ইসমাইল আলী: যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আর্থিক খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর্থিক খাতের তিনটি দিক রয়েছে। এগুলো হলোÑব্যাংক খাত, পুঁজিবাজার ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা তুলনামূলক অনেক। আর্থিক খাতের বাকি দুটি দিকই আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আর এর পেছনে অন্যতম কারিগর ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন অধ্যাপক।
দেশের ব্যাংক খাতের দুরবস্থার শুরু হয় আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর। সে সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন ড. আতিউর রহমান। তার মেয়াদকালে দেশের ব্যাংক খাত সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত হয়ে ওঠে। রিজার্ভ চুরি, ইচ্ছেমতো নতুন ব্যাংক অনুমোদন, ব্যাংক খাতের বড় কেলেঙ্কারির সূচনা ইত্যাদি কারণে তিনি বিতর্কিত হয়ে ওঠেন। প্রায় সাত বছর দায়িত্ব পালন শেষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
আর্থিক খাতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পুঁজিবাজার। দেশে এ বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কমিশনের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন শিবলী। প্রায় সাড়ে চার বছরের দায়িত্ব পালনকালে তিনি নামে-বেনামে শেয়ার ব্যবসা, জুয়াড়িদের সহযোগিতা, অর্থ পাচারসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান ২০০৯ সালের ১ মে গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেন। প্রথমে চার বছরের জন্য নিয়োগ দেয়া হলেও, পরে তার মেয়াদ আরও তিন বছরের জন্য বাড়ানো হয়েছিল। তবে রিজার্ভ চুরির তথ্য গোপন রাখার দায়ে নানা মহলের সমালোচনার মধ্যে ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। এর আগে তিনি রিজার্ভ চুরির তথ্য ২৪ দিন গোপন রাখেন।
ফরাসউদ্দিন কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে এ নিয়ে বলেছিল, ‘অর্থ চুরির তথ্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে গোপন করার কোনোই যৌক্তিকতা নেই, বরং গর্হিত অপরাধ। আর বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, এমনকি অর্থ মন্ত্রণালয়কে না জানানোটা অসদাচরণ।’ ২৯ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনের দ্য ইনকুয়ারার পত্রিকায় বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির সংবাদ প্রকাশিত হলে ১ মার্চ গভর্নর গোয়েন্দা সংস্থাকে জানান। এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রীকে এসএমএস পাঠান এবং ৭ মার্চ অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন।
যদিও রিজার্ভ চুরি হয়েছিল ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার রাতে। বাংলাদেশ ব্যাংক এই চুরির বিষয়ে নিশ্চিত হয় ৬ ফেব্রুয়ারি শনিবার দুপুরে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বা অর্থমন্ত্রী কাউকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়নি। এর কারণ জানতে চেয়েছিল তদন্ত কমিটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর আবুল কাসেম তথ্য গোপনের বিষয়ে লিখিত বক্তব্যে বলেছেন, ৪ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার রাতে চুরি হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তা ধরা পড়ে ৬ ফেব্রুয়ারি শনিবার। অর্থ চুরির ঘটনা নিশ্চিত হওয়ার পর শনিবার দুপুরে তিনি বিষয়টি গভর্নর আতিউর রহমানকে জানান এবং থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে জিডির অনুলিপি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়কে পাঠানোর জন্য তিনি বলেন। কিন্তু গভর্নর তাকে জানান, জিডি করলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা হয়রানির শিকার হবেন এবং আতঙ্কিত হয়ে পড়বেন। আর অর্থমন্ত্রী কোথায় কী বলে ফেলেন ঠিক নেই। এমনকি অভ্যন্তরীণ তদন্তও গোপনে করার জন্য তিনি ব্যাংক কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন।
শুধু রিজার্ভ চুরির তথ্য গোপনই নয়, বাছবিচার ছাড়া নতুন ব্যাংক অনুমোদন দিয়েছিলেন ড. আতিউর রহমান। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা চিন্তা করে নতুন ব্যাংক অনুমোদনের বিপক্ষে মতামত দিয়েছিলেন আর্থিক খাত বিশেষজ্ঞরা। তবে সেগুলো বিবেচনায় না নিয়ে ৯টি ব্যাংক অনুমোদন দেন তিনি। এসব ব্যাংকের মালিকানায় ছিল আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতারা। অনুমোদনের পর সব কয়টি ব্যাংক লুটপাটের কারণে কয়েক বছরের মধ্যে দুর্বল অবস্থায় চলে যায়।
আতিউর রহমানের সময় খেলাপি ঋণও এক লাফে আড়াই গুণ হয়ে যায়। ড. আতিউর রহমানের প্রথম মেয়াদে চার বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পায় প্রায় ২০ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় মেয়াদে খেলাপি বাড়ে ১৬ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। তার দুই মেয়াদে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ৩৬ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা। তিনি দায়িত্ব নেয়ার সময় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। পদত্যাগ করার সময় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ রেখে যান ৫৯ হাজার ৪১১ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ বেড়েছিল এ গভর্নরের আমলে।
যদিও তার আগে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের মেয়াদকালে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছিল মাত্র চার হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। তার আগে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের মেয়াদে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ছয় হাজার ৯০ কোটি টাকা ও ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের আমলে খেলাপি বাড়ে তিন হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা। লুৎফুর রহমান সরকারের সময় আট হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা এবং খোরশেদ আলমের সময়ে চার হাজার ৪৮০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পায়। ড. আতিউর রহমানের সময় ব্যাংক খাতে সবচেয়ে আলোচিত হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক লুটপাটসহ ব্যাংক খাতে বড় বড় অনিয়ম ঘটে। তবে তিনি এসবের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকাই রাখেননি।
অন্যদিকে দেশে করোনা সংক্রমণের সময় চলমান লকডাউনের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের সাবেক ডিন ও ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বিএসইসির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। দায়িত্ব নিয়েই দরকারি সব সংস্কার ও সুশাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দ্রুত বাজার চাঙ্গা হওয়ার বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের আশাবাদীও করেছিলেন তিনি। এতে বাজারে শেয়ারদরের কিছুটা উত্থানও হয়েছিল; তবে সেটা ছিল ক্ষণস্থায়ী।
ঢাকা এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক-ডিএসইএক্স ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১০০ শতাংশের বেশি বেড়ে ৭ হাজার ৩০০ পয়েন্ট ছাড়িয়েছিল। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা যখন জানতে পারলেন যে ছোট মূলধন সীমার খাতগুলোর অস্বাভাবিক উত্থানের পেছনে কাজ করছে শিবলীর সমর্থিত একটি চক্র, ঠিক তার সঙ্গে সঙ্গেই দরের উত্থান বন্ধ হয়ে যায়। এরপর টানা পতনের বৃত্তে ঘুরপাক খায় পুঁজিবাজার।
যদিও দায়িত্ব পালনকালে চার বছরে নামে-বেনামে নিজেই করেন শেয়ার ব্যবসা। এতে সংশ্লিষ্ট চক্রের মাধ্যমে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। তার মেয়াদকালে হিরু-সাকিবসহ জুয়াড়ি চক্র বিভিন্ন স্বল্প মূলধনি কোম্পানির শেয়ারদরে অস্বাভাবিক উত্থান ঘটায়। পরবর্তী সময়ে তাদের নামকাওয়াস্তে জরিমানা করে দায়সারা দায়িত্ব পালন করে বিএসইসি। সম্প্রতি শিবলী-হিরুসহ পুঁজিবাজারে কারসাজি চক্রের আটজনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে।
এদিকে পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের নামে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শহরে রোড-শোর আয়োজন করেন শিবলী রুবাইয়াত। তবে এসব রোড-শোর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে কোনো বিদেশি বিনিয়োগ না এলেও, তিনি টাকা পাচারের সুযোগ হাতছাড়া করেননি। এছাড়া মিলিয়ন ডলার জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত একটি ব্যাংক হিসাব থেকে বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম অর্থ পেয়েছেন বলে গত বছর ‘অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট’ বা ওসিসিআরপিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
এর বাইরেও বিভিন্নভাবে পুঁজিবাজারকে অকার্যকর করে রাখেন শিবলী রুবাইয়াত। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে (ডিএসই) অকার্যকর করে রাখা। মূলত বিএসইসির হস্তক্ষেপের জন্য স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি ডিএসই। সংস্থাটির যত স্বাধীন ক্ষমতা ছিল তা সব কেড়ে নেন তৎকালীন বিএসইসি চেয়ারম্যান। ফলে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার কারসাজিসহ নানা অনিয়ম হলেও দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারেনি ডিএসই। লিস্টিং রুলস অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে স্বচ্ছতা আনতে স্টক এক্সচেঞ্জকে অনেক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু ২০২০ সালের মে মাসে শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম দায়িত্ব নেয়ার পর বহু অনিয়ম হলেও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি স্টক এক্সচেঞ্জ। প্রাইমারি রেগুলেটর হলেও এখন ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা ছাড়া কার্যত কোনো ক্ষমতা নেই স্টক এক্সচেঞ্জের। অথচ তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব স্টক এক্সচেঞ্জের।
এছাড়া স্টক এক্সচেঞ্জের বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে কমিশনের আস্থাভাজন লোকজন বসিয়ে মূলধন উত্তোলন করা কোম্পানিতে প্রাইভেট প্লেসমেন্টে শেয়ার কারসাজির সুযোগও দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) রিভিউ কমিটি, মার্কেট অপারেশন্স ও ইনভেসটিগেশন বিভাগ থেকে যোগ্য লোকদের সরিয়ে দিয়ে পছন্দের লোকজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল শিবলীর মেয়াদকালে।