কভিডের প্রণোদনা বাস্তবায়ন

ব্যাংকের অসহযোগিতায় ক্ষুব্ধ পরিকল্পনামন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক: নভেল করোনাভাইরাসজনিত রোগ কভিড-১৯ এর প্রভাব মোকাবিলায় সরকার ঘোষিত প্রণোদনার ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলো সহযোগিতা করছে না বলে জানিয়েছেন অর্থ সচিব। এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো আইন মানতে বাধ্য। প্রণোদনার ঋণ কেন বিতরণ করা হবে না? নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে দেখতে হবে।

রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে কভিড-১৯ মোকাবিলা এবং টেকসই অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সরকারের নেয়া প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিক আলোচনার দ্বিতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হয় গতকাল। গতকালের আলোচনার প্রতিপাদ্য ছিল ‘কর্মসৃজন ও গ্রামীণ অর্থনীতি পুনরুজ্জীবন’। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। আলোচক হিসেবে অংশ নেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য (জ্যেষ্ঠ সচিব) ড. শামসুল আলম, এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আবাসিক প্রতিনিধি মনমোহন পারকাশ ও এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন ড. মো. মাসুদুর রহমান। সংলাপে অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, গবেষক, সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধি, সরকারি কর্মচারী, ব্যাংকার ও সাংবাদিকরা অংশ নেন।

সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার। তিনি উল্লেখ করেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় কয়েকটি বিষয় খেয়াল রেখে পরিকল্পনা করা হয়। এ সময় লক্ষ্য ঠিক করা হয়, মহামারিতে যেন প্রাণহানির সর্বনি¤œ পর্যায় থাকে, কর্মসংস্থানের সুযোগ অব্যাহত থাকে ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেন সচল থকে। এটি চিন্তা করেই প্রণোদনার ঋণ প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। আর এতে সুফল পাওয়া যায়। গত মার্চ থেকে শুরু হওয়া এ মহামারিতে নভেম্বর পর্যন্ত আট মাস অতিক্রম করেছে।

তিনি উল্লেখ করেন, গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে শূন্য দশমিক ৯৪ শতাংশ। এটি গত অর্থবছরের আলোচিত সময়ের তুলনায়। ওই সময়ে অর্থনীতি ভালো ছিল। আমাদের বেসরকারি বিনিয়োগও সাড়ে ৯ শতাংশের ঘরে। কিন্তু আমদানি কমে আসছে। এর কারণ হচ্ছে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি না হওয়া।

প্রশ্নোত্তরসহ বিভিন্ন আলোচনায় উঠে আসে, প্রণোদনার প্রভাব মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। কৃষি খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, খাত অনুযায়ী প্রণোদনা দেয়া, ব্যাংকগুলোর ওপর তদারকি বৃদ্ধি, এনজিওদের কাজে লাগানো ও প্রণোদনা বাস্তবায়নে নিয়মিত তথ্য সরবরাহ করা।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘প্রণোদনার অর্থ আমরা পাঠাচ্ছি। কিন্তু তার বড় একটা অংশ যাচ্ছে না। আমাদের চ্যানেলটাই হচ্ছে ব্যাংকিং।’ আমি কাউকে দোষ দেব না। অর্থ সচিব আমাকে অভিযোগ করে বলেছেন, ঋণ বিতরণে ব্যাংকের কাছ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছেন না। এখানে অর্থ সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আছেন, ব্যাংকগুলো থেকে অনেকেই সহায়তা পাননি। কেন এটা হলো? আমাদের অর্থ ছিল, অর্থ দিয়েছি। আজকে এখানে আর্থিক খাতের দুই প্রধান ব্যক্তি উপস্থিত আছেন। আমি বলব, ব্যাংকগুলো আইন মানতে বাধ্য, আইনকে অসম্মান করা যাবে না। তাহলে কী করতে হবে? যদি কোনো ব্যাংক আপনার কথা না মানে তাহলে প্রয়োজনে ব্যবস্থা নিতে পারেন। কারণ, আমরা সবাই একই পথের যাত্রী।

পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘আইন মানতে কোথায় সমস্যা হচ্ছে, তা খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। আলোচনা করতে হবে, উপায় বের করতে হবে।’ এ সময় তিনি আরও বলেন, প্রণোদনার ঋণ ভুল জায়গায় যাচ্ছে। শুধু প্রণোদনার প্যাকেজ ঘোষণা করলেই হবে না এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে কোথায় যাচ্ছে অর্থ। প্রয়োজনে সংস্কার করতে হবে।

কর্মসৃজনের জন্য খরচ করতে হবে। শুধু খরচ আর খরচ করতে হবে। কিন্তু বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে খরচ করতে হবে। তাহলে চাহিদা তৈরি হবে। উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে। কারখানা সচল হবে।

এ সময় তিনি গবেষণা সংস্থা ও সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, করোনাকালীন সময়েও কীভাবে রেমিট্যান্সে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হচ্ছেÑতার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করা দরকার। সরকারের দুই শতাংশের প্রণোদনা ও হুণ্ডি বন্ধ হওয়ায় এটি হয়েছে। এর বাইরেও কোনো কারণ আছে কি না তা দেখা দরকার।

ফজলে কবির বলেন, গ্রামীণ অর্থনীতি ও পরিবেশ বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্র্যের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। প্রণোদনা ঋণের প্রায় অর্ধেক বিতরণ হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শতভাগ না হলেও ৯০ ভাগ অর্থছাড় দেয়া সম্ভব হবে। কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) খাতে দেয়া প্রণোদনার মাত্র ৪১ শতাংশ উদ্যোক্তাদের কাছে গিয়েছে।

প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে ড. শামসুল আলম বলেন, এ প্যাকেজ সব স্তরের ব্যক্তির কাছে পৌঁছেছে। গত জুলাই থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের অর্থনীতি। এখন আমাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে হবে। এজন্য প্রণোদনার আওতা বাড়ানো প্রয়োজন। আর এটা করতে গেলে অবশ্যই ক্ষুদ্র অর্থনীতিকে আমলে নিয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। এশিয়ান প্লাসসহ জোটভিত্তিক ও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণের দিক নিয়েই ভাবতে হবে।

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এটা ভালো দিক যে এই মহামারিকালেও বাংলাদেশ খাদ্য সংকটে পড়েনি। আমাদের কৃষি খাত ভালো ছিল। অনেক দেশেই খাদ্য সমস্যায় পড়েছে। বর্তমানে তরুণ প্রজš§ও কৃষির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে। এজন্য কৃষি খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার ও মধ্যস্বত্বভোগী বাদ দিয়ে সরাসরি বাজারজাতের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। যাতে কৃষকরা ন্যায্য দাম পায়।

তিনি বলেন, আমাদের দেশের কর্মসংস্থানের ৪০ ভাগই কৃষি খাতের আর জিডিপির ১৩ শতাংশের জোগানও দিয়ে থাকে এ কৃষি খাতই। তাই ঋণসুবিধা, নীতিগত সুবিধা ও পণ্যের বাজারজাতকরণে এ খাতের সঙ্গে যুক্তদের পাশে থাকতে হবে। স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বিশ্ববাজারের সংযোগ স্থাপন করতে হবে।

মনমোহন পারকাশ বলেন, করোনাভাইরাসের প্রভাব শহরের তুলনায় গ্রামীণ এলাকায় অনেক কম। কারণ হচ্ছে, গ্রামে ঘনবসতি নেই, আবহাওয়ার গুণগত মান ভালো। গ্রামে উৎপাদন পরিবেশ ছিল। তাই গ্রামীণ অর্থনীতিকে সামনে রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নেয়া উচিত। এজন্য কৃষিপণ্য সরাসরি বাজারে প্রবেশ করানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তির ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাহলে উৎপাদন বেশি হবে। এতে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান দুই দিক থেকেই সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি।

মাসুদুর রহমান বলেন, করোনা মোকাবিলায় সিএসএমই খাতে দেয়া ২০ হাজার কোটি টাকার সবেমাত্র অর্ধেক পরিমাণ অর্থ উদ্যোক্তাদের কাছে পৌঁছানো গেছে। আর ঋণ প্রাপ্তির নানা শর্তে ৮০ শতাংশ উদ্যোক্তাই এ ঋণের বাইরে থেকে যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি এ কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা করোনার কারণে পুঁজি হারিয়েছেন।

শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, আগামী বছরই শক্তমতো ঘুরে দাঁড়াবে দেশের অর্থনীতি। সে লক্ষ্য সামনে রেখেই উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করতে কাজ করছে এফবিসিসিআই।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০