Print Date & Time : 24 June 2025 Tuesday 4:08 am

ব্যক্তি খাতের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই বারবার লকডাউন!

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের অর্থনীতির প্রায় ৮২ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে বেসরকারি খাত। আর সরকারি খাতের নিয়ন্ত্রণে বাকি ১৮ শতাংশ। কাজেই বেসরকারি খাতের কার্যক্রম যদি পুরোপুরি বন্ধ রাখা হয়, তাহলে অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু কভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে বাঁচতে লকডাউনের মতো উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা ছাড়া উপায় থাকে না। তবে লকডাউন বা কঠোর বিধিনিষেধ সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে একটি সঠিক পরিকল্পনা প্রয়োজন।

আর সেসব পরিকল্পনা প্রণয়ন বা লকডাউনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। কিন্তু বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনা না করেই বিভিন্ন সময় বিক্ষিপ্তভাবে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে, যা করোনা রোধে ফলদায়ক হয়নি বলে মনে করছেন ব্যক্তি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। সম্পূর্ণরূপে আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে লকডাউন ঘোষণা করা হচ্ছে বলে ব্যক্তি খাতের অভিযোগ।

করোনায় ক্ষতির মুখে বিশ্ব অর্থনীতি। করোনা নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিধিনিষেধ, লকডাউন এমনকি সান্ধ্য আইনও জারি করেছে। তবে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে নাগরিকদের টিকা দেয়া, কলকারখানা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে কঠোর পদক্ষেপ নেয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। ফলে অনেক দেশে করোনা নিয়ন্ত্রণে। বাংলাদেশে গত বছরের মার্চে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এরপর দেয়া হয় লকডাউন। সাময়িক বন্ধ থাকে কলকারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। লকডাউন শিথিল করে কলকারখানা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ধাপে ধাপে খুলে দেয়া হয়। তবে সব নাগরিকের টিকা নিশ্চিত না হওয়ায় সংক্রমণ বাড়ছে।

ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আবারও সরকার বিধিনিষেধ জারি করে। যাতে জরুরি সেবার আওতায় থাকা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। তবে বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অধিকাংশ কলকারখানা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়। বিধিনিষেধ আরোপের আগে কোন খাত খোলা রাখতে হবে, কোন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে এসব বিষয়ে সরকার ব্যবসায়ী সংগঠনের সঙ্গে বেশিরভাগ সময় আলোচনা করে না বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে। যার ফলে বিধিনিষেধ জারির পর ব্যবসায়ীরা কলকারখানা চালু রাখার দাবি জানান। পরে সরকার কিছু খাতকে বিধিনিষেধের আওতার বাইরে রেখে আবার প্রজ্ঞাপন জারি করে।

লকডাউনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এসএমই খাত। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এ খাতের বিশাল অবদান রয়েছে। পরিকল্পনামাফিক লকডাউন না দিয়ে বিভিন্ন সময়ে হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নেয়ায় এ খাতের অনেক ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের অনেকে অনুযোগ করে বলেছেন, লকডাউন ঘোষণার ক্ষেত্রে সরকারি চাকরিজীবীদের অতি উৎসাহ দেখা যায়। কারণ তাদের তো চাকরি স্থায়ী। আর লকডাউন চললেও সরকার বসিয়ে বসিয়ে তাদের বেতন ঠিকই পরিশোধ করবে। ফলে তারা সবসময় সুবিধাজনক অবস্থানে থাকেন এবং লকডাউনের পক্ষে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও জনমত গঠনে ভূমিকা রাখেন। কিন্তু লকডাউনে দেশের আপামর জনগোষ্ঠী কীভাবে দিনাতিপাত করবেÑসে বিষয়ে সরকারের আমলারা মোটেও চিন্তা-ভাবনা করেন না।

এ বিষয়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ইয়াসমিন বলেন, সরকারি চাকরিজীবীদের আয়ের নিশ্চয়তা রয়েছে। সে কারণে তারা সবসময় লকডাউনের পক্ষে কথা বলেন। আমরাও লকডাউনের বিপক্ষে নই। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা ছাড়াই হঠকারীভাবে একের পর এক লকডাউন ঘোষণা করার কারণে দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। 

অন্যদিকে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে লকডাউন বা বিধিনিষেধ আরোপের সুপারিশ করে ‘কভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি’। তাদের সুপারিশ অনুযায়ী সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করে। তবে অনেক সময় তাদের সুপারিশকে গ্রহণ করা হয় না বলে কমিটির একাধিক সদস্য মত দিয়েছেন। সর্বশেষ ১৫ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত বিধিনিষেধ শিথিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। শিথিলতার এ নির্দেশনায় কারিগরি পরামর্শক সায় ছিল না। তারা বলছেন, সরকারের শিথিল বিধিনিষেধের এ ঘোষণা তাদের পরামর্শের উল্টো চিত্র। এ সময় এ ধরনের শিথিলতা বিধিনিষেধ তুলে নেয়ারই শামিল। কমিটির সুপারিশ উপেক্ষা করে বিধিনিষেধ শিথিল করায় ‘হতভম্ব’ কমিটির সদস্যরা। এর ফলে সংক্রমণ কয়েকগুণ বাড়বে বলে আশঙ্কা তাদের।

কয়েকটি ব্যবসায়ী সংগঠন সূত্র জানিয়েছে, দেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে সরকার। পরে সংক্রমণ কিছুটা কমায় স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্তে পোশাক কারখানাসহ উৎপাদনশীল কলকারখানা খুলে দেয়া হয়। তবে প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিপুল পরিমাণ রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়ে যায়। যার ফলে ক্ষতির সম্মুখীন হয় এসব প্রতিষ্ঠান। কারখানা খুলে দেয়ার পর প্রতিষ্ঠানগুলো যখনই একটু ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, ঠিক তখন আবার আসে বিধিনিষেধ। তবে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা না করে বিধিনিষেধ দেয়ায় তারা ক্ষতির মুখে পড়ে। আবারও সরকারের কাছে ধরনা দিলে কিছু কলকারখানা খোলা রাখার অনুমিত দেয়া হয়। কিন্তু বিধিনিষেধ জারির আগে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করায় বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। সর্বশেষ বিধিনিষেধ জারির আগেও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আলোচনা হয়নি বলে একাধিক ব্যবসায়িক নেতা জানিয়েছেন।

লকডাউন বা বিধিনিষেধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয় তৈরি পোশাক খাত। বিশেষ করে রপ্তানিনির্ভর এ খাতের পণ্য সময়মতো উৎপাদন ও ডেলিভারি দিতে না পারলে বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বিধিনিষেধ দেয়ার আগে ব্যবসায়ীদের মতামত নেয়া বা আলোচনা করা হয় কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আলোচনা ঠিক করে না। তবে এর আগে যেসব সভা হয়েছে সেখানে বিজিএমইএ, এফবিসিসিআই, ডিসিসিআইসহ ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা ছিলেন। সেই সভায় এসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে সম্প্রতি যে বিধিনিষেধ আরোপের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে, তাতে আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি, আমরা কোনো দাওয়াত পাইনি। হয়তো জুমে আলোচনা হয়েছে। তবে আলোচনা করলে ভালো হতো। কারণ, বিধিনিষেধ জারি করলে তাতে কোন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, কোন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারত সরকার।’

ঈদের পরের বিধিনিষেধে পোশাক কারখানা খোলা রাখার বিষয়ে বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিজিএমইএ প্রতিনিধিরা। সে বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘আমরা সচিবকে বুঝানোর চেষ্টা করেছি এবং বলেছি যে, আমাদের প্রচুর অর্ডার রয়েছে। সময়মতো শিপমেন্ট করতে না পারলে রেমিট্যান্স আসবে না। ব্যবসার ক্ষতি হবে। শুধু পোশাক কারখানা মালিক নয়, এর সঙ্গে ব্যাংক ও ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ প্রতিষ্ঠানগুলো দেউলিয়া হয়ে যাবে। অর্ডার বাতিল হলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে। বিষয়টি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার অনুরোধ করেছি। আমরা বলেছি, শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা খোলা রাখা হয়। সে জন্য পোশাক খাতে করোনায় কোনো মৃত্যু নেই। কারখানা খোলা থাকলে শ্রমিকরা নিরাপদ থাকবেন। খোলা না থাকলে তারা বাইরে থাকবেন, বিভিন্ন জনের সঙ্গে মিশবেন। এতে আক্রান্ত বেশি হবে।’

অপরদিকে, ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘প্রত্যেকবার বিধিনিষেধ জারির সময় আমাদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। এবার আলোচনা করা হয়নি। আলোচনা করা হলে ভালো হতো।’

সংগঠনের পক্ষ থেকে দেয়া বিবৃতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধের আওতায় সব ধরনের শিল্প-কারখানা বন্ধ রাখা হলে দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। সম্পূর্ণভাবে বিঘ্নিত হবে সাপ্লাই চেইন (সরবরাহ ব্যবস্থা)। এতে উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বিশেষ করেÑখাদ্যসামগ্রী, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ পণ্য, বোতলজাত পানীয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ইত্যাদি উৎপাদন বন্ধ থাকলে ভোক্তারা সমস্যার সম্মুখীন হবেন। পণ্য সঠিকভাবে সরবরাহ ও বাজারজাত না হলে মূল্য বৃদ্ধি পাবে। এতে স্বল্প আয়ের ক্রেতারা ভোগান্তিতে পড়তে পারেন। পাশাপাশি রপ্তানি খাতের উৎপাদন ব্যবস্থা বন্ধ থাকলে সময়মতো পরবর্তী রপ্তানি অর্ডার অনুযায়ী সাপ্লাই দেয়া সম্ভব হবে না। এতে রপ্তানি অর্ডার বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘ঈদের ছুটিসহ প্রায় ১৮-২০ দিন কারখানা বন্ধ থাকলেও অনিশ্চয়তার মাঝে লেইট সামার, ক্রিসমাস ও বড়দিন এবং আগামী শীতের কার্যাদেশসমূহ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এক মাসের রপ্তানি শিডিউল বিঘিœত হলে পরবর্তী ছয় মাসের রপ্তানি শিডিউলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সেইসঙ্গে উৎপাদন বন্ধ থাকলে আমদানি করা কাঁচামাল অব্যবহƒত হয়ে নষ্ট হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এতে আমদানিকারক ও উৎপাদক উভয়ই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এছাড়া ক্ষুদ্র ও ছোট কারখানা বন্ধ রাখা হলে উদ্যোক্তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং কারখানা পুনরায় চালু রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে।’

এফবিসিসিআই সভাপতি জানান, ইতোমধ্যে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএ, প্লাস্টিক গুড্স ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ টেরি-টাওয়েল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনসহ রপ্তানি ও উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশন ও চেম্বারগুলো শিল্প-কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম সচল রাখার বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য এফবিসিসিআই’র প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে।

জসিম উদ্দিন বলেন, ‘করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে রোধে জারি করা বিধিনিষেধ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে ওষুধ কারখানা বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। যদি ওষুধ কারখানা বন্ধ রাখা হয় তবে জীবনরক্ষাকারী ওষুধ সরবরাহের ব্যবস্থা ব্যাহত হবে। অপরদিকে ট্যানারি কারখানা বন্ধ রাখা হলে কোরবানির ঈদে সংগৃহীত চামড়া সংরক্ষণ কার্যক্রম ব্যাহত হবে। বর্তমান কভিড পরিস্থিতিতে জীবনরক্ষাকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে। কিন্তু উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা হলে খাদ্যপণ্যসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে সবাই বঞ্চিত হবেন।’