আতাউর রহমান: দেশের পুঁজিবাজার এখন নিন্মমুখী অবস্থায় রয়েছে। উত্থানেও সূচক ও লেনদেন খুব বেশি বাড়ছে না। এই খারাপ সময়েও প্রতিনিয়ত চলছে শেয়ার কারসাজি। এর অন্যতম একটি খাত হচ্ছে বিমা। কয়েক সপ্তাহ ধরে খাতটির শেয়ারগুলোর দর বেড়েই চলেছে। ভালো কোম্পানির সঙ্গে বাড়ছে দুর্বল কোম্পানির শেয়ারও। খাতটির শেয়ারে কারসাজির ফলে তালিকাভুক্তির পর ব্যবসা বৃদ্ধি না পেয়ে বরং কমে গেলেও ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের শেয়ারদর দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠে এসেছে। বর্তমানে কারসাজির ফলে গত পাঁচ মাসে কোম্পানিটির শেয়ারদর প্রায় ২৭৩ শতাংশ বা তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১৩৩ টাকায় পৌঁছেছে। অথচ তালিকাভুক্তির পর থেকে কোম্পানির ব্যবসা কমে যাওয়া এবং ১০ শতাংশের বেশি লভ্যাংশ না দেয়ার পরও অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধিকে নিশ্চিত কারসাজি বলছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।
কোম্পানিটির শেয়ারদর ও লেনদেন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শেয়ারটির দর গত ১৬ এপ্রিল ছিল ৩৫ টাকা ১০ পয়সা। এর পর থেকে বাড়ছে কোম্পানিটির শেয়ারদর। প্রথম দফায় গত ২৯ মে ৫৪ টাকা ৪০ পয়সা পর্যন্ত বৃদ্ধি পায় শেয়ারদর। পরে কিছুটা সংশোধন হয়ে ৪০ টাকা ৯০ পয়সায় নেমে আসে। এবার দ্বিতীয় দফায় শেয়ারটির দর কারসাজির মাধ্যমে গত ৩০ জুলাই নেয়া হয় ৬৬ টাকা ২০ পয়সা পর্যন্ত। পরে আবার সংশোধনের মাধ্যমে শেয়ারটির দর কমে ৫৩ টাকা ৮০ পয়সায় দাঁড়ায়। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এবার শুরু হয় বড় ধরনের কারসাজি। শেয়ারটির দর কারাসাজি করে একটি চক্র চলতি মাসের ২১ তারিখ ১৩৩ টাকা পর্যন্ত ওঠায় এবং সবশেষ ১৩২ টাকা ৫০ পয়সায় লেনদেন হয়।
অন্যদিকে শেয়ারটির লেনদেনের চিত্রে দেখা যায়, গত ১৫ মে কোম্পানিটির মোট ১৩ লাখ ৪২ হাজারের বেশি শেয়ার লেনদেন হয়, যা আগের কয়েক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এরপর শেয়ারটির লেনদেন আরও বৃদ্ধি পায়। গত ২৫ মে মোট ২২ লাখ ৮০ হাজার শেয়ার লেনদেন হয়। এর দুই মাস পরে কোম্পানিটির মোট ৩০ লাখ ৮৭ হাজার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। পরে শেয়ার লেনদেন অনেকটা কমে যায়। কিন্তু এরপর আবার ৩ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটির মোট ৪৪ লাখ ৩৫ হাজার শেয়ার লেনদেন হয়। পরে শেয়ার লেনদেন আবার কমে যেতে থাকে। ২৪ সেপ্টেম্বর মোট ১০ লাখ ৩৫ হাজার শেয়ার লেনদেন হয়।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোম্পানিটি তিন বছর আগে শেয়ারপ্রতি ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে বা ফেসভ্যালুতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। কিন্তু তালিকাভুক্তির পর থেকে কোম্পানিটির ব্যবসা কমেছে। সেই সঙ্গে গত তিন বছরে কোম্পানিটি ২ টাকার বেশি মুনাফা করলেও ১০ শতাংশ বা শেয়ারপ্রতি ১ টাকার বেশি লভ্যাংশ দেয়নি। এরপরও শেয়ারটির দর এত বেশি কীভাবে বৃদ্ধি পায়? কোম্পানিটি মাত্র ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে তালিকাভুক্ত হয়েছে। তখন কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) ছিল ৪ টাকা ৫৮ পয়সা, যা গত দুই বছরে তিন টাকার নিচে বা অর্ধেকে নেমে এসেছে। অথচ সেই শেয়ারের দরই বেড়ে চলেছে, যা একটি চক্রের কারসাজি বলে মনে করা হচ্ছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারির বিষয়ে প্রশ্ন তুলে সংশ্লিষ্টরা বলেন, পুঁজিবাজারে গুড গভর্ন্যান্স ও গতিশীলিতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কাজ করে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বাজারে কোনো কারসাজি চক্র এবং অনিয়ম ও দুর্নীতিকারী পার পাবে না বলেও তারা একাধিকবার ঘোষণা দিয়েছে। এরপরও অযৌক্তিক ও অস্বাভাবিকভাবে এভাবে শেয়ারের দর বৃদ্ধি পাওয়া কি তাদের নজরে আসে না? আর নজরে এলেও সঙ্গে সঙ্গে কেন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না? যখন শেয়ারটির দর সর্বোচ্চ বৃদ্ধি পায় তখন তারা পদক্ষেপ নেয়। আর এর মধ্যে যা মুনাফা করার তা কারসাজি চক্র করে নিয়ে যায়। ফলে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। পরে কারসাজি ধরা পড়লেও করা হয় নামমাত্র জরিমানা, যা পুঁজিবাজারে কখনও কারসাজি বন্ধ করবে না বলে তারা জানান। তাই নিয়ন্ত্রককে আরও কঠিন হতে হবে এবং কঠোর শাস্তি দিতে হবে, যাতে দ্বিতীয়বার কেউ কারসাজি করার সাহস না পায়।
এদিকে কোম্পানিটির ২০২০ সালে তালিকাভুক্তির সময় সে বছর কর পরবর্তী মুনাফা হয়েছে ১১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। আর ইপিএস ছিল ৪ টাকা ৫৮ পয়সা এবং শেয়ার প্রতি নিট সম্পদমূল্য (এনএভি) হয় ২০ টাকা ৯৮ পয়সা। এর পরের বছর থেকে কোম্পানিটির ব্যবসা কমতে থাতে। ২০২১ হিসাববছরে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী মুনাফা হয়েছে ১১ কোটি ৩১ লাখ টাকা, ইপিএস ছিল ২ টাকা ৮৩ পয়সা এবং এনএভি হয়েছে ২২ টাকা ৮০ পয়সা। ২০২২ হিসাববছরে কোম্পানির কর-পরবর্তী মুনাফা হয়েছে ১০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা, ইপিএস হয়েছে ২ টাকা ৭২ পয়সা এবং এনএভি ছিল ২৪ টাকা ৩১ পয়সা। ফলে তিন বছরে কোম্পানিটির ব্যবসা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। তালিকাভুক্তির পর থেকে গত তিন হিসাববছরে কোম্পানিটি ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়ে এসেছে।
ব্যবসা কমে যাওয়ার পরও শেয়ারদর বৃদ্ধির বিষয়ে কোম্পানির সচিব এসএম শহিদুল্লাহর কাছে জানতে চাইলে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, শেয়ারদর বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে আমরাও চিন্তিত আছি। কয়েক বছর ধরে ডলার সংকট এবং সময়মতো ঋণ না পাওয়ায় ব্যবসা বৃদ্ধি পায়নি, বরং আরও কমেছে। কিন্তু এরপরও শেয়ারের দর বেড়েই চলেছে, যার পেছনে কোনো কারণ বা মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই। এটা নিশ্চিতভাবে কোনো কারসাজি চক্র কারাসাজির মাধ্যমে বাড়াচ্ছে। পরে শেয়ারদরে বড় পতন হলে তখন কোম্পানিকে দোষারোপ করা হবে এবং কোম্পানির সুনাম ক্ষুণœ হবে। তাই বড় ক্ষতির আগে নিয়ন্ত্রকদের এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কঠোর শাস্তির দাবি জানান তিনি।