Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 10:30 pm

ব্যাংকে দেনা রেখে পালালেন মোস্তফা গ্রুপ এমডি

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামভিত্তিক মোস্তফা গ্রুপ এখন দেশের অন্যতম শীর্ষ ঋণখেলাপি গ্রুপ। বিভিন্ন ব্যাংকে এ গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকগুলো এ খেলাপি পাওনা আদায়ের জন্য গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জহির উদ্দিনসহ উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে কয়েক ডজন মামলা করেছে। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চেক প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থ পাচারের অভিযোগে শতাধিক মামলা বিদ্যমান রয়েছে। এসব মামলার মধ্যে আটটিতে গ্রেপ্তারের ওয়ারেন্ট জারি হয়েছে। তাই গ্রেপ্তার এড়াতে ভুয়া পাসপোর্ট ব্যবহার করে পরিবার নিয়ে কানাডায় পালিয়ে যান জহির উদ্দিন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একসময়কার বনেদি শিল্পগ্রুপ ছিল মোস্তফা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান সততা, মেধা, দক্ষতা ও অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে তুলেছিলেন গ্রুপটি। তার মৃত্যুর পর ব্যবসার হাল ধরেন তারই সাত সন্তান। এর মধ্যে বড় ছেলে হেফাজেতুর রহমান গ্রুপটির চেয়ারম্যান ও ছোট ছেলে জহির উদ্দিন গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন। অন্য ছেলেদের মধ্যে কামাল উদ্দিন, কফিল উদ্দিন, রফিক উদ্দিন, শফিক উদ্দিন ও জসিম উদ্দিন পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন। বাবার গড়া সম্পদ ও সুনামের বিনিময়ে হেফাজেতুর রহমান ওয়ান ব্যাংকের পরিচালক ও জহির উদ্দিন ব্যাংক এশিয়ার উদ্যোক্তা পরিচালক হন। তবে তাদের উচ্চাভিলাষিতা, অদূরদর্শিতা ও অযোগ্যতায় ডুবেছে পুরো গ্রুপের ব্যবসা। আর গ্রুপটি খেলাপি হয়ে পড়েছে দেশের অধিকাংশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সুদাসলসহ খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা।

এদিকে ব্যাংকগুলোর করা ৯টি মামলার আটটিতে গ্রেপ্তারের পরোয়ানা জারি হয়েছিল জহির উদ্দিনের বিরুদ্ধে। গ্রেপ্তার এড়াতে পরিবার নিয়ে কানাডায় পালিয়ে যান তিনি। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকা সত্ত্বেও বিদেশে যাওয়ার জন্য ভুয়া পাসপোর্ট ব্যবহার করেছেন তিনি বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে কয়েক মাস আগে ইউনিয়ন ক্যাপিটালের মামলায় হেফাজুতুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

এদিকে দুদক সূত্রে জানায়, মোস্তফা গ্রুপ বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) প্রিন্সিপাল শাখার সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে জাল ডকুমেন্ট প্রদানসহ সত্যতা যাচাই ও বেনিফিশিয়ারি প্রতিষ্ঠানের বাস্তব অস্তিত্ব আছে কি না, তা যাচাই ছাড়াই অসৎ উদ্দেশ্যে প্রতারণার মাধ্যমে ব্যাংকটি থেকে অর্থ আত্মসাৎ করে। গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সুদসহ বিডিবিএলের পাওনা ১৭৪ কোটি ৬১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। আর এ টাকা আত্মসাৎ বা পাচারের ঘটনা প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় মোস্তফা গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এমএম ভেজিটেবল অয়েল প্রোডাক্টস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. হেফাজুতুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির উদ্দিনসহ অন্যান্য পরিচালক এবং বিডিবিএলের সাবেক এসপিও, প্রিন্সিপাল শাখার দীনেশ চন্দ্র সাহা, বাংলাদেশ ডেভেলমেন্ট ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার সৈয়দ নুরুর রহমান কাদরীসহ জড়িত অন্যান্য কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৪০৯, ৪২০, ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৭১, ১০৯ ও ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারাসহ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪(২), (৩) ধারায় একটি মামলা করা হয়। এর মধ্যে বিডিবিএলের সাবেক জিএম সৈয়দ নুরুর রহমান কাদরীকে গত ১৭ নভেম্বর রাজধানীর মৎস্যভবন এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছেন মামলায় দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. গুলশান আনোয়ার।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ সূত্রে জানা যায়, মোস্তফা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির উদ্দিনসহ অন্যান্য পরিচালকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানের চেক প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ এবং অর্থ পাচারের অভিযোগে শতাধিক মামলা আছে। এর মধ্যে আটটি মামলায় গ্রেপ্তারের ওয়ারেন্ট জারি হয়েছিল। ডবলমুরিং থানায় মো. জহির উদ্দিনের বিরুদ্ধে পাঁচটি গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে। কোতোয়ালি থানায় রয়েছে একটি গ্রেফতারি পরোয়ানা এবং পাঁচলাইশ থানায় দুটিতে গ্রেপ্তারি পারোয়ানা আছে। তবে এ বিষয়ে দায়িত্বশীলরা মন্তব্য করতে আগ্রহী হননি।

নাম প্রকাশে অনচ্ছিুক এক পুলিশ কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, ‘জহির উদ্দিন হয়তো ভুয়া পাসপোর্ট ব্যবহার করেছেন। তার এনআইডি দিয়ে পাসপোর্ট থাকলে তো অবশ্যই গ্রেপ্তার হতেন। এটাও বড় অপরাধ।’

গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকার পরও মো. জহির উদ্দিন কীভাবে ইমিগ্রেশন পুলিশের চোখে ফাঁকি দেশ ছেড়ে পালালেন সে বিষয়ে পাঁচলাইশ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপপরিচালক মাসুম হাসান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘জš§তারিখ ও জাতীয় পরিচয়পত্র অনুসারে জহির উদ্দীনের নামে কোনো রেকর্ড পাসপোর্ট অধিদপ্তরে নেই। হয়তো জš§নিবন্ধন দিয়ে পাসপোর্ট করা হতে পারে। এছাড়া গ্রেফতারি পরোয়ানা হওয়ার আগেও তিনি দেশ ছেড়ে থাকতে পারেন।’

এ বিষয়ে মোস্তফা গ্রুপের চেয়ারম্যান হেফাজুতুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ডিসেম্বরের শেষের দিকে জহির দেশে আসবে।

যদিও গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা স্বপন দাশগুপ্ত বলেন, ‘জহির উদ্দিন তার পরিবার নিয়ে কানাডায় আছেন। তার ছেলেগুলোকে স্কুলে ভর্তি করানোর কাজ শেষ করছেন। আরও আগে তার ফিরে আসার কথা ছিল, কিন্তু আসতে পারেননি। কবে আসবেন, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না।’