Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 4:14 pm

ব্যাংক খাতের তথ্য প্রকাশে অনীহা বাংলাদেশ ব্যাংকের!

রোহান রাজিব: দেশের অর্থনীতির পরিস্থিতি ও ব্যাংক খাতের অবস্থা জানতে জনগণের বিভিন্ন তথ্যের প্রয়োজন হয়। এ তথ্য প্রকাশ করেও থাকে দেশের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা। তার মধ্যে অন্যতম একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষাণ¥াসিক এবং বার্ষিক ভিত্তিতে দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংক খাতের বিভিন্ন আর্থিক সূচকের হালনাগাদ তথ্য তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে থাকে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর যোগ দেয়ার পর থেকে পণ্যভিত্তিক এলসি, শিল্প ঋণ, এসএমই ঋণ এবং ব্যাংকভিত্তিক ঋণ-আমানতের সুদহারসহ বিভিন্ন তথ্য প্রকাশে অনীহা দেখাচ্ছে। কোনো কোনো তথ্য প্রায় দুই বছর ধরে প্রকাশ করছে না। আবার কিছু তথ্য এক মাস থেকে ছয় মাস ধরে প্রকাশ করছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইট খুঁজে দেখা গেছে, পণ্যভিত্তিক আমদানির এলসি বা ঋণপত্রের তথ্য প্রায় দুই বছর ধরে প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বশেষ ২০২২ সালের জুলাইয়ে পণ্যভিত্তিক ঋণপত্রের তথ্য প্রকাশ করেছিল সংস্থাটি। এরপর আর পণ্যভিত্তিক আমদানির ঋণপত্রের তথ্য হালনাগাদ করা হয়নি। এর আগে প্রতি মাসেই ওয়েবসাইটে আগের মাসের তথ্য দেয়া হতো।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ২০২২ সালে দেশে ডলার সংকট হয়। ওই সময় আমদানিতে কড়াকড়ি করে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। কড়াকড়ির কারণে অনেক আমদানি পণ্য কমে যায়। পণ্য আমদানি কমার খবর যাতে প্রকাশ না হয়, তাই তথ্য সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়, যাতে পরিস্থিতি খারাপ না হয়।

বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, গত ছয় মাস ধরে ব্যাংকভিত্তিক আমানত ও ঋণের তথ্যও প্রকাশ করেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সর্বশেষ ২০২৩ সালের অক্টোবরে সর্বশেষ ব্যাংকভিত্তিক আমানত ও ঋণের সুদহারের তথ্য প্রকাশ করেছে। এরপর আর ব্যাংকভিত্তিক আমানত ও ঋণের তথ্য হালনাগাদ করা হয়নি। অথচ আগে প্রতি মাসেই বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগ ওয়েবসাইটে আগের মাসের তথ্য দেয়া হতো।

এছাড়া শিল্প ঋণ ও এসএমই ঋণের তথ্য প্রকাশেও অনীহা দেখাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি তিন মাস পরপর এসব তথ্য প্রকাশ করত। সর্বশেষ ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) পর্যন্ত শিল্প ঋণের তথ্য প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। এরপর চারটি প্রান্তিক পেরিয়ে গেলেও কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি। একইভাবে এসএমই ঋণেরও তথ্য প্রকাশ বন্ধ রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সংস্থাটি সর্বশেষে গত বছরের ডিসেম্বর প্রান্তিকের এসএমই ঋণের তথ্য প্রকাশ করেছে। তাছাড়া ব্যাংক খাতে কী পরিমাণ আমানত ও ঋণ রয়েছে, তারও একটি তথ্য প্রকাশ করত বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও ফেব্রুয়ারির পর থেকে তাও প্রকাশ করছে না সংস্থাটি।

অন্যদিকে, প্রতি মাসেই ব্যাংক ঋণের সিক্স মান্থ মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল বা স্মার্ট তথ্য প্রকাশ করে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এপ্রিলের স্মার্ট রেটের তথ্য প্রকাশ করেনি। এ কারণে চলতি মে মাসে ঋণের সুদ কত হবে, তা স্পষ্ট নয়।

উদারণস্বরূপ বলা যায়, এপ্রিলে গ্রাহক পর্যায়ে ব্যাংক ঋণের সুদহার কত হবে, তা মার্চের শেষ দিন জানিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। মার্চসহ আগের ছয় মাসের ট্রেজারি বিলের গড় হিসাব করে তা জানিয়ে দেয়া হয়। ওই মাসে স্মার্ট ছিল ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এর সঙ্গে ৩ শতাংশ মার্জিন যোগ করে এপ্রিলের ঋণের সুদহার নির্ধারণ করা হয়। তবে এপ্রিলের স্মার্টের তথ্য প্রকাশ না হওয়ার কারণে মে মাসের ব্যাংক ঋণের সুদহার নির্ধারণ করা হয়নি।

ঋণের সুদহার তথ্য হালনাগাদ না করার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, গ্রাহক পর্যায়ে সুদহার নির্ধারণের বিদ্যমান ব্যবস্থা ‘স্মার্ট’ প্রথা উঠে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে সুদহার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করা হচ্ছে। আগামী ৮ মে মুদ্রানীতির কমিটির মিটিংয়ে এ বিষয়ে ঘোষণা আসতে পারে। এ কারণে নতুন করে আর তথ্য প্রকাশ করছে না।

তথ্য হালনাগাদের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, এসব রেগুলার হালনাগাদ হওয়ার কথা। কিন্তু কী কারণে হচ্ছে না, তা সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানাতে হবে।

নিয়মিত হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করা না হলে তার ফল কী হতে পারেÑসে বিষয়ে জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য শেয়ার বিজকে

বলেন, ‘নিয়মিত যদি তথ্য প্রকাশ করা না হয়, তাহলে অর্থনীতির খারাপ পরিস্থিতি সম্পর্কে মানুষের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হবে। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করবে যে, দেশের অর্থনীতির অবস্থা প্রকৃতই খারাপ, যে কারণে এসব তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না। এর বাইরে আরেকটি বিষয় ঘটবে। তা হচ্ছে, স্বার্থান্বেষী মহল যাদের সাধারণত সিন্ডিকেট বলে আখ্যায়িত করা হয়, তারা দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে নানা ফায়দা নেয়ার সুযোগ পাবে। কারণ তারা কোনো না কোনোভাবে এসব তথ্য পেয়ে যাবে এবং বাজার অস্থিতিশীল করে তুলবে। তথ্য প্রকাশ না করার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রক সংস্থা অনেক ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের সহযোগী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে।’