Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 4:54 am

ব্যবসায়িক সংগঠনে সিলেকশন পদ্ধতি পরিহার জরুরি

আবুল কাসেম হায়দার: এক সময় দেশের ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিটিএমএসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নিয়ে বেশ আমরা গর্ব করতাম। ব্যবসার শুরুতে এসব সংগঠনের সদস্য লাভের বেশ আগ্রহ ছিল। এসব সংগঠনে সদস্য হওয়ার জন্য আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও লক্ষণীয় ছিল।

ব্যবসায়ীরা এখন অস্তিত্ব সংকটে রয়েছেন। ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃত্বের প্রতি আগ্রহ, উৎসাহ হারিয়ে যাচ্ছে। কর্ম প্রেরণা হ্রাস পাচ্ছে।

গত ৫ ডিসেম্বর ২০২১ একটি জাতীয় দৈনিকে ‘এফবিসিসিআইয়ের আসল কাজ তাহলে কোনটি’ শিরোনামে বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন পড়ে মর্মাহত হলাম। ভাবছি, আমরা কোথায় যেন তলিয়ে যাচ্ছি।

এফবিসিসিআই’র আসল কাজ নিয়ে ওই প্রতিবেদন পুরোটাই প্রণিধানযোগ্য। গণমাধ্যমে পাঠানো বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) একটি বিজ্ঞপ্তি আলোচ্য বিষয়। তাতে বলা হয়েছে, বিষয় হচ্ছে বিজয়ের ৫০ বছর উদ্?যাপনে পয়লা ডিসেম্বর থেকে ১৬ দিনব্যাপী লাল-সবুজের মহোৎসব করবে এফবিসিসিআই।

এফবিসিসিআই লিখেছে, ‘অর্থনৈতিক অগ্রগতি কিংবা সামাজিক সূচকের শক্তিশালী অবস্থান, দুর্বল এক শিশুরাষ্ট্র থেকে বিশ্বের অন্যতম প্রতিশ্রুতিশীল অর্থনৈতিক শক্তি, পরনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে আত্মনির্ভরতায় বলীয়ান হয়ে ওঠা বাংলাদেশের ৫০ বছরের গল্প সফলতার, অর্জনের।’ এটুকু পড়ে আশান্বিত হয়েছিলাম। মনে হলো, আসলেই ৫০ বছরের অর্জন তো বিশাল, বিশেষ করে অর্থনীতিতে। আর এ অর্জনের কৃতিত্ব তো দেশের উদ্যোক্তাদেরই। অবশ্যই সরকারের নীতিনির্ধারণী ভূমিকা আছে, তবে উদ্যোক্তাদের কৃতিত্বই বেশি। সুতরাং ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন হিসেবে এফবিসিসিআই’র বিশাল উৎসব করা মানায়।

অবশ্যই আমরা ৫০ বছরের উৎসব করব, করছিও। কিন্তু এফবিসিসিআই’র কাজ কি কেবলই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা? অর্থনীতি নিয়ে কিছুই কি করার ছিল না? এমনিতেই ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনটি এখন সরকারি দলের ব্যবসায়ী শাখায় পরিণত হয়ে গেছে। ১৬ দিনের উৎসবের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এ রকম: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আতশবাজি; শিশু-কিশোর ও বিশেষ শিশুদের অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান; নারীদের অংশগ্রহণে বিশেষ অনুষ্ঠান; নজরুল উৎসব; রবীন্দ্র উৎসব; নৃত্য উৎসব; অঞ্চলভিত্তিক অনুষ্ঠান; সশস্ত্র ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠান; লোকসংগীত; চলচ্চিত্র তারকাদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠান; মঞ্চনাটক ও কনসার্ট।

খুবই ভালো কর্মসূচি সন্দেহ নেই। কিন্তু এফবিসিসিআই’র কাজ কি কেবলই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা? অর্থনীতি নিয়ে কিছুই কি করার ছিল না? এমনিতেই ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনটি এখন সরকারি দলের ব্যবসায়ী শাখায় পরিণত হয়ে গেছে। নীতিনির্ধারণ বিষয়ে তাদের নিজেদের কোনো মূল্যায়ন নেই, নিজেদের কোনো অবস্থান নেই, এমনকি ভবিষ্যৎ নিয়েও তাদের কোনো আলোচনা নেই। ব্যবসায়ী সমাজে আসলে এফবিসিসিআই’র গুরুত্ব বা ভূমিকা আসলে কি, এটাই এখন বড় প্রশ্ন। আসলে এফবিসিসিআই ৫০ বছর নিয়ে অর্থনীতি বিষয়ে আলোচনা করবে, এটা আশা করাই ভুল ছিল।

১৯৮৩ সালে আমি তৈরি পোশাক শিল্প নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। তখন বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের শুরু বলা যায়। তখন বিজিএমইএ’র প্রাথমিক অবস্থা। সদস্য সংখ্যাও খুব কম। রাজধানীর কারওয়ান বাজার বস্ত্র শিল্প পরিদপ্তরে ছোট্ট কক্ষে বিজিএমইএ অফিস। সুবেদ আলী তখন বিজিএমইএ সভাপতি। পরবর্তী সভাপতি হন টিপু মুনশি। প্রকৃত অর্থে ১৯৭৮-৮৫ সালে এ এম সুবেদ আলী বিজিএমইএ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বিজিএমইএ গঠিত হয় ১৯৭৭ সালে। কোনো কোনো সূত্র অনুযায়ী ১৯৮৩ সালে মাত্র ১২ জন সদস্য নিয়ে বিজিএমইএ যাত্রা শুরু করে। আর বর্তমানে বিজিএমইএ সদস্য সংখ্যা সাড়ে চার হাজারেরও বেশি।

১৯৮৪ সালে ইয়ুথ গার্মেন্ট লিমিটেড নামে তৈরি পোশাক শিল্পের ব্যবসা শুরু করি। আমাদের প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফিরোজ আলম ছিলেন এর মূল উদ্যোক্তা। ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর ফিরোজ আলম নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চিরবিদায় নেন। রেজাকুল হায়দার মঞ্জু ছিলেন আমাদের অন্যতম উদ্যোক্তা পরিচালক। সেও অনন্তের ডাকে চলে যায় ২০২১ সালে। এখন আমাদের চারজনের মধ্যে আমি এবং মোস্তানছের বিল্লাহ ব্যবসায় জড়িত আছি।

কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালে ছাত্র সমাজের নানা সমস্যা নিয়ে কাজ করেছি। তাই ব্যবসায়িক জীবনে এসেও ব্যবসায়ীদের সমস্যা নিয়ে ব্যবসা শুরু থেকে আমার কাজ করার আগ্রহ ছিল। তাই ১৯৯২ সালে বিজিএমইএ সংগঠনের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করে ব্যবসায়ীদের কল্যাণে প্রচুর সময় ব্যয় করি। তখন নির্বাচন হতো। চমৎকার প্রতিযোগিতামূলক, আনন্দ-উৎসবের মধ্যে নির্বাচন হতো। পরবর্তীতে বিটিএমএ সংগঠনের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করি। তখন বিটিএমএ সভাপতি ছিলেন সালমান এফ রহমান। একই ধারাবাহিকতায় ২০০৩ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত এফবিসিসিআই’র সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করি। তখন এফবিসিসিআই সভাপতি ছিলেন আবদুল আউয়াল মিন্টু। পর পর দুইবার আমি এফবিসিসিআই পরিচালক পদে নির্বাচন করি। প্রথমবার দুই ভোটে হেরে যাই। দ্বিতীয়বার ২০০৩ সালে আমার প্যানেলে শুধু আমি জয়যুক্ত হই এবং নির্বাচনের পর সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাই।

তখন এফবিসিসিআই ব্যবসায়ীদের সংগঠন হিসেবে খুবই পরিচিত ছিল। নিয়মিত নির্বাচন হতো। সাধারণ সদস্যদের ভোটের মূল্য ছিল। ভোটারদের কদর ছিল। ২০০৫ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিটিএমএ, বিকেএমইএ প্রভৃতি সংগঠনের নির্বাচনের তরিকা উঠে যেতে শুরু হলো। নির্বাচন নির্বাচনে গিয়ে সিলেকশনে সংগঠন পরিচালিত হতে শুরু করল। এখনও সংগঠনগুলো আছে। নির্বাচনও আছে। তবে ভোটারদের ভোট দিতে হয় না। নির্বাচন হয়ে যায়। কমিটি গঠিত হয়। ভোটের কদর নেই।

এখন উপায় কী?

ব্যবসায়ী সংগঠন করা হয়েছে ব্যবসায়ীদের নানা সমস্যা সমাধানের জন্য। সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের দাবি আদায় করার জন্য।

দুই বছর পর পর এসব সংগঠনের নির্বাচন হতো অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে। সঠিক দায়িত্ব নির্বাচিত সদস্যরা করতে না পারলে পরবর্তী নির্বাচনে বাদ পড়ে যেতেন। এই ভয়ে সকলে ঠিক ঠিক মতো দায়িত্ব পালন করতেন। আমানতের প্রতি খেয়াল ছিল।

ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো ব্যবসার উন্নতির জন্য কাজ করে। সব দেশের চেম্বার, অ্যাসোসিয়েশন সেই কাজ করে। কিন্তু এখন আমাদের দেশে পরিস্থিতি ভিন্ন রূপ নিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতির ফলে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হয়েছে। উন্নতির পরিবর্তে অবনতি ঘটেছে। মূল কাজ রেখে আমরা অন্য কাজ নিয়ে বেশি সময় ব্যয় করছি।

দেশের সরকারও তেমন কোনো লাভবান হয়েছে বলে মনে হয় না। ব্যবসায়ীরা সব সময় সরকারের বন্ধু, সহযোগী। উন্নয়ন সহযোগী হলেন প্রকৃত ব্যবসায়ীরা। সেই কাজটি করার জন্য প্রকৃত ব্যবসায়ীদের স্বাধীন, নিরপেক্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন থাকা খুবই জরুরি। সরকারের আজ্ঞাবহ ব্যবসায়ী সংগঠন দিয়ে দেশের কোনো কল্যাণ হতে পারে না। সাময়িক কিছুটা সরকারের তোষণ হতে পারে, কিন্তু উপকার হয় না। প্রকৃত পরামর্শ দেশের জন্য, সরকারের জন্য কোনো তোষণকারী সংগঠন দিতে পারে না। কারণ তারা ব্যস্ত থাকে সব সময় নিজের স্বার্থ নিয়ে। নিজের ব্যবসা নিয়ে। নিজেদের ব্যবসায়ী স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য ব্যস্ত ‘পরিচালক’ সংগঠন কোনো দিন জাতির স্বার্থে কাজ করতে পারে না।

ব্যবসায়ীদের স্বার্থকে সরকারের কাছে যুক্তি দিয়ে উত্থাপন করতে পারে। নিজের মধ্যে একটি ‘পলায়নমূলক’ মনোভাব কাজ করে। ‘তোষণমূলক নীতি’ গ্রহণ করা এদের চরিত্র হয়ে পড়ে। মূল ব্যবসায়িক কাজ থেকে সরে গিয়ে সরকারের সহযোগী সংগঠনে পরিণত হয়। তখন সরকার ও বেসরকারি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। তাতে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয় বেশি। দেশেরও ক্ষতি হয়। উন্নয়মূলক পরিকল্পনার পরিবর্তে সরকারের তোষণমূলক কাজে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ব্যবসায়িক চরিত্র হারিয়ে যায়।

এখন প্রয়োজন এফবিসিসিআইসহ সব ব্যবসায়ী সংগঠনের মধ্যে একটি পরিবর্তন আনা। ব্যবসায়ী সংগঠনে প্রকৃত নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। সিলেকশন পদ্ধতি পরিহার করতে হবে। ব্যবসায়ী সংগঠনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও রাজনীতিমুক্ত হতে হবে। যিনি রাজনীতি করবেন তিনি ব্যবসায়ী সংগঠনের কোনো রকম দায়িত্বগ্রহণ না করা উচিত। তাতে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করা যাবে না। ব্যবসাকে সম্পূর্ণরূপে রাজনীতি থেকে আলাদা করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর দৃঢ় সিদ্ধান্ত। কার্যকরী উদ্যোগ। দেশের ব্যবসার স্বার্থে সব ব্যবসায়িক সংগঠন রাজনীতিমুক্ত হতে হবে।

প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান

ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, আইএফআইএল

ও আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম

ansarisahadat4@gmail.com