ব্যক্তি খাতের নিম্নমুখী ভোগ ব্যয়ে কমবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি ব্যক্তি খাত। সাধারণত মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৬৮ থেকে ৭০ শতাংশ অবদান রাখে এ খাতের ভোগব্যয়। তবে গত অর্থবছর এ খাতের প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের ধস নামে। করোনাকালীন বছরের চেয়েও কমে গেছে ভোগ ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে চলতি অর্থবছর এ খাতের প্রবৃদ্ধি আরও কমে যেতে পারে বলে প্রক্ষেপণ করেছে বিশ্বব্যাংক। এতে শেষ হতে যাওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার আরও হ্রাস পাবে।

বিশ্বব্যাংকের গত মাসে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, গত অর্থবছর ব্যক্তি খাতের ভোগ ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র এক দশমিক ৯৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছর তা আরও কমে এক দশমিক ৪ শতাংশে নেমে যেতে পারে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। এছাড়া রপ্তানি খাতের নামমাত্র প্রবৃদ্ধি ও আমদানিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিও চলতি অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি হ্রাসে ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, করোনাকালীন বছর অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছর ব্যক্তি খাতের ভোগ ব্যয়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল তিন শতাংশ। যদিও ওই অর্থবছর করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ছিল। ২৬ মার্চ শুরু হওয়া সাধারণ ছুটি চলে জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে সব প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা খোলার অনুমতি দেয়া হলেও অর্থনৈতিক কার্যক্রম চলে সীমিত আকারে।

করোনা নিয়ন্ত্রণে পরের এক বছর পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধ ছিল। এরপরও ২০২০-২১ অর্থবছর ব্যক্তি খাতের ভোগ ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়ায় আট শতাংশ। আর ২০২১-২২ অর্থবছর অর্থনৈতিক কার্যক্রম পুরোপুরি স্বাভাবিক থাকায় ব্যক্তি খাতের ভোগ ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল সাড়ে সাত শতাংশ। এ হিসাবে আগের দুই অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে ভোগ ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি চার ভাগের এক ভাগে নেমেছে। তবে চলতি অর্থবছর তা আরও কমে যেতে পারে।

এর মূল কারণ কী হতে পারেÑজানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, মূল্যস্ফীতি যে হারে বাড়ছে তাতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। মূলত এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে ব্যক্তি খাতের ভোগ ব্যয়ে। আয় যে হারে বাড়ছে, জিনিসপত্রের দাম তার চেয়ে অনেক বেশি হারে বাড়ছে। আয় ও মূল্যস্ফীতির মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য নেই। এতে মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে; যা ব্যক্তি খাতের ভোগ ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি হ্রাসের অন্যতম কারণ।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে আয়ের তথ্য সেভাবে প্রকাশ করা হয় না। তবে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে শ্রমশক্তি জরিপের যে ফলাফল প্রকাশ করা হয় তাতে দেখা যায়, ডিসেম্বরের তুলনায় মার্চে বেকারত্ব কিছুটা বেড়েছে। আর কর্মসংস্থান যেসব খাতে হচ্ছে, তা মূলত কম আয়নির্ভর। উচ্চ আয়ের খাত তথা শিল্পে নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে খুবই কম। মূলত কৃষিতে নতুন কর্মসংস্থান বেশি হয়েছে। তবে এ খাতে আয়ের পরিমাণ তুলনামূলক কম। এটিও ভোগ ব্যয়ে প্রভাব ফেলছে।

বিবিএসের তথ্যমতে, গত অর্থবছর ব্যক্তি খাতের ভোগ ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি কম হলেও সরকারি খাতে ভোগ ব্যয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে; যার হার ছিল সাড়ে আট শতাংশ। এর আগের অর্থবছর সরকারি ভোগ ব্যয়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ছয় দশমিক ২ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছর ছয় দশমিক ৯ শতাংশ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছর প্রায় দুই শতাংশ। করোনা সংক্রমণ শুরুর পর ওই অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। মূলত এর প্রভাব পড়েছিল ২০১৯-২০ অর্থবছরের সরকারি ভোগ ব্যয়ে।

এদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছর বিনিয়োগ ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়ায় মাত্র দুই দশমিক ২ শতাংশ, যা করোনাকালীন বছরের চেয়ে কম। ২০১৯-২০ অর্থবছর বিনিয়োগ ব্যয়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় চার শতাংশ। আর ২০২০-২১ অর্থবছর বিনিয়োগ ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি হয় আট দশমিক ১ শতাংশ ও ২০২১-২২ অর্থবছর ১১ দশমিক ৭ শতাংশ। ডলার সংকটে আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপকেই গত অর্থবছর বিনিয়োগে নিম্নমুখী প্রবৃদ্ধির মূল কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

যদিও চলতি অর্থবছর বিনিয়োগ খাত সে ধাক্কা সামলে কিছুটা ঘুরে দাঁড়াবে বলে প্রাক্কলন করেছে বিশ্বব্যাংক। প্রতিবেদনে দেখা হয়েছে, শেষ হতে যাওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছর বিনিয়োগ ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি হতে পারে পাঁচ দশমিক ৬ তাংশ। একইভাবে চলতি অর্থবছর সরকারি খাতের ভোগ্যব্যয়ও বাড়বে বলেই প্রাক্কলন করেছে উন্নয়ন সহযোগী এ সংস্থাটি। গত অর্থবছরের চেয়ে তা আরও বেড়ে চলতি অর্থবছর ১০ দশমিক ৬ শতাংশ দাঁড়াবে বলে দেখানো হয়েছে প্রতিবেদনে।

অন্যদিকে গত অর্থবছর পণ্য ও সেবা আমদানিতে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি ছিল। যদিও এর আগের অর্থবছর (২০২১-২২) আমদানিতে রেকর্ড ৩১ দশমিক ২ শতাংশ ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়। আর ২০২০-২১ অর্থবছর আমদানি প্রবৃদ্ধি  ছিল ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে করোনা সংক্রমণের প্রভাবে ২০১৯-২০ অর্থবছর আমদানি প্রবৃদ্ধিতে ধস নেমেছিল। ওই অর্থবছর ১১ দশমিক ৪ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয় আমদানিতে।

২০১৯-২০ অর্থবছর রপ্তানিতেও ধস নেমেছিল। করোনার কারণে চলা বিশ্বব্যাপী লকডাউন ও আমদানিতে বিভিন্ন দেশের বিধিনিষেধ আরোপের কারণে ওই অর্থবছর রপ্তানি কমেছিল সাড়ে ১৭ শতাংশ। করোনার প্রকোপ কমতে থাকায় ২০২০-২১ অর্থবছর রপ্তানিতে ৯ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। ২০২১-২২ অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় রেকর্ড ২৯ দশমিক ৪ শতাংশ। তবে গত অর্থবছর ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী মন্দার কারণে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়ায় আট শতাংশ।

এদিকে চলতি অর্থবছর আমদানি ও রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে আরও বড় ধরনের মন্দাভাব নেমেছে বলেই দেখিয়ে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি প্রাক্কলন করেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়াবে মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ। অর্থাৎ রপ্তানিতে নামমাত্র প্রবৃদ্ধি হবে। আর আমদানি প্রবৃদ্ধি আরও খারাপ হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে, যা দাঁড়াবে ১২ দশমিক ২ শতাংশ ঋণাত্মক। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার এ পর্যন্ত প্রকাশিত তথ্যে সে প্রবণতাই দেখা যাচ্ছে।

সার্বিকভাবে গত অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমে দাঁড়ায় প্রায় পাঁচ দশমিক ৮ শতাংশ, যা করোনাকালীন বছর বাদ দিলে ১৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। করোনার কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় সাড়ে তিন শতাংশ। এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছর ছয় দশমিক ৯ শতাংশ ও ২০২১-২২ অর্থবছর সাত দশমিক ১ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। তবে চলতি অর্থবছর প্রবৃদ্ধির হার আরও কমে পাঁচ দশমিক ৬ শতাংশ দাঁড়াবে বলে প্রাক্কলন করেছে বিশ্বব্যাংক।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০