বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া কি উচিত? হ্যাঁ, উচিত। ব্যাংকের সংখ্যা কি বেশি? না, বেশি নয়। ব্যাংক খাত কি দুর্বল? না, দুর্বল নয়। ব্যাংকগুলোর একীভূত হওয়ার আইন কি দুর্বল? হ্যাঁ, দুর্বল। ব্যাংক কর্মকর্তারাই ঋণগ্রহীতাকে খেলাপি বানায় কি? হ্যাঁ, তারাই ঋণগ্রহীতাদের খেলাপি বানায়। প্রশ্নগুলো আমি বানিয়েছি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের একটা বক্তৃতা পাঠ করে। তিনি বক্তৃতাটি দিয়েছেন ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেট’-এ। উপলক্ষ একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। বলা বাহুল্য, প্রশ্নগুলো আমার। উত্তরগুলো আমার নয়। উত্তরগুলোর সবই অর্থমন্ত্রীর। তিনি প্রসঙ্গ উল্লেখ করে করে উত্তর দিয়েছেন। যেমন বলেছেন, ব্যাংকের সংখ্যা বেশি নয়। অথচ অন্য সময় আরেক উপলক্ষে তিনি বলেছেন ভিন্ন কথা। অনেক সময় তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা বেশি। ‘ক্যাপিটাল মার্কেট ইনস্টিটিউট’-এর প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতেও বলেছেন ব্যাংকগুলোর একীভূত হওয়ার কথা। তার মতে, একীভূত হওয়ার আইনগুলো পর্যাপ্ত নয়। প্রশ্ন, এ কথা কেন উঠল? যদি ব্যাংকের সংখ্যা বেশি না হবে, তাহলে একীভূত হওয়ার কথা উঠবে কেন? এর মানে, তিনি কখন কী বলছেন তার হিসাব নিজেই রাখেন না। অথচ তিনি অর্থমন্ত্রী। তার কথা যদি একেক সময় একেক রকম হয়, তাহলে আমজনতার জন্য বড়ই সমস্যা। কারণ অর্থমন্ত্রীর কথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংকের জন্য, অর্থনীতির জন্য।
দেখা যাচ্ছে তিনি বলছেন, ‘যখনই কাউকে ঋণ দেওয়া হয় ব্যাংকের পক্ষ থেকেই চেষ্টা করা হয় ওই উদ্যোক্তা যেন খেলাপি হয়ে পড়েন। আমার মনে হয়, এটা ব্যাংকারদের একটা অস্ত্র। এ চরিত্রটা বদলাতে হবে।’ কী মারাত্মক মন্তব্য। অর্থমন্ত্রীর কথা ঠিক হলে খেলাপি সমস্যা তৈরি করছেন ব্যাংকাররা এবং তা ঋণ দেওয়ার প্রথম দিন থেকে। মুশকিল হচ্ছে, এটি বুঝতে তার ১০ বছর লাগল। তিনি অর্থমন্ত্রী ১০ বছর ধরে। এ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে তিনি কখনও এমনটি বলেননি যে, খেলাপি ঋণ তৈরি করছেন খোদ ব্যাংকাররা। কখনও বলেননি, ব্যাংকের পক্ষ থেকেই চেষ্টা করা হয় উদ্যোক্তারা যাতে খেলাপি হয়। এটা নাকি ব্যাংকারদের অস্ত্র। তিনি পরামর্শ দিয়েছেন, ব্যাংকাররা যাতে এ অভ্যাস পরিত্যাগ করেন। অর্থমন্ত্রী ভুল না শুদ্ধ, তা বোঝা যেত যদি তিনি দু-একটা উদাহরণ দিয়ে তার মন্তব্যের যৌক্তিকতা তুলে ধরতেন। আমরা এমনিতে জানি, খেলাপি সমস্যার অনেক কারণ। ব্যাংকারদের আচার-ব্যবহার, কার্যক্রম এর মধ্যে একটা। তারা উদ্যোক্তাদের ভোগান, এটাও অসত্য নয়। কিন্তু আজকের খেলাপি সমস্যার জন্য ব্যাংকাররাই দায়ী, একমাত্র দায়ী এটি খুব সরলীকৃত হয়ে গেল না কি? উচ্চ সুদহার একটি সমস্যা, ঋণ প্রস্তাব পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অব্যবসায়িক বিবেচনার প্রয়োগ আরেকটি সমস্যা। চাপে পড়ে ঋণ দেওয়া আরেকটি সমস্যা। আবার দুর্যোগ, ব্যবসায়িক উত্থান-পতনও যে আরেকটি সমস্যা, তাতেও সন্দেহ নেই। ডজন ডজন কারণে একেকটি ঋণ খেলাপি হয়। এর মধ্যে ইচ্ছাকৃত খেলাপিও আছে। বস্তুত একেকটি ঋণ একেক কারণে খেলাপি হয়। সেখানে ব্যাংকারদের কার্যক্রম তথা ভুল-ত্রুটি, স্বেচ্ছাচারও আছে। অথচ ১০ বছর অর্থমন্ত্রী থাকার পর মুহিত সাহেব বলে যাচ্ছেন একমাত্র ব্যাংকাররাই খেলাপি ঋণের জন্য দায়ী। আমি তার এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারলাম না বলে দুঃখিত। এ ধরনের মন্তব্যে কর্মরত ব্যাংকাররা বরং নিরুৎসাহিত হবেন, কাজে উৎসাহ হারাবেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি বলতেন আইনশৃঙ্খলার অবনতির জন্য পুলিশ দায়ী, তাহলে কি বিষয়টি যৌক্তিক ও শোভন হতো? নিশ্চয়ই নয়। অথচ এ ধরনের কাজই করলেন অর্থমন্ত্রী।
বেসরকারি ব্যাংক সম্পর্কে তিনি বলেছেন, সেখানে ফাঁকিবাজি আছে। এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। এটা তো অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। ব্যাংকের মালিকরা দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী। তাদের নানা রকম ব্যবসা আছে। পোশাক কারখানা থেকে শুরু করে নানা ব্যবসায় তারা জড়িত। তাদেরও ঋণের দরকার আছে। ঋণ ছাড়া তারা ব্যবসা চালাবেন কীভাবে? ঋণের জন্য তো তাদের দোষারোপ করা যায় না। ঋণ নেওয়া কোনো অপরাধের কাজও নয়। দেখার বিষয়, তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম-কানুন ভেঙে ঋণ নিচ্ছেন কি না। ব্যাংকের পরিচালকরা প্রচলিত নিয়ম-কানুন ও আইন অমান্য করে ঋণ নিলে প্রশ্ন উঠতে পারে। আমাদের বিবেচ্য হচ্ছে, তাদের মধ্যে কারা আইন, নিয়মবিধি ভেঙে ঋণ নিয়েছেন। এদের বিচার হতে পারে। তাদের সম্পর্কে কথা হতে পারে। ঢালাও অভিযোগ করে তো কারও উপকার হয় না। এক ব্যাংকের পরিচালক যদি অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেন এবং তা যদি দেশের জন্য ক্ষতিকর হয়, অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হয়, তাহলে এ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে। আমাদের এসব ব্যাপারে পরিষ্কার নীতিমালা থাকা দরকার। এমনিতে দেখা যায়, ব্যাংক পরিচালকদের ঋণ দিতে অন্য ব্যাংক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তাদের ধারণা, পরিচালক পারতপক্ষে খেলাপি হবেন না। আর তাহলে পরিচালক আর পরিচালক থাকতে পারবেন না। কোনো পরিচালকই তার পদ হারাতে চান না। বাস্তবেও দেখা যায় এর কার্যকারিতা। এখন সরকার যদি মনে করেÑএটা ঠিক হচ্ছে না, তাহলে নিয়ম করে তা বন্ধ করে দিতে পারে। তবে এর আগে নিশ্চিত হতে হবে, নতুন আইনটি দেশের উপকারে আসবে। দেশে ব্যাংকের সংখ্যা বেশি, এটা অধিকাংশ অর্থনীতিবিদের মত। ব্যাংকাররাও তা-ই বলছেন। কয়েকদিন আগে বিআইবিএমের এক সেমিনারে বলা হয়েছে, ব্যাংকের সংখ্যা বেশি হওয়ায় অসুস্থ প্রতিযোগিতা হচ্ছে। এক ব্যাংকের ভালো ঋণগ্রহীতাকে অন্য ব্যাংক বেশি ক্রেডিট ফ্যাসিলিটিজ দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এতে ঋণগ্রহীতা অনেক ক্ষেত্রেই ‘ওভার বরোড’ কোম্পানিতে পরিণত হচ্ছে। ঋণগ্রহীতারা নিজেদের সার্বিক মূল্যায়ন করতে অপারগ হচ্ছেন। ব্যাংকাররাও উপায় না দেখে মালিকদের অসম্ভব টার্গেট পরিপূরণে এসব করছেন। এর ফল ভোগ করছে ব্যাংক খাত। অথচ এখনও দেখা যাচ্ছে, নতুন ব্যাংক দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে। অতীতেও খবরের কাগজে দেখেছি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বস্তুত সরকারের ইচ্ছায় ব্যাংকের অনুমতি দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতদ্বৈধতা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দিতেই হয়েছে ব্যাংকের অনুমতি। এখন কথা উঠেছে একীভূতকরণের। এজন্য আইন পর্যাপ্ত না হলে তা করা হোক। এটা তো অসম্ভব ব্যাপার নয়। এসব আইন যে কোনো দেশে আছে। ধার করলেই বা অসুবিধা কী? আসলে দরকার সদিচ্ছা। এটা হলেই বাকি কাজ সম্পন্ন করা যায়।
সর্বশেষ একটা বিষয়ে দুটি কথা বলে আজকের নিবন্ধ শেষ করব। ‘ক্যাপিটাল মার্কেট ইনস্টিটিউট’-এ অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের উদ্যোক্তারা সাবালক হয়েছেন। আমাদের অর্থনীতিও অনেক বড় হয়েছে এবং তা এখন সাবালক। অতএব আমরা উদ্যোক্তাদের বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দিতে পারি। অর্থমন্ত্রীর এ মন্তব্য নতুন কোনো বিষয় নয়। মাঝেও এমন কথা উঠেছিল। বস্তুত অনেকে বলেছেন মজার কথা। তারা বলেছেন, বাংলাদেশের অনেক ব্যবসায়ী ইতোমধ্যে নানা দেশে ব্যবসা করছেন, শিল্প গড়ছেন। করছেন সরকারের বিনা অনুমতিতে। তারা সরকারিভাবে বিদেশে টাকা নিয়ে বিনিয়োগ করেননি। কীভাবে করছেন, তা তারাই জানেন। এ কারণে অনেকে বলতে চান, সরকারিভাবে অনুমোদন দেওয়ার মানে হচ্ছে অবৈধ কাজকে বৈধকরণ। আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। কিন্তু একটা বিষয়ের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। একসময় কথা উঠেছিল, আমাদের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। তা বসিয়ে না রেখে কাজে লাগানো উচিত; অবকাঠামো গড়ে তোলা দরকার। তখন শনৈঃশনৈ বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বাড়ছিল। এখন কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি মাসে রিজার্ভের পরিমাণের কথা বলে না। এখন ওই রিজার্ভের অর্থ অবকাঠামোতে খাটানোর কথাও শুনি না। এর মধ্যে হঠাৎ করে অর্থমন্ত্রী মেয়াদের শেষে বলছেন, বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ করে দেওয়া উচিত। তিনি এমন সময়ে এ মন্তব্য করলেন, যখন আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে। ‘ব্যালান্স অব পেমেন্ট’ পরিস্থিতি নাজুক। যখন ডলারের ওপর প্রচণ্ড চাপ যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ শনৈঃশনৈ বাড়ছে না। তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আমাদের রিজার্ভ ছিল আট মাসের আমদানির সমপরিমাণ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা নেমে এসেছে পাঁচ দশমিক ৯ মাসে। লক্ষণটি কি ভালো? নিশ্চয়ই নয়। এ মুহূর্তে আমার ধারণা, ‘মাসের আমদানি’ হিসাবে আমাদের রিজার্ভের পরিমাণ কম হবে। এ অবস্থায় বিদেশে বিনিয়োগের জন্য দেশীয় উদ্যোক্তাদের অনুমতি দেওয়া কতটুকু যুক্তিসঙ্গত হবে, তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা প্রয়োজন মনে করি।
অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক