Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 1:28 am

‘ব্যবসায় সফলতার জন্য অর্থের আগে মেধা বিনিয়োগ করতে হবে’ বগুড়ার ব্যবসায়ী

আব্দুল মান্নান আকন্দ। ফ্ল্যাট ব্যবসার পাশাপাশি ঠিকাদারি ও বগুড়া জেলা ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। রয়েছেন বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। দিনপ্রতি দুই টাকা বেতনে তার কর্মজীবন শুরু হয়েছিল। শহরের নিউমার্কেটে খালুর কাপড়ের দোকানে দুপুরের খাবার
পৌঁছে দেওয়ার বিনিময়ে এই মজুরি পেতেন তিনি। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে তিনি আজ সফল ব্যবসায়ী। তাকে অনুসরণ করেন উত্তরাঞ্চলের অনেক ব্যবসায়ী। এক সময় অভাবের কারণে পড়ালেখা করতে পারেননি। তাই অসহায় গরিব পরিবারের মেধাবী কোনো শিক্ষার্থীর খোঁজ পেলে তার পড়ালেখার যাবতীয় খরচের দায়িত্ব নেন তিনি। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তার জীবনের গল্প জানার চেষ্টা করেছেন পারভীন লুনা

আপনার বেড়ে ওঠা ও জীবনসংগ্রামের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে আগ্রহী।
আব্দুল মান্নান আকন্দ: স্বাধীনতার পর আমাদের বাড়িটা পুড়িয়ে ফেলা হয়, কারণ আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমাদের পুরো পরিবার অকূল পাথারে পড়ে। লেখাপড়া করতে পারিনি। আমি স্বশিক্ষিত মানুষ। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়েছি। অভাবের তাড়নায় জীবিকার সন্ধানে নেমে পড়ি। আমরা ভাইবোন মিলে চেষ্টা করেছি বিভিন্ন কাজে জড়িতে হতে। আমার জীবনের প্রথম কাজ ছিল বগুড়ার নিউমার্কেটের দোকানদারদের বাসা থেকে টিফিন ক্যারিয়ারে করে ভাত পৌঁছে দেওয়া। আমি খালুর দোকানে দুপুরের খাবার নিয়ে যেতাম। খাওয়া শেষে আবার বাটি বাসায় দিয়ে আসতাম। এজন্য আমাকে প্রতিদিন তিনি দুই টাকা দিতেন। ছোটবেলা থেকেই একটু চঞ্চল ছিলাম। ওই সময়ের মধ্যে দুই-একটা দোকানে কাস্টমারদের সঙ্গে কথা বলতাম। তখন আমার কথাবার্তায় খালু আকৃষ্ট হন। দেড় মাস পরে খালু আমাকে দোকানে বসান। বিভিন্নভাবে কাস্টমারদের কনভিন্স করা শুরু করি। আমার কৌশল দেখে খুশি হন খালু। সপ্তাহে ৩৫ টাকা বেতন দেন। সেই শুরু। এর পরে চাকরি করতে করতে ওই দোকানেই আমার বেতন দাঁড়ায় চার হাজার টাকা।

ব্যবসায় কীভাবে এলেন?
আব্দুল মান্নান: একটা সময়ে এসে দোকানদারি উপভোগ করছিলাম না। তাই পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ছোট ব্যবসা শুরু করি। ব্যর্থ হই বারবার। এভাবেই কোনো রকমে চলতে থাকি নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত।

ব্যবসায় সফলতার মুখ দেখেন কবে?
আব্দুল মান্নান: নব্বইয়ের দশকের পরে ঠিকাদারি শুরু করি। ওই সময়ে ঠিকাদারি ছিল লাভজনক ব্যবসা। আমি সফল হই এ পেশায়। ঠিকাদারির জন্য স্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমার বাড়ির অবস্থান আমার কাজের অনুকূলে ছিল। এলাকার সবকিছুতে আমি প্রাধান্য পেতাম। এছাড়া পাশে রেলপথের জায়গা ছিল। এগুলো আমি লিজ নিয়ে অনেক সময় বেচাকেনা করেছি। পরে বগুড়া চেম্বারের বর্তমান সভাপতি মাসুদুর রহমান মিলন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। আমার নতুন যাত্রা শুরু হয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত আর থামিনি। এখন প্রায় ৬০টি পরিবারকে সহায়তা করি আমি। আমার এখানে যারা কাজ করে তারা অনেক ভালো মানুষ। তাদের দ্বারা আমি উপকৃত, আমার দ্বারা তারাও উপকৃত।

অধিকাংশ তরুণ উদ্যোক্তা ব্যবসায় টিকে থাকতে পারে না। কারণ কী? তাদের জন্য আপনার পরামর্শ…
আব্দুল মান্নান: তরুণ উদ্যোক্তাদের বেশিরভাগ ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় না বুঝে ব্যবসায় আসার জন্য। তারা অন্যকে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে দ্রুত লাভের আশায় বিনিয়োগ করে। ব্যবসার বাহ্যিক দিক দেখে যারা আসে তারাই ব্যর্থ হয়। ব্যবসা অনেক গভীরের বিষয়। টাকার আগে মেধা বিনিয়োগ করতে হয় এখানে। তরুণ ও নতুন উদ্যোক্তাদের বলব, যে যে ব্যবসাই শুরু করেন না কেন সেই ব্যবসার আদি-অন্ত ভালোভাবে জেনে-বুঝে শুরু করবেন।

সমাজের উন্নয়নে কাজ করছেন আপনি। শুনেছি, কোনো অসহায় মানুষকে খালি হাতে ফেরান না আপনি। বিশেষ করে গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার দায়িত্ব নেন। এ বিষয়ে কিছু বলুন…
আব্দুল মান্নান: আসলে জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছি। তাই অন্যের কষ্ট হৃদয় দিয়ে অনুভব করি। তাই এলাকার লোকজনের সঙ্গে সুন্দর সময় কাটানোর চেষ্টা করি। বিভিন্ন উৎসবে তাদের পাশে থাকি। এ বছর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য শতাধিক গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীকে যাবতীয় আর্থিক সহায়তা করেছি। আমি ধর্মভীরু মানুষ। আমি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ করি। নিজস্ব বোধ থেকেই মানুষের পাশে থাকি। যতদিন বাঁচব মানুষের সেবা করব। আল্লাহ আমাকে সম্পদ দিয়েছেন। আমি সেখান থেকেই অসহায়দের কিছু দিয়ে যাচ্ছি।
এই যে, আজ আমি সাক্ষাৎকার দিচ্ছি, এটা আমার কাছে ভীষণ আশ্চর্যের। সাক্ষাৎকার দেওয়ার যোগ্যতা আমার আছে, এটা আমি ভাবতে পারিনি কোনোদিন। আপনারা আমার কাছে এসেছেন এজন্য অনেক ধন্যবাদ। আমার কথায় যদি কেউ ন্যূনতম উপকৃত হন, তবে আমার জীবন সার্থক হবে।