ব্যাংক ও অর্থনীতির ওপর প্রভাব পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশ ব্যাংক

শেখ আবু তালেব: আন্তর্জাতিকভাবে এক দেশ থেকে আরেক দেশের বাণিজ্যিক দায়-দেনা পরিশোধের প্রধান মাধ্যম সুইফট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন)। অনলাইনভিত্তিক এই পরিশোধ মাধ্যমে বিশ্বের ১১ হাজার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান যুক্ত রয়েছে। বাংলাদেশও এই মাধ্যমকে ব্যবহার করে বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালনা করে। কিন্তু সুইফট থেকে রাশিয়ার বড় কয়েকটি ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশগুলো। এতে কিছুটা বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক বলে দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে।

এই নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশের বৈদেশিক পেমেন্ট সিস্টেম তথা বৈদেশিক লেনদেনে কেমন প্রভাব পড়তে পারে, তা নিয়ে পর্যবেক্ষণ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিষেধজ্ঞার আওতায় ও এর বাইরে কোন কোন ব্যাংক রয়েছে, তার খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। একইসঙ্গে বিকল্প পেমেন্ট নিয়ে ভাবছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

প্রসঙ্গত, ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোর যৌথ মালিকানায় ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সুইফট। ইউরোপের দেশ ইউক্রেনে হামলার প্রতিবাদে রাশিয়ার বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডাসহ পশ্চিমা দেশের বড় একটি অংশ। এর অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক অর্থ পরিশোধের ব্যবস্থা থেকে রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংককে বাদ দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ফলে ওইসব ব্যাংকের সঙ্গে সুইফটের মাধ্যমে কোনো লেনদেন করতে পারবে না ২০০টি দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশও সেই তালিকায় রয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশের ওপর বিশেষ করে আর্থিক লেনদেনের ওপর কেমন পড়বে, তা পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশেষ করে রাশিয়ান ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর লেনদেন ও পরিশোধ পদ্ধতি কেমন, তার ওপর নির্ভর করছে প্রভাবের বিষয়টি। এটি বুঝতে একটু সময় লাগবে। বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, রাশিয়ার সঙ্গে ব্যাংকিং যোগাযোগের মাধ্যমই হচ্ছে সুইফট। কিন্তু রাশিয়ার বড় কয়েকটি ব্যাংককে সুইফট থেকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইইউ ও মিত্র দেশগুলো। এখন দেখতে হবে ওইসব ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের লেনদেন কতটুকু। আবার এখনও রাশিয়ার সব ব্যাংক সুইফট থেকে বাদ যায়নি। ফলে এসব ব্যাংকের মাধ্যমেও লেনদেন অব্যাহত রাখা যায় কি না, সে বিষয়টি ভেবে দেখা হচ্ছে।

সূত্র জানিয়েছে, আপাতত রাশিয়া থেকে পণ্য আমদানিতে নতুন এলসি খুলতে তুলনামূলকভাবে বেশি সময় নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। কিন্তু বৈদেশিক দায় পরিশোধের একটি নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। ফলে দায় পরিশোধ দেরি হলেও করা যাবে। তবে তা নির্ভর করে এই নিষেধাজ্ঞা কতদিন বহাল থাকে তার ওপর।

রাশিয়ার সঙ্গে মূলত তৈরি পোশাকের কাঁচামাল তুলা ও খাদ্যপণ্যের মধ্যে গম, তেল ও মসুর ডাল আমদানি করে বাংলাদেশ। এছাড়া রাশিয়ার অর্থায়নে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ নির্মাণ করা হচ্ছে। এর কাঁচামালও রাশিয়া থেকে আসছে। এতে কিছুটা বেগ পেতে হতে পারে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেন সম্প্রতি বলেছেন, রোসাটামের ওপর এখনও নিষেধাজ্ঞা আসেনি। এই কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা এলে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর কিছুটা প্রভাব পড়বে।

জানা গেছে, সুইফটের বিকল্প হিসেবে রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি কারেন্সি (মুদ্রা) সোয়াপের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে লেনদেনের একটি প্রস্তাব আলোচনায় রয়েছে। এই পদ্ধতিতে বাংলাদেশ-রাশিয়া নিজ নিজ মুদ্রায় লেনদেন করবে। বিষয়টি নিয়ে কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি অনুমোদন করেছে। পরিশোধ পদ্ধতি নিয়ে প্রতিবেদনও চূড়ান্ত করেছে। বিষয়টি এখন সরকারের সিদ্ধান্তের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। এটি অনুমোদিত হলে বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার দায়-দেনা পরিশোধ নিয়ে সমস্যা হবে না বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং ও অর্থনীতির ওপর এর প্রভাব সম্পর্কে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মানসুর বলেন, দেশের ব্যাংকিং চ্যানেলের ওপর প্রভাব সম্পর্কে জানতে একটু সময় লাগবে। সব ব্যাংক এখনও এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসেনি। রাশিয়ান কয়েকটি ব্যাংকের ওপর এসেছে মাত্র, সেগুলো বড় ব্যাংক। যদি এটি দীর্ঘমেয়াদি হয়, তাহলে আমদানি-রপ্তানিতে একটু প্রভাব পড়বে। এখন দেখার বিষয় বাংলাদেশ ব্যাংক কীভাবে সামলায়।

বাংলাদেশের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় রপ্তানি হয়েছে ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাতই সিংহভাগ। অন্যদিকে এ সময় আমদানি হয়েছে ৪৬ কোটি ৬৭ লাখ ডলারের পণ্য, যার বেশিরভাগ খাদ্যপণ্য।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০