গত ১০ বছরে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ পুনরায় সমন্বয় করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। সুশাসনের অভাবে ব্যাংকগুলোর লোকসান হচ্ছে। আর ওই লোকসান সমন্বয় করা হচ্ছে সাধারণ জনগণের করের টাকা দিয়ে। যেখানে ব্যাংকগুলোরই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সরকারকে লভ্যাংশ দেওয়ার কথা সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সরকারকে উল্টো ব্যাংকগুলোর লোকসানের খেসারত দিতে হচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে বিসমিল্লাহ, হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক এবং ক্রিসেন্ট গ্রুপসহ আরও কয়েকটি কেলেঙ্কারি বেশ আলোচিত। জবাবদিহিতা নেই বলেই এসব সমস্যা বেশি তৈরি হচ্ছে। এটি প্রতিরোধ করতে এবং খেলাপি ঋণে সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কঠোর হতে হবে। গতকাল এনটিভির মার্কেট ওয়াচ অনুষ্ঠানে বিষয়টি আলোচিত হয়।
আহমেদ রশীদ লালীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিএসইসির সাবেক সচিব ও চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর মুরশিদ কুলী খান।
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, নির্বাচনের আগে দুই থেকে তিন মাস বাজার মন্দাবস্থায় ছিল। নির্বাচনের পর কয়েক সপ্তাহে বাজার দ্রুত বেড়েছে। যেহেতু নির্বাচনের পর দেশে কোনো সহিংস পরিস্থিতি ছিল না। বিনিয়োগকারীরা বাজার নিয়ে নতুন করে আশাবাদী হয়ে ওঠেন। সে কারণে কয়েক সপ্তাহ বাজার দ্রুত বেড়েছে। অনেকটা যুক্তিহীনভাবেই বেড়েছে। তাই এখন কিছুটা সংশোধন হচ্ছে। তবে এটা বাজারের জন্য ভালো। কিছু মুনাফা তুলে নেওয়া হচ্ছে আবার নতুন বিনিয়োগও হচ্ছে। তাই বাজার নিয়ে তেমন হতাশ হওয়ার কিছু নেই বলে মনে করি।
তিনি আরও বলেন, দেশের ব্যাংক খাতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাওয়া নন পারফরমিং লোন বা খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১১ শতাংশ এবং এর সঙ্গে রিসিডিউলিংসহ আরও কিছু যোগ করলে ১৮ থেকে ১৯ শতাংশ হবে। এখন বেশিরভাগ ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। খেলাপি ঋণ বাড়ার মূল কারণ দেশে সুশাসনের অভাব। এটি সব বিভাগেই দেখা যায়। বিগত কয়েক বছরে ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে বেসিক ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫৫ শতাংশ। এটি মূলত সুশাসনের অভাবে হয়েছে। গত ১০ বছরে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ রি-ক্যাপিটালাইজ করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। এ টাকা কর প্রদানকারী সাধারণ জনগণের। এটি আসলে দুঃখজনক। সুশাসনের অভাবে ব্যাংকগুলোর লোকসান হচ্ছে। আর ওই লোকসান সমন্বয় করা হচ্ছে সাধারণ জনগণের করের টাকা দিয়ে। যেখানে ব্যাংকগুলোরই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সরকারকে লভ্যাংশ দেওয়ার কথা সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সরকারকে উল্টো ব্যাংকগুলোর লোকসানের খেসারত দিতে হচ্ছে। আবার ব্যাংক আইনে যে সংশোধন হয়েছে তাতে একই পরিবারের চারজন সদস্য টানা ৯ বছর পর্যন্ত ব্যাংকের পরিচালক থাকতে পারবে। সেক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো পরিবার কেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ওই সব প্রতিষ্ঠানে কীভাবে করপোরেট গভর্ন্যান্স সঠিকবাবে পরিপালন করা যাবে বা কীভাবে জবাবদিহিতায় আনা যাবে সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। ব্যাংক পরিচালনায় বড় ধরনের সমস্যা রয়ে যাবে। অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারতে ব্যাংক আইনানুসারে, কোনো ব্যবসায়ী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে বসতে পারবে না। কিন্তু শেয়ার ধারণ করতে পারবে। অর্থাৎ সে দেশে ব্যাংক পরিচালনায় স্বাধীন পরিচালকের সংখ্যা বেশি। আর এদেশে তার বিপরীত চিত্র দেখা যায়। এখন সময় এসেছে এসব বিষয়ে পরিবর্তন আনার। আবার মানি মার্কেটের সঙ্গে ক্যাপিটাল মার্কেট প্রতোক্ষভাবে জড়িত না থাকলেও পরোক্ষভাবে জড়িত। যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক মানি মার্কেটে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, তখন এর কিছু প্রভাব ক্যাপিটাল মার্কেটে পড়ে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বিএসইসি একসঙ্গে বসে পারস্পরিক সমন্বয়ের ভিত্তিতে পুঁজিবাজারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। এক সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বিএসইসির এক সঙ্গে বসে নিয়মিত সভা হত। এখন কী কারণে সেটা বন্ধ হয়েছে জানি না।
মুরশিদ কুলী খান বলেন, ব্যাংক খাতের যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ সেটি দেশের ব্যাংক খাতে নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহু বছর ধরে খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি চলে আসছে। এটি উদ্বেগজনক। এখানে মূল সমস্যা হচ্ছে জবাবদিহিতা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা করতে হয় না। বিগত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। যেমন বিসমিল্লাহ, হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক এবং ক্রিসেন্ট গ্রুপসহ আরও কয়েকটি কেলেঙ্কারি বেশ আলোচিত। কথা হচ্ছে কীভাবে ওইসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাংক ঋণ দিল এবং এর পেছনে কারা জড়িত। জবাবদিহিতা নেই বলেই এসব সমস্যা বেশি তৈরি হচ্ছে। এটি প্রতিরোধ করতে হলে রাজনৈতিকভাবে কঠোর প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে। আর খেলাপি ঋণে সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কঠোর হতে হবে।
শ্রুতিলিখন: শিপন আহমেদ