মাহবুবুর রহমান: বিনিময় প্রথা থেকে বিক্রয় যুগের সৃষ্টির মাধ্যমে এনে দিয়েছে ব্যবসার নবদিগন্ত। নবজাগরণের এ সময়ে ব্যবসায়ের জনপ্রিয়তা বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে ব্যবসায় শিক্ষার চাহিদাও। মানব মনে জাগছে ব্যবসায়ের কুটিল ও লোভনীয় কৌশল আয়ত্ত করার বাসনা। ব্যবসায় শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সমাজ-উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিষয়। একটি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ের অবদান অনস্বীকার্য। গতিশীল সমাজ ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ব্যবসায় হলো দেশ পরিচালনা-উন্নয়নের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। ব্যবসা ক্ষেত্রে গতিশীলতা না থাকলে স্থবির হয়ে পড়ে দেশে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সব উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ। ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বাণিজ্য শব্দটির যথাযথ প্রয়োগ হওয়ায় বেড়েছে উন্নয়ন কার্যক্রম ও ব্যবসায় শিক্ষার পরিধি। এক সময় বিজ্ঞানের কল্যাণে ইউরোপে যে শিল্পায়ন ঘটেছিল-সে বিপ্লব থেকেই বাণিজ্য শিক্ষার গুরুত্ব বাড়ে শিক্ষাঙ্গনে। ইতালীয় গণিতবিদ লুকা প্যাসিওলি-দ্য সুম্মা বুক লেখার মাধ্যমে করেছিলেন এর শুভ সূচনা। সেই থেকে বাণিজ্য অর্থাৎ ব্যবসায় শিক্ষা বিশ্বব্যাপী অপরিহার্য একটি কার্যে পরিণত হয়েছে।
সুপ্রাচীন ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত তথ্যের মাধ্যমে জানা যায়, আমাদের পূর্বপুরুষদের একটি বিরাট অংশ ছিলেন বণিক গোষ্ঠী। তারা আলবেনিয়া, নাইজার, কাজাখিস্তান, ইথিওপিয়া, মিশরসহ বিশ্বের তৎকালীন উন্নত সভ্যতাগুলোর সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন দূরদর্শী বাণিজ্যিক সম্পর্ক। প্রসঙ্গ বিবেচনায় আমাদের এ উপমহাদেশ চিত্র তুলে ধরা যায়Ñ আজ থেকে অর্ধসহস বছর আগে বহির্বিশ্বে মসলা রপ্তানিতে ব্যাপক সুনাম ছিল এই সাব-কন্টিনেন্টের। সপ্তগাঁও ও চট্টগ্রাম বন্দর ছিল যাতায়াতের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। এ অঞ্চলের বাণিজ্য খ্যাতি এতবেশি ছিল যে-বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠীর লোলুপ দৃষ্টিতে পড়তে হয়েছিল। ওলন্দাজ, পর্তুগিজ, মোগল ও সর্বশেষ ইংরেজরা এদেশে এসে সুকৌশলে বন্ধ করে দেয় আমাদের বাণিজ্যের দরজা। অবশ্য ইংরেজ শাসনামলেও এ অঞ্চলে বাণিজ্য শিক্ষার সুযোগ ছিল বলে ইতিহাস মারফত জানা গেছে। তবে সেটি ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অতিসামান্য-এ পরিমাণ বাণিজ্য জ্ঞান দিয়ে শুধু কেরানির চাকরি পাওয়া সম্ভব ছিল।
ফলে ভারতীয় উপমহাদেশ বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাণিজ্য ক্ষেত্রে অগ্রসর হতে পারেনি। এমনকি ব্রিটিশ-পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান শাসনামলেও বাণিজ্য শিক্ষায় চোখে পড়ার মতো তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। যার দরুন মুখ থুবড়ে পড়ে এদেশের বাণিজ্য শিক্ষা। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাণিজ্য শিক্ষার পরিধি বিস্তারের লক্ষ্যে পরিকল্পনা প্রণয়নপূর্বক পাঠ কার্যক্রম শুরু করলেও এ পদ্ধতি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত না হওয়ায় মেধাবীদের আকর্ষণ করতে পারেনি। বর্তমান সময়ে ব্যবসায় শিক্ষাকে যুগোপযোগী ও এর বিস্তার বাড়ানোর লক্ষ্যে বেশ কিছু পদক্ষপ গ্রহণ করা হয়েছে। এমনকি গুরুত্ব বিবেচনায় মাধ্যমিক স্তরে ব্যবসায় শিক্ষাকে অধিক সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। একটা সময় ছিল যখন অশিক্ষিতরাও ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতি করতে পারত। তখনকার সময়টায় আজকের মতো এতবেশি প্রতিযোগিতা ছিল না। ব্যবসা তখন ছিল অনেকটা সহজ, তবে চ্যালেঞ্জিং। বিষয় বিবেচনায় মৌর্য আমলের উয়ারি-বটেশ্বর সভ্যতার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০-এর দিকে নির্মিত হয় এ সভ্যতাÑএটি ছিল সমদ্র বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত। অর্থাৎ বলা চলে অতীতেও বাণিজ্যের তথা ব্যবসায়ের পরিধি ব্যাপক ছিল। সমুদ্র বাণিজ্য চাঙ্গা থাকলেও অন্যদিকে ব্যবসা শিক্ষার যথেষ্ট অভাব ছিল। তবে চলমান বর্তমান দিচ্ছে ভিন্ন বার্তা। বর্তমানে বাণিজ্য অর্থাৎ ব্যবসা শিক্ষায় পারদর্শিতা অর্জন করা ছাড়া ব্যবসা ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত সফলতা অর্জন করা প্রায় অসম্ভব।
যার কারণে বর্তমানে অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে ব্যবসায় শিক্ষার গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। হরেক রকমের পণ্য উৎপাদন, পরিবহন ব্যবস্থায় উন্নতি এবং এর সঙ্গে দেশীয় ও আন্তঃমহাদেশীয় বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়নে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করছে বাণিজ্য অর্থাৎ ব্যবসায় শিক্ষা। ব্যবসা সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করার সুযোগ পাওয়ায় মানুষ এখন নিজে থেকেই ব্যবসা উদ্যোগ গ্রহণ করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
এমনকি বাণিজ্য বিষয় কিছু পরিমাণ জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে বনে যাচ্ছে উদ্যোক্তা। যার ফলে বর্তমানে মানুষ চাকরির পেছনে না দৌড়ে আত্মকর্মসংস্থানে মনোযোগী হতে পারছে। তবে শুধু উদ্যোক্তা নয়, ব্যবসা ক্ষেত্রে ইতিবাচক ধারার প্রবর্তন এবং সামাজিক কল্যাণমূলক ব্যবসা সংগঠন গড়ে তোলার অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে হিসাববিজ্ঞান তথা ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর ওপর ডিগ্রি নেয়া ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পারদর্শী কর্মী ও কর্মকর্তা নিয়োগ করা। প্রয়োজনে সম্ভব হলে প্রতিষ্ঠান পরিচালককেই এ বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
বর্তমানে ব্যবসায় শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের ঝোঁক লক্ষ্যণীয় মাত্রায় বেড়েছে। ১৯৯৬ সালে মাধ্যমিক স্তরে ব্যবসায় শিক্ষা চালুর পর থেকে ক্রমে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কমতে থাকে। ২০১০ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী প্রায় ২২ শতাংশে স্থির ছিল। অথচ ওই চার বছরে বাণিজ্যের শিক্ষার্থী বেড়ে ৩৪ থেকে ৩৭ এবং মানবিকের শিক্ষার্থী কমে ৪৩ থেকে ৩৯ শতাংশ হয়েছে।
২৬ বছর আগে যেখানে এ বিভাগে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল মোট পরীক্ষার্থীর ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ, সেখানে চলতি বছর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ দশমিক ৩১ শতাংশ। অর্থাৎ ২৬ বছরে এ বিভাগে শিক্ষার্থী বেড়েছে ২৩ শতাংশের বেশি।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে ব্যবসায় প্রশাসন বা ব্যবসায় শিক্ষায় ১ লাখ ৩৪ হাজার ১১২ শিক্ষার্থী থাকলেও প্রকৌশল ও কারিগরিতে ছিল ৯৪ হাজার ৪৮ জন। আবার একই বছর কলা, বিজ্ঞান, সামাজিকবিজ্ঞান ও কৃষিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল এই দুই বিভাগের চেয়ে অনেক কমÑএমন চিত্র লক্ষ করা গেছে।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) বলছে, ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে মাধ্যমিকে বিজ্ঞান ও মানবিক বিভাগের সঙ্গে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ চালুর পর থেকে শিক্ষার্থীদের মোট সংখ্যার মধ্যে আনুপাতিক হারে মানবিকে পড়ার প্রবণতা কমেছে অনেকখানি। অন্যদিকে বেড়েছে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের পরীক্ষার্থীর হার। ১৯৯৮ সালে পরীক্ষার্থী ছিল ৭২২৩০০ জন। এর মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগে ৩৩ দশমিক ১ শতাংশ, মানবিকে ৫৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ ও ব্যবসায় শিক্ষায় ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ। অন্যদিকে, ২০১৬ সালে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ লাখ ২৮৪ জনে। এর মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগে ২৯ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ, মানবিকে ৪০ দশমিক ৬৬ শতাংশ ও ব্যবসায় শিক্ষায় ৩০ দশমিক ৩১ শতাংশ। অর্থাৎ গত ২৬ বছরে বিজ্ঞান বিভাগে প্রায় ৪ শতাংশ ও মানবিকে ১৯ দশমিক দুই শতাংশ শিক্ষার্থী কমেছে। কিন্তু অভাবনীয়ভাবে বেড়েছে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে। ব্যবসায় শিক্ষার এ অভাবনীয় উন্নয়নে ৯০’র দশক পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায় শিক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ধারণাতীত ভূমিকা পালন করেছে। এক্ষেত্রে ঢাকা কমার্স কলেজের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। যেটি বাণিজ্য শিক্ষার ক্ষেত্রে খুলে দিয়েছিল সম্ভাবনার নতুন দ্বার। দেশে বাণিজ্য শিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে ঢাকা কমার্স কলেজের যেমন অবদান রয়েছে ঠিক তেমনি অবদান রয়েছে এদেশের বাণিজ্য শিক্ষার স্বপ্নদ্রষ্টা প্রফেসর কাজী নুরুল ইসলাম ফারুকীর। ধারণা করা হয়, দেশের বাণিজ্য শিক্ষায় আধুনিকতার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে ছিলেন এ মহারথী।
বর্তমান বাণিজ্য শিক্ষার চিত্র বলে দেয় কেমন হবে বাংলাদেশের বাণিজ্য অর্থাৎ ব্যবসায় শিক্ষার ভবিষ্যৎ। নব্বই পরবর্তী সময়ে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগা ব্যবসায় শিক্ষার সঙ্গে যদি-প্রযুক্তি ও বিশ্বকোষীয় নতুন তথ্য ভাণ্ডারজুড়ে দেয়া যায় তাহলে সম্পূর্ণ বদলে ফেলা সম্ভব হবে বাংলাদেশের ব্যবসায়-বাণিজ্যের চিত্র। তৈরি হবে ব্যবসার নতুন নতুন ক্ষেত্র। বদলে যাবে প্রচলিত উৎপাদন ধারণা, শক্তিশালী হবে দেশের অর্থনীতি। সর্বোপরি প্রসারিত করা সম্ভব হবে ব্যবসায়-বাণিজ্যের পুরো প্রক্রিয়াকে।
বিভাগীয় প্রধান
ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ
প্রিন্সিপাল কাজী ফারুকী কলেজ, লক্ষ্মীপুর