মিজানুর রহমান শেলী: অনেক বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হয় যেখানে কেবল সময় অপচয় করা হয়ে থাকে। এটা শেয়ারহোল্ডার ও ব্যবস্থাপক উভয়ের জন্য সময় অপচয়ের নামান্তর বটে। এ কারণে যে কখনও কখনও ব্যবস্থাপকেরা ব্যবসার মূল বিষয়গুলো খোলাসা করতে চান না। আবার কিছু সময় শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে এমন অনেকেই যুক্ত হন, যারা কিছু অপ্রয়োজনীয় বা নিরর্থক সময় নষ্ট করেন। তারা মূলত মঞ্চে নিজের বিষয়টির প্রতি বেশি আগ্রহ প্রকাশ করে থাকেন। অথচ করপোরেশনের সার্বিক বিষয়াবলির ব্যাপারে তাদের কোনো মাথাব্যথা থাকে না। যেটা ব্যবসায় আলোচনার একটি ফোর্যাম হওয়ার কথা ছিল সেটা হয়ে ওঠে একটি নাটকের মঞ্চ। আবার কারও কারও রাগ ও ক্ষোভের মতো আক্রোশ বা সুখের অনুভূতি পরিলক্ষিত হয়। আবার অনেকে কেবল বিভিন্ন ইস্যুকে সামনে রেখে নানা উপদেশ-পরামর্শ দিতে থাকেন। (ব্যাপারটা খুব দুর্দমনীয়: একটি শেয়ার কিনেই তিনি যেন একদল দর্শক-শ্রোতাকে আটক করে ফেলেন তার কথা শোনার জন্যÑতিনি ঘোষণা দিতে থাকেন এই পৃথিবী কেমন করে চলবে।) এসব পরিস্থিতিতে, সভার মান ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। বছরের পর বছর এটাই চলতে থাকে। কতিপয় পুরোনো লোক উপস্থিত হন যারা নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়ে আগ্রহীদের আগ্রহ আরও নষ্ট করতে থাকেন, তাদের নিরুৎসাহী করেন। কিন্তু বার্কশায়ারের সভা একটি ভিন্ন গল্প। অসংখ্য শেয়ারহোল্ডার এখানে উপস্থিত হন। এই উপস্থিতির সংখ্যা প্রতি বছরই প্রায় কিছু না কিছু বাড়তে থাকে, কিন্তু এ পর্যন্ত আমরা কোনোদিন কোনো সময় কোনো নিরর্থক প্রশ্নের সম্মুখীন হইনি। এমনকি কেউ কখনও কোনোদিন তার আবেগের জায়গা থেকে কোনো মন্তব্য করে বসেননি। বরং আমরা পেয়ে থাকি ব্যবসাভিত্তিক বিচিত্র সব চিন্তাপ্রসূত প্রশ্ন। কার্যত বার্ষিক সভায় এই প্রশ্নগুলোই স্থান পেয়ে থাকে। এর পেছনেই অনেক বেশি সময় ব্যয় করা হয়। আমি ও চার্লি খুব খোশ মেজাজে এসব প্রশ্নের জবাব দিয়ে থাকি। তবে সময়ের দিকে তাকাই নাÑযত সময় লাগে তত সময় ধরেই তার উত্তর দিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। (তবে বছরের অন্য সময়গুলোতে আমরা ফোনে বা পত্রে লেখা চিঠির প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারি না। হাজার হাজার শেয়ারহোল্ডারদের মাঝে কোনো এক সময় কোনো এক ব্যক্তির একটি প্রশ্নের জবাব দিতে গেলে পুরো ব্যবস্থাপনাই নষ্ট হয়ে যেতে পারে।) কেবল সেসব বিষয়-আশয় যা ব্যবসার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংশ্লিষ্ট, সেগুলো যদি বার্ষিক সভার সীমার বাইরেও চলে যায়, তবুও আমাদের কোম্পানি অকপটে সে বিষয়ে সময় দেয় এবং সেটাকে রিয়েল মানি বলে বিবেচনা করে থাকে। আবার নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদের গৃহীত কার্যক্রমও হতে পারে মুখ্য উদাহরণ।
বার্কশায়ারের প্রতি পরিপূর্ণ প্রতিবেদন দেওয়া মানে হলো, সেই তথ্য দেওয়া যে তথ্যের মাধ্যমে আমরা আশা করি আপনারা আমাদের জানাবেন আমরা সঠিক পথে আছি কি না, নাকি উল্টো পথে চলছি। চার্লি ও আমি বিশেষ করে সেসব পরিস্থিতিতে এগুলো খুব সাগ্রহে গ্রহণ করি। এগুলো আমাদের চলমান ব্যবসায় পরিস্থিতি বুঝতে বিভিন্ন বিষয় সামনে এনে দেয়। এমনকি এটা দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসার ক্ষেত্রে সিইওদের উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বহন করে। তবে আমরা আশা করি প্রচুর পরিমানে ফিন্যান্সিয়াল বিবরণী এবং যে কোনো তাৎপর্যপূর্ণ উপাত্তের আলোচনা, যাতে আমরা প্রতিবেদনে কী উপস্থাপন করা হয়েছে, তার সঠিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারি।
যখন চার্লি ও আমি এসব প্রতিবেদন বা চিঠি-পত্রাদি পড়ি, তখন কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছবি, বৃক্ষ, লতা-গুল্ম কিংবা কোনো পণ্যের ছবির প্রতি আমাদের কোনো আগ্রহ থাকে না। ইবিআইটিডিএ’র (Earnings before interest, taxes, depreciation, and amortization) বরাত দিয়ে কোনো কিছু লেখা হলে আমরা শিহরিত হই ব্যবস্থাপনা চিন্তকদের শিহরিত করে। এটা যেন মূলধন খরচের বিনিময়ে দাঁত পরীর উপহার!
আমরা হিসাবরক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে খুব সন্দেহপ্রবণ। প্রথাগতভাবেই হোক অথবা যে কোনো অজানা কারণেই হোক, আমরা এটা নিয়ে অনেক সজাগ থাকি, কেননা মাঝে মাঝেই ব্যবস্থাপকেরা কিছু না কিছু গোপন করার চেষ্টা করে থাকেন। আর আমরা কখনোই সেসব বার্তা পড়তে চাই না, যেগুলো পাবলিক রিলেশন ডিপার্টমেন্ট বা পরামর্শকেরা পরিহার বা বাতিল করেছেন। যাহোক আমরা আশা করি যে কোনো কোম্পানির সিইও’র উচিত তার নিজের ভাষায় যা ঘটছে তার বর্ণনা দেওয়া।
আমাদের জন্য কোনো ন্যায্য তথ্যপ্রাপ্তির মানে হলো আমাদের তিন লাখ অংশীদারির জন্য কোনো তথ্যপ্রাপ্তি। আর আমরা এই তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার্থে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে থাকি। আমরা আমাদের বার্ষিক ও সাময়িকী ফিন্যান্সিয়াল হিসাবনিকাশ শুক্রবারের বাজার বন্ধ হওয়ার পর থেকে শনিবার সকালের আগ মুহূর্ত অবধি ইন্টারনেট মাধ্যমে উপস্থাপন করে থাকি। ফলে শেয়ারহোল্ডার ও অন্যান্য আগ্রহী লগ্নিকারীরা এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি আগেই পেয়ে যান। আর তারা সোমবারের বাজার চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত এই বিষয়াদি নিয়ে যথেষ্ট ভাবনা-চিন্তার সুযোগ পেয়ে থাকেন।
আর্থার লেভিতের (জুনিয়র) কাজের তারিফ করতে হয়, কেননা তার আগে এসইসির সাম্প্রতিককালের চেয়ারম্যন করপোরেট জগতে ‘সিলেকটিভ ডিসক্লোজার’ বিষয়ে একটি বিধ্বংসী কাজ করেছেন, যা চারদিকে ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়ছিল কয়েক বছর ধরে। যদিও এটা হয়ে উঠেছিল প্রধান করপোরেশনগুলোর জন্য বাহ্যিকভাবে একটি আদর্শ চর্চা। কেননা কোম্পানি আয় করতে চায় এমন যেসব কিছু ইতোমধ্যে নাকের ডগার কাছে চলে এসেছে অথবা খানিক নিচে পড়ে আছে, সেসব আয়ের প্রত্যাশা বিষয়ে এটি বিশ্লেষক ও বড় শেয়ারহোল্ডারদের পথনির্দেশনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর এটা তারা করছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাঁস করার মাধ্যমে: কখনও ইশারা-ইঙ্গিতে, কখনও মাথা নাড়িয়ে বিভিন্নভাবে তারা এসব তথ্য ফাঁস করে চলেছিল, যাতে কোম্পানিগুলো এসব ব্যবসায় আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং সহসা জড়িয়ে পড়ে। মূলত ফটকাবাজ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও উপদেষ্টা-পরামর্শককে এই তথ্যগুলো দেওয়া হচ্ছিল। আর নিঃসন্দেহে এটা ছিল একটি দুর্নীতিপরায়ণ আচরণ। দুঃখের বিষয় হলো ওয়ালস্ট্রিট ও করপোরেট আমেরিকাও এগুলোকে সাগ্রহে গ্রহণ করেছিল।
থ্যাঙ্কস টু চেয়ারম্যান লেভিত। বিনিয়োগকারীদের পক্ষে তার প্রচেষ্টা ছিল যেমন ক্লান্তিকর তেমনি ফলপ্রসূ। তিনি সফল হয়েছেন। এখন করপোরেশনগুলোকে বলা হয় তার সব মালিককে সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। কাউকে প্রয়োজনের বেশি গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কার্যত এই সংস্কার সাধন করা গেছে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে। বিবেগ বা নৈতিকতার কথা বলে এসব সমস্যার কোনো সমাধান আসেনি, যদিও এই বিষয়গুলো একটি কোম্পানির সিইও এবং সেখানকার ইনভেস্টর রিলেশন ডিপার্টমেন্টের কর্তাব্যক্তিদের জন্য লজ্জাজনক।
যখন আমি আমার সোপবক্সের (প্রচারযন্ত্র) কাছে অবস্থান করছিলাম তখন কিছু বাড়ন্ত চিন্তা আমাদের দুজনকেই আচ্ছন্ন করেছিল: চার্লি ও আমি ভাবলাম এটা নিতান্ত প্রতারণাপূর্ণ ও বিপজ্জনক যে কোম্পানির সিইও’রা নিজ নিজ কোম্পানির ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে কোনো আশ্বাস বা ভবিষৎ প্রত্যাশা ব্যক্ত করছেন। কেননা বিভিন্ন বিশ্লেষক ও ইনভেস্টর রিলেশন ডিপার্টমেন্ট ইতোমধ্যে এসব সিইও’দের ডিম দিয়ে আপ্যায়ন সেরে নিয়েছে। আসলে এই ভবিষ্যদ্বাণী প্রায়ই খুব সংকট সৃষ্টি করে। তাই এটাকে যেকোনোভাবেই হোক অবশ্যই থামাতে হবে।
এই দর্শন রচনাবলি সম্পাদনা করেছেন লওরেন্স এ. কানিংহাম।
অনুবাদক: গবেষক, শেয়ার বিজ