ব্যাংকগুলো বড়দের ঋণ দিতে আগ্রহী, ছোটদের প্রতি অনীহা

রোহান রাজিব: মহামারি কভিডের আর্থিক ক্ষতি মোকাবিলায় ২০২০ সালের এপ্রিলে কম সুদের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর ধাপে ধাপে বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের জন্য কম সুদে আরও বেশ কয়েকটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ১০টি প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এসব প্যাকেজের আওতায় ব্যাংকগুলো কম সুদে গ্রাহকদের ঋণ দিচ্ছে, যেখানে প্রায় অর্ধেক সুদ ভর্তুকি হিসেবে দিচ্ছে সরকার। তবে প্রণোদনার ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো ছোট ব্যবসায়ীদের থেকে বড়দের প্রতি আগ্রহ বেশি দেখিয়েছে। যার ফলে ছোট উদ্যোক্তাদের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঋণ বিতরণ হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, কভিডকালীন ছোট ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবুও তারা কম ঋণ পাচ্ছে। ব্যাংকগুলো বড় ঋণগ্রহীতাদের ঋণ বিতরণ দিকে বেশি ঝুঁকে। আর ছোট ঋণগ্রহীতাদের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ পেতে নানা জটিলতার সম্মুখীন হয়। তাই অনেক সময় এসব ঋণগ্রহীতার ঋণ পেতে আগ্রহ হারায়।

প্রণোদনা প্যাকেজের প্রথম পর্যায়ের পর এবার দ্বিতীয় পর্যায়ের বিতরণ কার্যক্রম ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে দ্বিতীয় মেয়াদে অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি (সিএমএসএমই) শিল্পে প্রণোদনা ঋণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে ২০ হাজার কোটি টাকা। তবে বিদায়ী অর্থবছরের (জুলাই-জুন) ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১৩ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৬৭ দশমিক ৫২ শতাংশ। আর সিএমএসএমই প্যাকেজের আওতায় ক্রটেজ, মাইক্রো, স্মল (সিএমএস) খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম (সিজিএস) দুই হাজার কোটি টাকা স্কিম চালু করে। তবে এ স্কিমের অর্থবছর শেষে মাত্র ১২১ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৬ শতাংশ।

তবে বড় ব্যবসায়ীদের জন্য রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আওতায় ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের শতভাগ বিতরণ হয়। কাঁচামাল আমদানির জন্য ব্যাক-টুু ব্যাক ঋণ (এলসি) পত্রের আওতায় ২ শতাংশ সুদে এ প্রণোদনা দেয়া হয়। এতে বিদায়ী অর্থবছরের জন্য ২৯ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ঘোষণা করা হয়। যার শতভাগ বিতরণ হয়। এতে বোঝা যায়, ব্যাংকগুলো ছোট ব্যবসায়ীদের থেকে বড়দের ঋণ দিতে বেশি আগ্রহী।

এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, সাধারণত আমরা দেখি ছোটদের ঋণ বিতরণ টার্গেটের থেকে সবসময়ই কম হয়ে থাকে। কারণ ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে সুপারভিশন করতে হয়; এমন নানা কারণে ব্যাংকগুলোর ছোটদের দেয়ার ব্যাপারে কিছুটা অনীহা থাকে। প্রণোদনার শুরু থেকেই আমরা বলছি ছোট এবং মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণের বিষয়ে ব্যাংকগুলো যাতে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়।

তিনি বলনে, ছোটদের ঋণ বিতরণে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া এবং টার্গেট পূরণ করার বিষয়ে আমরা বলে থাকি। কারণ ছোটদের ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে তাদের কর্মসংস্থান জড়িত। ছোটরা সাধারণত শ্রমনির্ভর হয়। ছোটদের ঋণ বিতরণ অর্থনীতির জন্যও অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণে কিছু কনফিডেন্স দরকার। সেক্ষেত্রে ছোট উদ্যোক্তাদের ফরমালিটি পূরণে নানা বাধ্যকতার কারণে ছোট উদ্যোক্তারা অনেকটা কম ঋণ পায়। এজন্য বিভিন্ন দেশে এবং আমাদের দেশের কিছু কিছু ব্যাংক (বিকাশ-নগদ) অথবা অন্য প্ল্যাটফর্মে লেনদেনের ট্রানজেকশনের ওপর ভিত্তি করে তারা ঋণ দিচ্ছে। এসব ইনভেটিভ উদ্যোগকে আরও উৎসাহ দেয়া দরকার। বিশেষ করে নতুন অর্থবছরের জন্য সিএমএসএমই খাতে ২৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা স্কিম ঘোষণা করা হয়েছে। আমি বলব যেসব ব্যাংকের মাধ্যমে এটা বাস্তবায়ন হবে তারা যেন টার্গেট পূরণ করে। কোয়াটারলি এটাকে মনিটর করতে হবে।

কভিডের ক্ষতি মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত সরকার মোট ২৮টি প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। সবমিলিয়ে এসব প্যাকেজের অর্থের পরিমাণ ১ লাখ ৮৭ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা। পরবর্তীতে ‘রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল’ বা ইডিএফে আরো ৫০ কোটি ডলার যুক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ১০টি প্রণোদনা প্যাকেজ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। যার আর্থিক মুল্য ১ লাখ ৬৮ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।

দ্বিতীয় মেয়াদে ১০টি প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় গ্রাহকদের মাঝে ঋণ বিতরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এরমধ্যে অর্থবছর শেষে বিতরণ করা হয়েছে ৬৯ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৬৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। 

ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানের জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল প্রণোদনার ঋণের বিদায়ী অর্থবছরে ৩৩ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা ছিল। অর্থবছর শেষে ১২ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা বিতরণ হয়েছে। এ সময়ে এ স্কিম থেকে সুবিধা নিয়েছে ১ হাজার ৩১১টি শিল্প প্রতিষ্ঠান। এর আগের (২০২০-২১) অর্থবছরে এ খাতে ৪০ হাজার কোটি টাকার ঋণের প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। সেই সময়ে সুবিধাভোগীর সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৩০৬টি শিল্প প্রতিষ্ঠান।

এছাড়া প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিমের ঘোষণা করা হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা। এ প্যাকেজ থেকে ৭০টি প্রতিষ্ঠান ৭২৫ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছে। যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ১৪ দশমিক ৫১ শতাংশ।

যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন রিপোর্টে উঠে এসেছে কভিডের প্রথম পর্যায়ে প্রণোদনা ঋণ এক খাতের জন্য নিয়ে অন্য খাতে ব্যয় হয়েছে। প্রণোদনা ঋণের টাকা নিয়ে আগের ঋণের সুদের সমন্বয় করেছে এমন অভিযোগ পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যার ফলে অনেক ব্যাংক দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রণোদনা ঋণের সুদ ভর্তুকি বাবদ অর্থ সøথ গতিতে ছাড় করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর কারণে প্রণোদনা ঋণে প্রভাব পড়েছে।

এদিকে নিম্ন আয়ের পেশাজীবী কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য পুনঃঅর্থায়ন স্কিমে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে অর্থবছর শেষে ৩ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ হয়েছে। যা লক্ষ্যমাত্রার ১১১ দশমিক ৯৬ শতাংশ।

পর্যটন খাতের হোটেল/মোটেল/ থিম পার্কের কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদির জন্য ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এ প্যাকেজের আওতায় ঋণ বিতরণের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো স্থিতি ও চাহিদার ভিত্তিতে সীমা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া কৃষি খাতে পুনঃঅর্থায়ন স্কিমের আওতায় ৩ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ২ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। যা লক্ষ্যমাত্রার ৯২ শতাংশ।

এদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ- সিএমএসএমই খাতে ২৫ হাজার কোটি টাকার রিফাইন্যান্স স্কিম গঠনের ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে ঋণ সুবিধা হিসেবে ৩০ হাজার কোটি টাকা ঘোষণা করা হয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০