ব্যাংকগুলোকে সতর্ক হওয়ার নির্দেশনা বাংলাদেশ ব্যাংকের

শেখ আবু তালেব: কাগুজে হিসাবে বাণিজিক ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচকগুলো ভালো অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে খেলাপি হওয়া ঋণকেও নীতিমালার কারণে খেলাপি দেখানো যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় নতুন ঋণচাহিদা তৈরি হচ্ছে। আগামী ডিসেম্বরের পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছাড় সুবিধার মেয়াদ বাড়ানো না হলে আমানত সংকটে পড়বে ব্যাংক খাত। এমন অবস্থায় মূলধন কাঠামো দুর্বল হয়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সম্ভাব্য সমস্যা মোকাবিলায় ব্যাংকগুলোকে সতর্ক থাকতে নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একইসঙ্গে মূলধন কাঠামো শক্তিশালী রাখতে একাধিক পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। সম্প্রতি এমন নির্দেশনা দিয়েছে ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে এমন তথ্য।

প্রসঙ্গত, আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো বকেয়া ঋণের ২৫ শতাংশ পরিশোধ হলে তাকে আর খেলাপি দেখানো যাবে না। আবার আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বেলায় এটি বকেয়া ঋণের ৫০ শতাংশ হতে হবে। একইসঙ্গে এককালীন এক্সিটের বেলায়ও ডিসেম্বর পর্যন্ত সুবিধা দেয়া হয়েছে।

সব মিলিয়ে করোনা মহামারির আঘাতে বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছাড় সুবিধা এখনও অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু বকেয়া ঋণগুলো এখনও আদায় হচ্ছে না। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী এসব ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। কিন্তু করোনাকালে সময়ের ছাড় সুবিধা দেয়ার জন্য এসব ঋণকে খেলাপি হিসেবে দেখাতে পারছে না ব্যাংকগুলো।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, গত এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত বকেয়া হওয়া ঋণ থেকে আদায় হয়েছে মাত্র এক হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। অথচ ব্যাংক খাতে খেলাপি ও আদায় না হওয়া ঋণের পরিমাণ হচ্ছে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে আগে কখনও এমন দুরবস্থা হয়নি।

ব্যাংকাররা বলছেন, ঋণের কিস্তি পরিশোধের নীতিমালায় শিথিলতার কারণে একটানা দুই বছর ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করার সুযোগ পেয়েছেন গ্রহীতারা। আগামী ডিসেম্বরের পরে ছাড় সুবিধা অব্যাহত না থাকলে বিশাল অঙ্কের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়বে একসঙ্গে।

বিশাল এই খেলাপি ঋণের বিপরীতে রাখতে হবে নির্দিষ্ট হারে প্রভিশন। তখন ব্যাংকের আমানতের একটি অংশ চলে যাবে প্রভিশন সংরক্ষণে। সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রভিশন সংরক্ষণ ও নতুন ঋণচাহিদা মেটাতে আমানতের ওপর চাপ বৃদ্ধি পাবে। এতে দুর্বল হয়ে পড়বে ব্যাংকের মূলধন কাঠামো। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, অর্থনীতি সচল হতে শুরু করায় ব্যাংকগুলোয় ঋণচাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ শুরু করেছে।

ঋণচাহিদা যে তৈরি হয়েছে, তার প্রতিফলন দেখা যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ আরেক প্রতিবেদন। তথ্য বলছে, ২০২০ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত বেসরকারি খাতে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ৯২ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা। এটি করোনা মহামারির আগের অবস্থার প্রায় কাছাকাছি। ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে ২০২০ সালের আগস্টে ঋণ বিতরণ হয়েছিল ৯৪ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি হচ্ছে আট দশমিক চার শতাংশ।

যদিও সামগ্রিকভাবে দেশের অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবৃদ্ধি সেভাবে বৃদ্ধি পায়নি। এর ব্যাখ্যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, মূলত সরকারি পর্যায়ে এখনও সেভাবে ঋণ চাহিদা তৈরি হয়নি। ফলে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবৃদ্ধি বেসরকারি খাতের চেয়ে সরকারি খাতে তুলনামূলকভাবে কম। গত আগস্টে সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ, গত বছরের এই সময়ে যা ছিল ৩৮ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের অর্থনীতির ৮০ শতাংশই বেসরকারি খাতনির্ভর। বেসরকারি খাত গতিশীল হওয়া মানে সরকারি খাতও শিগগিরই গতিশীল হবে। সর্বশেষ এপ্রিল থেকে জুন সময়ে শিল্প খাতেই ১৯ হাজার ৪৭০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হয়েছে। এ সময়ে বৈদেশিক সম্পদের পরিমাণও একইসঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে। এভাবে ঋণচাহিদা বাড়ছে ক্রমাগত। ফলে ব্যাংকগুলোর কাছে এখন নতুন সংকট দেখা দিয়েছে সম্ভাব্য আমানত চাহিদা পূরণের।

এ বিষয়ে বেসরকারি খাতের মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ঋণচাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে এটি সত্য। কিন্তু ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ কত তার প্রকৃত তথ্য বুঝতে আরও সময় লাগবে। ছাড় সুবিধা যদি আর বৃদ্ধি না করা হয়, তখন ব্যাংকগুলোকে প্রভিশন সংরক্ষণে যেতে হবে। তখন আমানতের চাপ বাড়বে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংকগুলো সমস্যায় পড়বে। এজন্য মূলধন কাঠামো শক্তিশালী করতে ভালো মানের ঋণ বিতরণ করতে হবে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ব্যাংকের মূলধন বাড়ানোর পদক্ষেপ অব্যাহত রাখতে হবে। এজন্য বিতরণকৃত ঋণের বিপরীতে মূলধনের পরিমাণ বেঁধে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ এখন কোনো ব্যাংক চাইলেই ইচ্ছামতো ঋণ বিতরণ করতে পারবে না। বিদ্যমান মূলধনের অনুপাত অনুযায়ী ঋণ বিতরণ করতে হবে।

এমন নির্দেশনা দেয়া হয়েছে ঋণের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণের হার চার শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোকে ঋণের বিপরীতে তিন শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলোকে আগামী বছর নতুন করে ১২ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা সংরক্ষণ করতে হবে। এজন্য এখন থেকেই ব্যাংকগুলোকে তাগাদা দিতে শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০