবং বৈশ্বিক পণ্যমূল্যের মূল্যস্ফীতির প্রভাব’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিবেদনে দেখা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণ দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। চলতি বছরের অক্টোবর শেষে ব্যক্তি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ। সেপ্টেম্বর মাসে এ প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। আর দুই মাসে আগে আগস্টে এ প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। ব্যক্তি খাতে ঋণের এই নামিক (নমিনাল) প্রবৃদ্ধি বাড়লেও ডলারের বিপরীতে বিনিময় হার সমন্বয়ের পর (এক্সচেঞ্জ রেট অ্যাডজাস্টমেন্ট গ্রোথ রেট) প্রকৃত প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বিনিময় হার সমন্বয়ের পর অক্টোবরে ব্যক্তি খাতে প্রকৃত ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক আট শতাংশ। আগস্টে প্রকৃত ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৯ শতাংশ।

এদিকে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২২-২৩ অর্থবছরের মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। তাতে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথামার্ধের জন্য বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩ দশমিক ছয় শতাংশ। আর ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দ্বিতীয়ার্ধের জন্য ব্যক্তি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। বিগত ২০২১-২২ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। গত অর্থবছর ব্যক্তি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ওই সময় বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকায় প্রকৃত ঋণ প্রবৃদ্ধি ও নমিনাল ঋণ প্রবৃদ্ধি প্রায় সমান ছিল। কিন্তু গত মে মাসের পর থেকে বিনিময় হার অস্বাভাবিক হতে থাকায় নমিনাল ঋণ প্রবৃদ্ধি ও প্রকৃত ঋণ প্রবৃদ্ধির মধ্যে অমিল দেখা দেয়। এতে করে ব্যবসায়ীরা আগের তুলনায় বেশি অর্থ ব্যয় করে কম সুফল পেতে থাকেন। এর প্রভাব পড়তে থাকে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে। বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি।

একই সঙ্গে অস্বাভাবিক মুদ্রাবাজারের কারণে ব্যাংকগুলোর ব্যালেন্স শিটেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। এতে উল্লেখ করা হয়, সাম্প্রতিক মাসগুলোয় ব্যাংকে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স মিলে যে পরিমাণ ডলার এসেছে, আমদানি ব্যয় বাবদ তার চেয়ে বেশি ডলার ব্যয় করতে হয়েছে। এতে করে ব্যাংকে ডলারের ঘাটতি দেখা দেয়। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে আগের তুলনায় বেশি ডলার ব্যয় করে কম পরিমাণ পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। এর ফলে টাকার অঙ্কে আমদানির পরিমাণ বাড়লেও প্রকৃত পণ্যের আমদানি অনেক কম। এতে করে আমদানিকৃত ওইসব পণ্য দেশের ভোক্তাদের কেনার জন্য অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে, যা ভোক্তার ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। তবে এর বিপরীতে কিছুটা সুবিধা পাচ্ছেন রপ্তানিকারক ও রেমিট্যান্স গ্রহীতারা। কারণ ব্যাংকিং চ্যানেলে তাদের যে ডলার আসছে, তার বিপরীতে তারা এখন আগের তুলনায় বেশি টাকা পাচ্ছেন। তবে সবমিলে দেশের মুদ্রাবাজারে এক ধরনের ঘোলাটে পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলে প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এ ধরনের টালমাটাল পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ টিকিয়ে রাখা ও ব্যাংকগুলোর স্থিতিশীলতা রক্ষা করা চ্যালেঞ্জিং হবে বলে প্রতিবেদনটিতে জানানো হয়।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কভিড সংকট কাটিয়ে যখন অর্থনীতি আবারও প্রবৃদ্ধির গতি পেতে শুরু করে, তখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বড় আঘাত নিয়ে আসে। এর ফলে দেশের বিনিময় হার বাড়তে থাকে, সঙ্গে পণ্যমূল্যের দাম। এর ফলে চোখ রাঙাতে থাকে মূল্যস্ফীতি।