সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: কোটা সংস্কার আন্দোলন ও চলমান অস্থিরতার প্রভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও উৎপাদন খাতে চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। একই সঙ্গে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যিক কার্যক্রম রয়েছে সংকটে। এছাড়া অস্থিরতায় বেড়েছে ডলারের বিনিময়হার। সবমিলিয়ে উদ্যোক্তাদের উৎপাদন ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিচালনায় হিমশিম খেতে হচ্ছে।
ব্যবসায়ী ও বাণিজ্যিক সংগঠনগুলোর মতে, ২০২১ সালে কভিড-১৯ সংক্রমণ এবং ২০২৩ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে যে ক্ষয়ক্ষতি ব্যবসা-বাণিজ্যে হয়েছে, তা এখনও কাটেনি। এরই মধ্যে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও উৎপাদন খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। গত মাসের শেষ ১৫ দিন রেল যোগাযোগ বন্ধ থাকার সময় নিয়মিত জাহাজ থেকে কমলাপুরগামী কনটেইনার নামানো হয়। কিন্তু পরিবহন বন্ধ থাকায় চট্টগ্রাম বন্দর চত্বরে কমলাপুরগামী কনটেইনারের স্তূপ জমে যায়। গত বৃহস্পতিবার বন্দর ইয়ার্ডে কমলাপুরগামী কনটেইনারের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৫২৫টিতে। বন্দরে মোট কনটেইনার ধারণক্ষমতা ৮২৫ (একক)। অর্থাৎ বন্দরে এখন ধারণক্ষমতার দ্বিগুণের কাছাকাছি কনটেইনার রয়েছে। তবে বৃহস্পতিবার থেকে সীমিত আকারে ট্রেনে করে কনটেইনার পরিবহন শুরু হয়েছে।
তেমনি ঢাকার কমলাপুর ডিপোয় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত রপ্তানি পণ্য নিয়ে ৪৩৫ একক কনটেইনার আটকে ছিল। একই অবস্থা চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার ইয়ার্ডগুলোয়। গতকাল বুধবার পর্যন্ত বন্দরের ইয়ার্ডে মোট ৪২ হাজার ৬৩৮ একক কনটেইনার জমা ছিল। অর্থাৎ দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যিক কার্যক্রম সংকটে রয়েছে। এছাড়া এক সপ্তাহের ব্যবধানে ডলারের দাম খোলাবাজারের বেড়েছে ছয় টাকা। সবমিলিয়ে উদ্যোক্তাদের উৎপাদন ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনায় হিমশিম খেতে হচ্ছে।
চট্টগ্রামের চান্দগাঁও শিল্প এলাকায় টিকে গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান চামড়াবিহীন জুতা উৎপাদন ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ম্যাফ শুজ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি চপ্পল, কেডস, স্নিকারসহ বিভিন্ন ধরনের জুতা তৈরি করে। কারফিউ জারির পর কারখানা পাঁচ দিন বন্ধ ছিল। সে সময় তারা দুই লাখ ৮৫ হাজার জোড়া জুতা উৎপাদন করতে পারেনি, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ২৫ কোটি টাকা। বিষয়টি নিশ্চিত করে ম্যাফ শুজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হাসনাত মোহাম্মদ আবু ওবায়দা বলেন, ‘দুই সপ্তাহ ধরে কঠিন সময় পার করছি। উৎপাদন বন্ধ থাকায় বড় ক্ষতি হয়েছে। সময়মতো পণ্য জাহাজীকরণ করা যায়নি। সেজন্য ক্রেতাদের সঙ্গে পণ্য পাঠাতে সময় বাড়ানোর আলোচনা চলছে।’
বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের মতে, ইস্পাত খাতের বড় একটি কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম সচল রাখতে আগে ১০০ কোটি টাকার চলতি মূলধন লাগলে এখন ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ অন্যান্য কারণে ১৭০ কোটি টাকা লাগছে। অথচ কোম্পানির ঋণসীমা ১০০ কোটি টাকায় সীমাবদ্ধ থাকায় আগের চেয়ে ৪৮ শতাংশ কম কাঁচামালসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ আমদানি করতে পারছে। এতে ব্যবসা পরিচালনা করে ব্যাংকঋণের সুদ, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম, ঋণপত্রের কমিশন, ঋণপত্রের মার্জিন, কাস্টমস ডিউটি, মূসক, কর ও অন্যান্য মাশুল পরিশোধে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এরই মধ্যে টানা আন্দোলনে ডেলিভারি ও চাহিদা কমে গিয়ে বড় উৎপাদনশীল কারখানাগুলো চলতি মূলধন ঘাটতি প্রকট আকার ধারণ করেছে। আর সময়মতো ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ না করলে ঋণখেলাপি হওয়ার ঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে। একই অবস্থা সিমেন্ট, পোশাক খাতসহ উৎপাদন শিল্প খাতগুলোর।
মূলত কোটা সংস্থার আন্দোলন ও ডলারের বিনিময়হার বৃদ্ধি পাওয়ায় এ সংকট তৈরি হয়েছে। এ সংকট মোকাবিলায় অবিলম্বে সুরক্ষা দেয়া প্রয়োজন। তা না হলে অনেক শিল্পকারখানা রুগ্ণ হয়ে যাবে। তাতে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক কর্মহীন হবেন। এতে শ্রম অসন্তোষের ঘটনাও ঘটতে পারে।
অন্যদিকে সিমেন্টশিল্পের এক উদ্যোক্তা শেয়ার বিজকে বলেন, যখন ডলারের দাম ৮৫ টাকা ছিল, তখন সিমেন্ট ব্যাগের দাম ছিল ৫২০ টাকা। এখন ডলারের দাম বেড়ে ১২০ থেকে ১২৫ টাকা হলেও ৪৮৫ টাকায় সিমেন্ট বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমায় সিমেন্টের চাহিদাও কমে গেছে। সেজন্য উৎপাদন খরচের তুলনায় কম দামে সিমেন্ট বিক্রি করতে হচ্ছে। আমরা ন্যায্যমূল্যে পাচ্ছি না। এছাড়া দেশব্যাপী ডেলিভারি চ্যানেল তো অনেকটা বন্ধ রয়েছে। মঙ্গলবারও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ ছিল।
এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিআইয়ের সভাপতি ও ব্যবসায়ী মাহবুবুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, এখন অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক রাখা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম, পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ স্বাভাবিক না থাকলে দেশে সংকট তৈরি হবে। এমনিতে ব্যবসায়ীরা গত কয়েক বছর ধরে কভিড সংক্রমণ ও রাশিয়া-ইউক্রন যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত, এরই মধ্যে ব্যাংকঋণের সুদহার বেড়েছে, ডলারের বিনিময় হার ও গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। আন্দোলনের কারণে উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রম অনেক বেশি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এতে ব্যবসায় বহুমাত্রিক চাপ তৈরি হয়েছে।