নিজস্ব প্রতিবেদক: করোনায় ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ তলানিতে নেমেছে। ব্যবসায়ীরা সঠিকভাবে ও সঠিক সময়ে কাজে লাগাতে পারছেন না সরকারঘোষিত প্রণোদনার টাকা। গত বছর থেকে উৎসবভিত্তিক অর্থনীতিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে টাকা ঘুরছে না, আবার চলে যাচ্ছে ব্যাংকে। এতে ব্যাংকগুলোয় বাড়ছে আমানতের পরিমাণ।
ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিতে ধীরগতি রয়েছে। করোনার কারণে ঋণ বিতরণ আরও কমেছে। কিন্তু আমানতের সংগ্রহ স্বাভাবিক থাকায় ব্যাংকের তারল্য বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ব্যাংক খাতে আমানত ছিল ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা, যা জুলাই মাসের তুলনায় এক দশমিক ১২ শতাংশ বেশি। অপরদিকে আগস্ট শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ৩১ হাজার ৯৭৪ কোটি টাকা। এ অঙ্ক জুলাইয়ের তুলানায় শূন্য দশমিক সাত শতাংশ বেশি। ঋণ প্রবৃদ্ধি আমানত প্রায় অর্ধেক। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ১০-এর নিচে রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, নতুন অর্থবছরের কোনো মাসেই আট শতাংশের ঘর অতিক্রম করতে পারেনি বেসরকারি বিনিয়োগ। আগস্টে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ছিল আট দশমিক ৪২ শতাংশ। আশানুরূপ ঋণচাহিদা না থাকায় দেশের ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য দুই লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, মহামারির কভিডে একটা শ্রেণির মানুষের আয় বেড়েছে। কিন্তু আয় বাড়লেও তাদের খরচ কম হয়েছে। আবার টাকা থাকা সত্ত্বেও অনেকে নতুন বিনিয়োগ করতে পারেনি।
তিনি জানান, একসময় বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ২১ থেকে ২২ শতাংশে উঠেছিল। গত অর্থবছরে এটা ৮-৯ শতাংশে নেমে এসেছে। যখন বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কম হয়, তখন উদ্বৃত্ত অর্থ থেকে যায়। ওই অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করার সুযোগ থাকে। কিন্তু সবাই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নয়, কারণ এখানে ঝুঁকি থাকে। এছাড়া সঞ্চয়পত্রের বিভিন্ন শর্তের কারণে সবাই যেতে চায় না। তাই সহজে ব্যাংকে আমানত হিসাবে জমিয়েছে, যার কারণে আমানত বেড়েছে।
আমানত বাড়লেও ঋণ কমে যাওয়ার কারণ হিসাবে সাবেক এ অর্থ উপদেষ্টা বলেন, মহামারির চলমান পরিস্থিতিতে টিকে থাকার চেষ্টা চালিয়ে
যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। অনেকে সংকটে টিকে থাকতে বিদ্যমান ব্যবসা সংকুচিত করছেন। এমন অবস্থায় ঝুঁকি নি?য়ে নতুন করে বিনিয়োগে আসতে চা?চ্ছেন না উদ্যোক্তারা। এ কারণে ব্যাংকগু?লো ঋ?ণ দেয়ার জন্য গ্রাহকও পাচ্ছে না। ফ?লে ঋণপ্রবা?হ কমে গেছে।
মহামারির মধ্যেও প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক। একই সঙ্গে গত ১০ বছর ধরে বাংলাদেশের আয়বৈষম্য ব্যাপকহারে বেড়েছে। যখন আয় বাড়ে সঙ্গে সঙ্গে আয়বৈষম্য বাড়ে, তখন উচ্চ আয়ের মানুষের অর্থের জোগান বেড়ে যায়, এটা একটা কারণ। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, এখন বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না। এসব কারণেই বড় আমানতকারীর সংখ্যা বাড়ছে বলে তিনি জানান।
এদিকে মহামারি কভিডকালে ঋণ বিতরণ প্রথম দিকে প্রায় বন্ধ ছিল। পরে কভিড-১৯-এর কারণে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারের নির্দেশনায় মোট ২৮টি প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। সবমিলিয়ে এসব প্যাকেজের অর্থের পরিমাণ এক লাখ ৩১ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক লাখ তিন হাজার ২৫০ কোটি টাকার ৯টি প্যাকেজ বাস্তবায়িত হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে। বছর শেষে এসব প্যাকেজের সার্বিক বাস্তবায়নের হার ছিল প্রায় ৮০ শতাংশ। এ কারণে কিছুটা ঋণ বিতরণ হয় ব্যাংক খাতে।
প্রথম দফায় প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ বিতরণে ভালো সারা পাওয়া গেলেও দ্বিতীয় দফায় তেমন অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। তিন মাস পার হলেও বিশেষ এ প্যাকেজ বাস্তবায়নের হার এক থেকে দুই শতাংশেই ঘুরপাক খাচ্ছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, প্রথম দফায় দেয়া প্রণোদনার ঋণ নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেলেও বেশিরভাগ গ্রাহক পরিশোধ করতে পারছেন না। উল্টো এখন ব্যাংকের কাছে বাড়তি সময় চাচ্ছেন তারা। এতে উভয় সংকটে পড়েছেন ব্যাংকাররা। একদিকে সময় বাড়িয়ে না দিলে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাবে, এতে বাড়তি প্রভিশন রাখতে গিয়ে কমে যাবে আয়। অপরদিকে বাড়তি সময় দিলে ঋণ আদায়ের হার কমে যাবে। এতে প্রভাব পড়বে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতার ওপর। এসব কারণে দ্বিতীয় দফায় ঋণে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না ব্যাংকাররা।
এ বিষয়ে দ্বিতীয় প্রজন্মের এক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণেই মূলত আমানতের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে টাকাটা বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের কথা ছিল, করোনার ভয়ে এখন সেগুলো আমানত হিসেবে গচ্ছিত থেকে যাচ্ছে। আগের ঋণ এখন বেশিরভাগ গ্রাহক ফেরত দিতে পারছেন না। ফলে বাধ্য হয়ে ঋণ বিতরণে সংকোচনমূলক ভূমিকা পালন করতে হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, করোনার মধ্যে যারা ঋণ নিয়েছেন তারা সে অর্থ ফেরত না দিয়েও নতুন করে ঋণ চাচ্ছেন, পাশাপাশি সুদ মওকুফের আবেদন। ঋণ আবেদনের চেয়ে এখন সুদ মওকুফের আবেদনের সংখ্যা বেশি। সবমিলিয়ে নানামুখী চাপে রয়েছে ব্যাংকগুলো।