রোহান রাজিব: দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এক্সটার্নাল অডিট বা বহিঃনিরীক্ষা করার বিষয়ে আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকাভুক্ত নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই বহিঃনিরীক্ষা সম্পন্ন করতে হয়। বহিঃনিরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান বস্তুনিষ্ঠভাবে ব্যাংকের সার্বিক কার্যক্রম তাদের প্রতিবেদনে তুলে ধরবে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট মক্কেল ব্যাংককে সন্তুষ্ট রাখতে ব্যাংকের চাহিদামতো নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করে। ফলে ব্যাংকের অনিয়ম ও ত্রুটির চিত্র উঠে আসে না।
এমন পরিস্থিতিতে বহিঃনিরীক্ষা প্রতিবেদনে যাতে ব্যাংকের অনিয়মের চিত্র উঠে আসে, সে বিষয়টি নিশ্চিতে ব্যাংক-কোম্পানির আইনের নির্দিষ্ট ধারা বলে একটি বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই বিধিমালায় একটি নির্দিষ্ট ছকে বিভিন্ন ধরনের তথ্য তুলে ধরতে হবে। ছকটি এমনভাবে সাজানো হবে, যাতে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ব্যাংকের ভালোমন্দ সব ধরনের চিত্র সঠিকভাবে উঠে আসে। কোনো নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান এ-সংক্রান্ত বিধিমালা অনুসরণ করে নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রণয়ন করতে ব্যর্থ হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ারও সুযোগ থাকবে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিধিমালাটির খসড়া প্রস্তুত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেয়া হয়েছে বিজ্ঞজনের মতামত গ্রহণের জন্য। সার্বিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শিগগির এ বিধিমালাটি আনুষ্ঠানিকভাবে জারি করবে বলে জানা গেছে। এটি পরিপালন করা হলে ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদনের জোচ্চুরি অনেকটাই লাঘব হবে বলে আশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
খসড়া অনুযায়ী, কোনো বহিঃনিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব পালনে অবহেলা বা ব্যর্থ হলে তাকে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী অযোগ্য বলে ঘোষণা করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো সার্কুলার/নির্দেশনা অমান্য বা লঙ্ঘন করলে ওই বহিঃনিরীক্ষককে বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকা থেকে বাদ দিতে পারবে।
এছাড়া কোনো ব্যাংকের বহিঃনিরীক্ষা সঠিকভাবে সম্পন্ন না হলে এবং আর্থিক অবস্থা ও সংশ্লিষ্ট সময়ের লাভ-ক্ষতির হিসাব নিরীক্ষিত প্রতিবেদনে সঠিকভাবে না আসলে বাংলাদেশ ব্যাংক অন্য বহিঃনিরীক্ষক নির্ধারণ করে পুনরায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নিজ খরচে বহিঃনিরীক্ষা সম্পন্ন করার নির্দেশ দিতে পারবে।
খসড়ায় আরও বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক সময় সময় বহিঃনিরীক্ষার জন্য অনুমোদিত বহিঃনিরীক্ষকের তালিকা দেবে। তাদের বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যেকোনো ব্যাংকের জন্য একাধিক বহিঃনিরীক্ষক নিয়োগ দিতে পারবে, যার খরচ ব্যাংক বহন করবে।
বহিঃনিরীক্ষার আওতা ও দাখিলযোগ্য প্রতিবেদন
বহিঃনিরীক্ষক নিরীক্ষা বছরের সর্বশেষ তারিখভিত্তিক ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন বা বিবরণী তৈরি করবে। ওই সময়ের লাভ-ক্ষতির হিসাব ও অন্যান্য হিসাব নিরীক্ষা করবে। কোনো ব্যাংকে একের অধিক বহিঃনিরীক্ষক নিয়োজিত করলে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়কে যৌথভাবে নিরীক্ষা করতে হবে। কোন কোন শাখা কোন বহিঃনিরীক্ষক দ্বারা নিরীক্ষিত হবে, তা ব্যাংক নির্ধারণ করবে।
এছাড়া বহিঃনিরীক্ষককে পাঁচ ধরনের প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। তা হলোÑঅন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন, ব্যবস্থাপনা প্রতিবেদন, বিশেষ প্রতিবেদন, গোপনীয় প্রতিবেদন এবং চূড়ান্ত প্রতিবেদন।
অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে বহিঃনিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানটি ঋণ শ্রেণিকরণ ও ঋণের বিপরীতে সংগঠিত অনিয়ম; বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেন ও ঋণসংক্রান্ত অনিয়ম; সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে
বাংলাদেশ ব্যাংকে দাখিলকৃত তথ্য/বিবরণীতে অনিয়ম; ৬ মাসের বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের তথ্য এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোয় (সিআইবি) যথাসময়ে তা দেয়া হয়েছে কি না এবং মাসিকভিত্তিতে তারল্য সংরক্ষণ সম্পর্কিত পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে।
ব্যবস্থাপনা প্রতিবেদনের জন্য ঋণ শ্রেণিকরণ, ঋণের বিপরীতে রাখা সম্পদ ও মুনাফা হিসাবের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নির্দেশনা যথাযথভাবে পালন করা হয়েছে কি না, তা সঠিকভাবে দিতে হবে। এছাড়া নিরীক্ষাধীন শাখাগুলোর অবলোপনকৃত, পুনঃতফসিলকৃত বা পুনঃগঠিত ঋণ হিসাব এবং মওকুফকৃত সুদ-সংক্রান্ত তথ্য যথাযথভাবে রেজিস্টার বা লেজারে সংরক্ষণ করা হয়েছে কি না, তাও যাচাই-বাছাই করতে হবে।
বিশেষ প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে ব্যাংক কোম্পানি আইনের কোনো ধারা বা নির্দেশনার লঙ্ঘন, অসততা ও প্রতারণা-সংক্রান্ত ফৌজদারি অপরাধ ঘটলে বা ব্যাংকের সংরক্ষিত মূলধন আবশ্যক মূলধনের ৫০ শতাংশের নিচে নেমে গেলে বা নামার সম্ভাবনা তৈরি হলে, পাওনাদারদের পাওনা প্রদানের নিশ্চিয়তা বিঘ্নিত হলে, গুরুতর অনিয়ম ঘটলে, পাওনাদারদের পাওনা মেটানোর জন্য ব্যাংক-কোম্পানির সম্পদ যথেষ্ট কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকলে বহিঃনিরীক্ষক অবিলম্বে বাংলাদেশ ব্যাংককে বিশেষ প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানাতে হবে।
গোপনীয় প্রতিবেদনের জন্য বহিঃনিরীক্ষাকালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘন এবং সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্টিং (এসটিআর) ও নগদ লেনদেন রিপোর্টিং (সিটিআর) সংক্রান্ত কোনো অনিয়ম পাওয়া গেলে বহিঃনিরীক্ষক এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) গোপনীয় প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে।
বহিঃনিরীক্ষক নিয়োগ
বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকাভুক্ত বহিঃনিরীক্ষকের মধ্যে থেকে বার্ষিক সাধারণ সভার মাধ্যমে একটি বহিঃনিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করবে। নির্বাচন করার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তির জন্য আবেদন করতে হবে। ব্যাংকগুলো নিরীক্ষা বছরের ৩১ আগস্টের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তিসহ বহিঃনিরীক্ষক নিয়োগের সব প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। নিরীক্ষা কার্যক্রম যথাযথভাবে শেষ করতে ব্যাংক বহিঃনিরীক্ষককে প্রয়োজনীয় সব তথ্য ও দলিলাদি যথাসময়ে দিতে হবে। প্রয়োজনীয় হিসাব বা তথ্যাদি সরবরাহে দেরি করলে নিরীক্ষা কাজ শুরু বা শেষ করতে দেরি হলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে। এছাড়া একই বহিঃনিরীক্ষককে তিন বছরের বেশি সময়ের জন্য নিয়োগ করা যাবে না।