ব্যাংক খাতের দুর্দশার জন্য দায়ী কে?

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন: দেশের বেসকরকারি ব্যাংকগুলো মুখ থুবড়ে পড়ছে; তবে পাবলিক ব্যাংকগুলোর অবস্থা যে খুব ভালো আছে তাও বলা যাবে না। কী কারণে দেশের ব্যাংকি সেক্টরের এ করুণ অবস্থা! তারও কোনো সঠিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নেই। কে নেই তার জবাব কে দেবেন। প্রতিদিন রাতে নিশীকথকরা কথার বন্যায় টিভি পর্দাগুলো ভাসিয়ে দিচ্ছেন, তারপরও  অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই। নিশীকথকরা আসলে কতটুকু ব্যাংক ব্যবস্থা বুঝে সেটাও একটা বিষয়। দেশে যারা নিশীকথক হয়ে আছেন, তাদের সময় এসে দেখা যায় নানা অপরাধে জড়িত। দেশের কথিত সুশীল ও নিশীকথকদের জ্ঞান বুদ্ধি সীমাবদ্ধ। তারা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তুমুল বয়ানে ব্যস্ত হয়ে পড়েন কিন্তু পূর্বাভাস দিতে পারেন না। তাই এদের নিয়ে এ ধরনের আলোচনা অনুষ্ঠান না করে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান দেখালে দর্শকরা বিনোদন পেত। বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংকগুলোর ব্যাংক হিসাবে কাজ করে। তাই এই ব্যাংকে গতিবিধির দেখে অন্য ব্যাংকগুলোর অবস্থা নির্ণয় করা যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২২-২৩ অর্থবছরে তার কাছে রাখা সমপরিমাণ অর্থের বিপরীতে ব্যাংকগুলোয় ১৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করে। এত বড় বিনিয়োগের পরও কেন ব্যাংকগুলো দাঁড়াতে পারেনি? কী ঘটে ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমে, তা মনিটরিং করার মতো কোনো কর্মকর্তা কি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নেই? বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঠিক তথ্য প্রকাশিত হয় না। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গণমাধ্যম কর্মীদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। এ বিষয়টির ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই আছে। যেমন অতিরঞ্জিত খবর প্রকাশ পাবে না এটা ভালো দিক। অন্যদিকে দেশের অর্থ কী পরিমাণে লোপাট হয়ে যাচ্ছে তা জনসমক্ষে আসবে না। এই দুটো দিক বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে সরকারে সংশ্লিষ্টদের অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে। তাই তারা সংবাদ পরিবেশনের বিষয়টিতে এ ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছেন। বেসরকারি ও সরকারি সব ব্যাংক থেকে গ্রাহকরা তাদের জমাকৃত অর্থ উঠিয়ে নিচ্ছেন। এ কারণে ব্যাংকগুলোর দৈনিক জমা ও প্রদানের মাধ্যমে চলার পথটিও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর একটি কারণ হচ্ছে, সরকারের মার্স এবং একুইজিশনের খবর। মার্স বা একুইজিশনের কারণে ব্যাংকগুলো উঠে যাবে এই ভেবে গ্রাহকদের অর্থ উত্তোলন প্রবণতাটা বেড়ে গেছে। কারণ দেশের ঋণখেলাপি ও ঋণদানের বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করে মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখা নিয়ে আস্থাহীনতায় ভুগছে। সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে তথ্য থেকে জানা যায়, দেশের জনৈক শিল্পপতি ২৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। দেশে ব্যাংকগুলো যখন সীমাহীন আর্থিক সংকটে ভুগছে, তখন এই ব্যক্তির ঋণ নেয়াটা গ্রাহকদের মনে অনাস্থার পরিমাণটা বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি দেশের কথিত শীর্ষ ধনী। অথচ তার কাছে প্রায় লক্ষাধিক কোটি টাকা ঋণ পাওনা রয়েছে। দেশে ব্যাংক ঋণ নিয়ে নতুন ব্যাংক বানানোর কারণে সৃষ্টি হয়েছে অচলাবস্থা। দেশের ব্যাংকগুলো এখন ভুগছে তারল্য সংকটে। তাই দেখা যায় কলমানির রেট বেড়েই চলছে। কয়েকদিন আগে এক দিনে কলমানি রেট ৬ দশমিক ৩৭ থেকে বেড়ে ৯ দশমিক ২৪ হয়ে যায়। সাধারণ কলমানির রেট বৃদ্ধি পায় যখন ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ভুগে। তখন ব্যাংকগুলো বাজার থেকে অর্থ ধার করে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, আমানতের পরিমাণ কমে যাওয়া, ঋণখেলাপি বেড়ে যাওয়া ও ঋণ আদায়ের ধীরগতি তারল্য সংকটের প্রধান কারণ। তারল্য সংকট বাড়লেই ব্যাংকগুলো ঋণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়। তাই বেড়ে যায় ব্যাংকগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার প্রবণতা। গড়ে প্রায় প্রতিদিনই ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। কিছু দিন আগে এক দিনেই ২৭টি ব্যাংক ও একটি এনবিএফআই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আরও ১৩ হাজার ৪২২ কোটি টাকা ঋণ নেয়। চলমান তারল্য সংকটের অন্যতম কারণ হলো, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পলিসি। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দেশের চলমান মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বাড়িয়েছে এটা তারল্য সংকটের একটি কারণ। গত বছরের অক্টোবরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট ৭৫ বেসিসে পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ করায় কলরেট দ্রুত বাড়তে থাকে। তার পরপরই নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক আকাশছোঁয়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্র ৫০ বেসিস পয়েন্টে বাড়িয়ে দেয় ৭.৭৫ শতাংশ। এর ফলে আর বাড়ে সংকট। অর্থ বাজারে আমানত সংগ্রহে সরকার ও ব্যাংকগুলো পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। এর জন্য ব্যাংকগুলো  আরও ভুগছে তারল্য সংকটে। সম্প্রতি সরকার নিলামের মাধ্যমে একদিনেই যথাক্রমে ১১ দশমিক ১৫ শতাংশ, ১১ দশমিক ২০ শতাংশ, ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ সুদে ৯১ দিন, ১৮২ দিন এবং ৩৬৪ দিনের ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে বাজার থেকে ৬ হাজার ১৮৩ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। সরকারের মতো এত বেশি হারে ব্যাংকগুলো সুদ দিতে পারে না।  সরকারের এ ধরনের অর্থ সংগ্রহ করার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলোর আমানত কমছে আর বাড়ছে তারণ্যের সংকট। তাই ব্যাংকগুলো এখন চরম চ্যালেঞ্জের মুখে। একদিকে ব্যাংকগুলো বাজার থেকে আমানত সংগ্রহ করে তারল্য সংকট কাটানোর চেষ্টা করছে; অপরদিকে সরকার নিজের অর্থ সংগ্রহের পরিধি বাড়ানোর জন্য ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হার বাড়িয়ে দিচ্ছেন। ফলে আমানতকারীরা সরকারের বিল বন্ড কিনছে।  তাই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সরকারের অর্থ সংগ্রহের কাছে ব্যাংকগুলো হেরে যাচ্ছে। গত দুই বছর ধরে বৈদেশিক মুদ্রা ঘাটতি পূরণে ব্যাংকগুলো টাকার বিনিময়ে আন্তঃব্যাংক প্ল্যাটফর্ম ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কিনছে ডলার। অপরদিকে ঋণগ্রহীতারা ঋণ ফেরত দিচ্ছে না তারা বলছেন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। 

এছাড়া ব্যাংক পরিচালকদের ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হওয়ার প্রবণতাও দেখা যায়। আইন আছে বিভিন্ন ধরনের। পরিচালকরা ঋণখেলাপি হলে ব্যাংক ফৌজদারি ব্যবস্থায় পরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে,  তবে নানা আইনি ফাঁকফোকরে তা আর হয় না। দেশের এতদ সংক্রান্ত আইন কঠোর। কিন্তু সামগ্রিকভাবে এমন দেখা যায় পরিচালনা পর্ষদ নানা ফন্দিফিকির করে ঋণখেলাপি হতে মুক্ত হয়ে যান। সে জন্য রাষ্ট্রের তৈরি আইন তাদের ধরতে পারে না। রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক রাজধানীর বনানী শাখা বেনামি এক কোম্পানিকে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। কোম্পানিটির নাম গ্লোবাল করপোরেশন। এ কোম্পানির জন্য আরও ৩৬ কোটি টাকা অনুমোদনের জন্য পরিচালনা পর্ষদের কাছে  আবেদন জমা আছে। গণমাধ্যমের সংবাদ থেকে জানা গেছে, কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক এই ঋণটি প্রদান করে। অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের মেগা প্রকল্পগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারে ঋণের ৫০ শতাংশই অভ্যন্তরীণ। যদি অভ্যন্তরীণ অর্থ সংগ্রহের মাধ্যমে ভৌত অব কাঠামো নির্মাণে ব্যয় করা হয়, তাহলে ব্যাংকগুলো অর্থ সংগ্রহ করার বাজার পাবে কোথায়। ফলে বাড়ছে তারল্য সংকটসহ মূল্যস্ফীতি। নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন ধারণ হয়ে উঠছে কষ্টকর। আসছে আগামী বাজেটে সরকারের বড় ধরনের অর্থ সংগ্রহের প্রয়োজন হবে। সরকার এই অর্থ সংগ্রহ করবেন ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে। এর ফলে সংকট আর বাড়বে। তাই সকল দিক বিবেচনায় নিয়ে সরকারের অর্থ সংগ্রহের বিষয়টি দেখা দরকার। 

উন্নয়নকর্মী, মুক্ত লেখক

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০