নিজস্ব প্রতিবেদক: ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী। গত মাসেই ১১ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে সরকার। ফলে চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) সরকারের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নিট বেড়ে ৫২ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। ব্যবসায় মন্দার কথা বলে ব্যবসায়ীদের অনেকে তুলনামূলক কম কর দিচ্ছেন। সরকারের ব্যয়ও বেশি কমছে না। একরকম বাধ্য হয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হচ্ছে। কারণ সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমে গেছে। নতুন করে কেনার চেয়ে সঞ্চয়পত্র ভাঙছেন বেশি গ্রাহকরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকারের ব্যাংক থেকে নিট ঋণের পরিমাণ ছিল ৪১ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। মার্চে তা বেড়ে ৫২ হাজার ৩৬০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ মার্চে সরকারের ব্যাংক ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা। জানুয়ারি পর্যন্ত নিট ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৪ হাজার ৫৯০ কোটি এবং ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল ২৭ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা।
সরকারের ঋণ এখনও কেন্দ্রীয় ব্যাংকমুখী। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নিট ৫২ হাজার ৩৬০ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়েছে ৫০ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দিয়েছে ১ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ব্যাংক ব্যবস্থায় সরকারের মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ২৬ হাজার ৬৭২ কোটি টাকায়। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্থিতি ১ লাখ ১০ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা। বাকি ২ লাখ ১৬ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা দিয়েছে অন্য ব্যাংকগুলো। চলতি অর্থবছর ব্যাংক থেকে সরকারের ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা আছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, সাধারণ সুদহারের চেয়ে ট্রেজারি বিলের সুদহার কম হওয়ায় বাণ্যিজিক ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বিল বন্ড কেনায় আগ্রহ হারাচ্ছে। তাই এসব ট্রেজারি বিল বন্ড কিনছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ না বেড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাড়ছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, তা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৬৬ শতাংশ বেশি। তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রথম নয় মাসে সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে ৯ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা ঋণ নেয়। চলতি অর্থবছরের একই সময় নিয়েছে ৫২ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা।
এদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়া কমিয়ে সঞ্চয়পত্রে বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ নিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা এক প্রতিবেদনে এমন পরামর্শ উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংক ব্যবস্থায় সরকারের ঋণ বাড়ছে। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রসহ ব্যাংকবহির্ভূত খাতে কমছে। অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির চলমান চাপ বিবেচনায় ব্যাংক থেকে ঋণ কমিয়ে ব্যাংকবহির্ভূত খাতে বাড়ানো দরকার।
জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই সরকারকে ঋণ দেয়ার মানে হলো নতুন টাকা ছাপানো। ব্যাংক খাতে পর্যাপ্ত তারল্য নেই। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিচ্ছে। আমরা জানি, সরকারের চলতি হিসাবে ঘাটতি থাকলে নতুন টাকা ছাপানো যায় না। সরকারের চলতি হিসাবে এখন বিপুল ঘাটতি। এ অবস্থায় হিসাবশাস্ত্রের
কোনো তত্ত্ব ব্যবহার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে ঋণ দেয়ার পাশাপাশি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করছে, সেটি বোধগম্য নয়।
তিনি বলেন, রাজস্ব আহরণে সরকারের ব্যর্থতার কারণে প্রতি বছর ঘাটতি বাজেটের পরিমাণ বাড়ছে। বিশ্বের কোনো দেশই এত কম রাজস্ব আয় দিয়ে চলে না। বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত আট শতাংশে নেমে এসেছে। এটি বাড়ানো সম্ভব না হলে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি উৎস থেকে সরকারের ঋণ বাড়বেই।