রোহান রাজিব: নানা সুবিধা দেয়ার পরও ব্যাংক খাতে বেড়েই চলেছে খেলাপি ঋণ। আর খেলাপি ঋণের অধিকাংশই অনাদায়ী রয়ে গেছে। ২০২১ সাল শেষে মোট খেলাপি ঋণের ৮৮ শতাংশই আদায় অযোগ্য (ব্যাড অ্যান্ড লস) হয়ে পড়ছে। এছাড়া ২০২১ সাল শেষে খেলাপি ঋণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায় জাহাজ নির্মাণ খাতে। খেলাপি ঋণের শতকরা হিসেবে শীর্ষ রয়েছে এ খাত। সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২১ সালের আর্থিক স্থিতিশীল প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংক খাতের মন্দ ঋণ বড় সমস্যা। কারণ মন্দ ঋণ আদায় হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। এছাড়া মন্দ ঋণ বাড়লে ব্যাংকগুলোর জন্য বাড়তি চাপ ও ঝুঁকি সৃষ্টি হয়, যা গ্রাহকের আস্থার সংকটের ক্ষেত্র তৈরি করে। এছাড়া মন্দ মানের ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে শতভাগ সঞ্চিতি রাখতে হয়। এর সরাসরি চাপ পড়ে প্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সাল শেষে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের ৯১ হাজার ৫৭ কোটি টাকা মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে, যা শতাংশ হিসেবে ৮৮ দশমিক ১৭ শতাংশ। আর আদায় অযোগ্য তথা তামাদি ঋণের পরিমাণ ৯১ হাজার ৬০ কোটি টাকা বা ৮৮ দশমিক ১০ শতাংশ।
২০১২ সাল থেকে ব্যাংক খাতে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে মন্দ মানের ঋণের (ব্যাড লোন) পরিমাণ। ২০১২ সালে মন্দ মানের খেলাপি ঋণ ছিল ৬৬ দশমিক ৭০ শতাংশ, ২০১৩ সালে ৭৮ দশমিক ৭০ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৮৪ দশমিক ৪০ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৮৫ দশমিক ৯০ শতাংশ, ২০১৯ সালে ৮৬ দশমিক ৮০ শতাংশ, ২০২০ সালে ৮৭ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ৮৮ দশমিক ১৭ শতাংশ।
ব্যাংক খাতের নিয়ম অনুযায়ী, মন্দ মানের খেলাপি ঋণ যখন আদায় হয় না, তখন অবলোপন করা হয়, অর্থাৎ খেলাপি ঋণের হিসাবে রাখা হয় না, অন্য হিসাবে রাখা হয়। এটাকে গোপন খেলাপি ঋণও বলা হয়। এ অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণও প্রায় অর্ধ লাখ কোটি টাকা। এসব ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। বছরের পর বছর এসব মামলা টেনে আসছে ব্যাংকগুলো।
ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায় জাহাজ নির্মাণ খাত। কারণ খেলাপি ঋণের শতকরা হার হিসেবে শীর্ষ রয়েছে এ খাত। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২১ সালে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন খাতে ১২ লাখ ১৮ হাজার ৫৮০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ৯৩৫ হাজার কোটি টাকা। তবে রাইট অফ ও উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত ঋণের পরিমাণ বিবেচনা করলে তা প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা।
২০২১ সাল শেষে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে খেলাপি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা বা ১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ২০২০ সালেও ১৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ খেলপি ঋণ নিয়ে এই খাত শীর্ষে ছিল। খেলাপি ঋণের হারে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চামড়া ও চামড়াভিত্তিক শিল্প। গত বছর শেষে এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা বা ১০ দশমিক ৯৮ শতাংশ। ২০২১ সালে কৃষি খাতে ১ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ২৪০ কোটি টাকা বা ১০ দশমিক ২১ শতাংশ খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে।
পরিমাণের দিক থেকে সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ ট্রেড অ্যান্ড কমার্স খাতে। ২০২১ সালে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৩ হাজার ৪৮ কোটি টাকা। ২০২০ সালে এ খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বা ১০ দশমিক ৬০ শতাংশ। ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা বা ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ। পরিমাণের দিক থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ বস্ত্র খাতে। গত বছর শেষে বস্ত্র খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯ হাজার ২৮১ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এক বছর আগে এর পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ১১৮ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এক বছরে বস্ত্র খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা। এছাড়া তৈরি পোশাক খাতে গত বছর শেষে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩০ হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ১১ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ২২ শতাংশ। এক বছর আগে এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ গত এক বছরে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪৯৪ কোটি টাকা।
যদিও গত বছর কিছু খাতে খেলাপি ঋণ কমার তথ্য মিলেছে। প্রতিবেদন বলছে, গত বছর পর্যন্ত কৃষি খাতে ঋণ কমে দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৩ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ২২ শতাংশ। এক বছর আগে এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এর মানে কৃষকরা ঋণ ফেরত দিয়েছেন বেশি।
২০২০ সালে পরিবহন খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১ হাজার ৮২৪ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ৬২ শতাংশ। ২০২১ সালে তা কমে হয়েছে ১ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ০১ শতাংশ। এছাড়া গত বছর ব্যক্তিগত বাড়ি নির্মাণ খাতে ১৪ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ কমে দাঁড়িয়েছে ৮৩৯ কোটি টাকায়।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের জুনভিত্তিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকায়, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে খেলাপির অঙ্ক ছিল ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৬ হাজার ৫২ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ২০২২ সালের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। তিন মাস পর জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ১১ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা; যা শতাংশ হিসাবে ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, খেলাপি ঋণ এমনি ব্যাংক খাতের সমস্যা। এর সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে ছাড় দেয়া। এ ছাড়ের কারণে অনেকে ভাবছে ঋণ ফেরত না দিলেও চলবে। তাই দিন দিন খেলাপি ঋণ লাগামহীনভাবে বাড়ছে। খেলাপি বাড়ার কারণে দেশের আন্তঃশৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে।
তিনি বলেন, মন্দ ঋণ ব্যাংকের জন্য সব সময় বড় দুশ্চিন্তার কারণ। কারণ মন্দ ঋণ বাড়লে ব্যাংকগুলোর জন্য বাড়তি চাপ ও ঝুঁকি সৃষ্টি হয়, যা গ্রাহকের আস্থার সংকটের ক্ষেত্র তৈরি করে।