ব্যাংক থেকে ১,৪৫,০০০ কোটি টাকা ঋণ নেবে সরকার

রোহান রাজিব: রাজস্ব আদায়ে গতি না থাকার কারণে সরকার বিভিন্ন ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। সরকারের কাছে পর্যাপ্ত টাকাও নেই। তাই ব্যাংক থেকে ধার করতে হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। শুধু আগামী তিন মাসে ব্যাংক থেকে এক লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। এই ঋণের সিংহভাগই নেয়া হবে স্বল্পমেয়াদি ঋণ, যার পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকারও বেশি। সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডের ত্রৈমাসিক অকশন ক্যালেন্ডার থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেয়া বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আবার সঞ্চয়পত্র থেকেও তেমন ঋণ পাচ্ছে না সরকার। রাজস্ব আদায়েও গতি নেই। এমন পরিস্থিতিতে সরকারকে বিভিন্ন ব্যয় মেটাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ওপরই বেশি নির্ভর করতে হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ট্রেজারি ও ঋণ ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগ থেকে এই তিন মাসের ট্রেজারি বিল ও বন্ডের অকশনের তারিখ ও ঋণের পরিকল্পনা দেয়া হয়েছে। তবে আলোচ্য তিন মাসে আগে নেয়া ঋণের একটা বড় অংশ মেয়াদপূর্তিতে পরিশোধও হবে। ফলে সমন্বয়ের পর নিট ব্যাংকঋণের পরিমাণ কমে অর্ধেকের নিচে নেমে আসবে।

চলতি অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেয়া হবে ৭২ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা, আর স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেয়া হবে ৬৪ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। সরকারের অকশন ক্যালেন্ডারের তথ্য বলছে, আগামী তিন মাসে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের অকশন করে সরকার মোট ব্যাংকঋণ নিবে এক লাখ ৪৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি নেয়া হবে এক লাখ ছয় হাজার কোটি টাকা। আর দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেয়া হবে মাত্র ৩৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

বাজেটে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের লক্ষ্য বেশি দেয়ার পরও সরকার স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি নিচ্ছে। এর কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘমেয়াদি বন্ডের চেয়ে স্বল্পমেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদের হার কম। এ কারণে সুদব্যয় কমাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি নেয়ার পরিকল্পনা করেছে সরকার। তাছাড়া ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট রয়েছে। ফলে দীর্ঘ মেয়াদে তহবিল বিনিয়োগ করতে ব্যাংকগুলোরও অনীহা রয়েছে।

কোন মাসে কত ঋণ নেবে সরকার: অকশন ক্যালেন্ডারের তথ্য বলছে, অক্টোবরে স্বল্পমেয়াদি ট্রেজারি বিলের চারটি অকশন করে মোট ৩৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেবে সরকার। নভেম্বর মাসেও চারটি অকশন করে নেয়া হবে ৩২ হাজার কোটি টাকা। আর ডিসেম্বর মাসে পাঁচটি অকশন করে নেয়া হবে ৪০ হাজার কোটি টাকা। এই তিন মাসে ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের বিপরীতে ৪৭ হাজার ৫০০ কোটি, ১৮২ দিন ট্রেজারি বিলের বিপরীতে ৩২ হাজার ৫০০ কোটি ও ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের বিপরীতে ২৬ হাজার কোটি টাকা নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। অন্যদিকে অক্টোবর মাসে পাঁচটি অকশন করে দীর্ঘমেয়াদি বন্ডের বিপরীতে ১৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা নেয়া হবে। পরের মাস নভেম্বরে চারটি অকশন করে নেয়া হবে ১১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। আর ডিসেম্বর মাসেও চারটি অকশন করে নেয়া হবে ১১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এই তিন মাসে দুই বছর মেয়াদি বন্ডের বিপরীতে ১২ হাজার কোটি, তিন বছর মেয়াদি বন্ডের বিপরীতে ৯০০ কোটি, পাঁচ বছর মেয়াদি বন্ডের বিপরীতে ৯ হাজার ৫০০ কোটি, ১০ বছর মেয়াদি বন্ডের বিপরীতে আট হাজার কোটি, ১৫ বছর মেয়াদি বন্ডের বিপরীতে চার হাজার কোটি ও ২০ বছর মেয়াদি বন্ডের বিপরীতে চার হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করেছে সরকার।

প্রথম তিন মাসেও ব্যাংকঋণ ঊর্ধ্বমুখী: বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, গত অর্থবছরের জুন শেষে বাণিজ্যিক ব্যাংকে সরকারের ঋণের স্থিতি ছিল তিন লাখ ১৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা, যা চলতি বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৫৮ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাস ২৩ দিনে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সেপ্টেম্বরের ২৩ দিনে নেয়া হয়েছে ১৭ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা। আর গত আগস্টে নেয়া হয় ২৩ হাজার ১০৬ কোটি টাকা। আর অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইতে নেয়া হয় মাত্র পাঁচ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের প্রথম দুই মাস ২৩ দিনে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ২৪ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। সে হিসাবে এবার ব্যাংকঋণ বেড়েছে ১৫ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা।

সাধারণত অর্থবছরের প্রথম জুলাইয়ে সরকার বেশি ঋণ করে থাকে। তবে এবার জুলাই মাসে তুলনামূলকভাবে কম ঋণ নেয়া হয়। মূলত কোটা সংস্কার ইস্যুতে আন্দোলনের কারণে ওই মাসে কিছুদিন ব্যাংকও বন্ধ রাখা হয়। ফলে সরকারের ঋণ নেয়ার নিয়মিত অকশন হয়নি। তবে বরাবরই বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে যতটা সম্ভব কম ঋণ নেয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছেন অর্থনীতিবিদরা। কারণ এতে বেসরকারি খাত প্রয়োজনীয় ঋণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে তারল্য সংকটে ভুগছে অনেক ব্যাংক। এতে উদ্যোক্তাদের ব্যাংকঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে, যা অর্থনীতির জন্য ভালো নয় বলে মনে করেন তারা। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ে সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ দেয়ায় তারল্যে এক ধরনের চাপ তৈরি করছে, তাতে কল মানির রেটও ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশে উঠছে। রপ্তানি কম হওয়ায় বেসরকারি খাতে ঋণ চাহিদা কম ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, তাই এই প্রভাবটা (সরকারের ঋণ গ্রহণ) সেভাবে বোঝা যায়নি। ব্যাংকগুলো নির্ভরযোগ্য বিনিয়োগ হিসাবে সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বেছে নিচ্ছে। কারণ সরকার টাকা নিলে সেই টাকা নিরাপদ ও সুদের হারও বেশি। ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হার আগে বেশি ছিল না। কিন্তু গত দেড়-দুই বছরের মধ্যে সুদের হার সর্বোচ্চ হয়েছে।

জানা যায়, গত অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর কাছে ১২ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। এর বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এক লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা ঢুকেছে। এসবের প্রভাবে অনেক ব্যাংক তারল্য সংকটে রয়েছে। তবে এখন বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০