একটি প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন বিভাগ-প্রধানের সাফল্যের ওপর নির্ভর করে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও’র সাফল্য। সিইও সফল হলে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা বেশি হয়। খুশি হন শেয়ারহোল্ডাররা। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে সিইও’র সুনাম। প্রতিষ্ঠানের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও), কোম্পানি সচিব, চিফ কমপ্লায়েন্স অফিসার, চিফ মার্কেটিং অফিসারসহ এইচআর প্রধানরা থাকেন পাদপ্রদীপের আড়ালে। টপ ম্যানেজমেন্টের বড় অংশ হলেও তারা আলোচনার বাইরে থাকতে পছন্দ করেন। অন্তর্মুখী এসব কর্মকর্তা সব সময় কেবল প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বাস্তবায়নে ব্যস্ত থাকেন। সেসব কর্মকর্তাকে নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন ‘টপ ম্যানেজমেন্ট’। শেয়ার বিজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এবার রহিমআফরোজ এর গ্রুপ সিএফও মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. হাসানুজ্জামান পিয়াস
মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ও ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট। দুই দশকের অধিক সময় ধরে তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রুপ অব কোম্পানিজ ও বহুজাতিক কোম্পানিতে ফাইন্যান্স বিভাগের শীর্ষ পদে কাজ করে আসছেন। পাশাপাশি অর্থনীতিবিষয়ক লেখালেখি, টেলিভিশন টকশোতে অংশগ্রহণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা ও করপোরেট ট্রেনার হিসেবে তার উপস্থিতি আছে। বর্তমানে তিনি দেশের অন্যতম স্বনামধন্য গ্রুপ অব কোম্পানিজ রহিমআফরোজ এর গ্রুপ সিএফও হিসেবে কর্মরত
শেয়ার বিজ: বিশ্বায়নের এ যুগে প্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারণ ও সার্বিক ব্যবস্থাপনায় প্রধান অর্থ কর্মকর্তার (সিএফও) ভূমিকা কী?
মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন: সিএফও প্রতিষ্ঠানের পরিচালকমণ্ডলীকে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করেন। গৃহীত পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত যাতে আর্থিক ও ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে লাভজনক, যথাসম্ভব ঝুঁকিমুক্ত, আইনসম্মত ও টেকসহ হয়, সে ব্যাপারে সিএফও দিকনির্দেশনা দেয়।
শেয়ার বিজ: ফাইন্যান্স পেশাজীবীদের জন্য দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কী কী বিষয় অগ্রাধিকারসহ বিবেচনা করতে হবে?
জাহিদ হোসেন: প্রযুক্তির উৎকর্ষের এ যুগে ফাইন্যান্স পেশাজীবীদের গতানুগতিক ধ্যানধারণা থেকে বের হয়ে এসে ব্যবসার জন্য সরাসরি সহায়তা হয় এমন কর্মকাণ্ডে মনোযোগী হতে হবে। প্রতিষ্ঠানের মুনাফা বৃদ্ধি করার সঙ্গে সহজ শর্তে অর্থসংস্থান করতে হবে। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং তথ্য বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে, যাতে প্রতিষ্ঠান তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে।
শেয়ার বিজ: বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোতে করপোরেট গভর্ন্যান্স সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
জাহিদ হোসেন: বাংলাদেশের প্রায় সব দেশীয় বৃহৎ করপোরেট হাউজগুলোতে এখন দ্বিতীয় প্রজন্মের নেতৃত্ব চলে এসেছে। তারা পশ্চিমা বিশ্বে উচ্চতর লেখাপড়া করেছে এবং গ্লোবাল করপোরেটগুলোর ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি সম্পর্কে জেনেছে। দেশে আসার পর নিজ প্রতিষ্ঠানে তারা করপোরেট গভর্ন্যান্স চালু করেছে। যেমন ইআরপি (এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং) বাস্তবায়ন করা, দেশি-বিদেশি পেশাজীবীদের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করা, মানবসম্পদ উন্নয়নে মনোযোগ দেওয়া প্রভৃতি। অন্যদিকে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে করপোরেট গভর্ন্যান্স পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। এটাও দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত, যাতে তারা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের মতো সফল হতে পারে।
শেয়ার বিজ: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?
জাহিদ হোসেন: রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এ মুহূর্তের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এটাই মূলত দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছে। তাছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকার অব্যাহত মূল্যায়ন, অর্থ পাচার, খেলাপি ঋণ, দুর্নীতি ও আমলাতন্ত্র কাক্সিক্ষত মাত্রায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য হুমকি।
শেয়ার বিজ: বর্তমানে ব্যাংক সেক্টরের অস্থিরতা করপোরেটকে কীভাবে ব্যবসা পরিচালনায় বাধাগ্রস্ত করছে?
জাহিদ হোসেন: ব্যাংক সেক্টরের অস্থিরতা করপোরেট জগতকে দুইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে-ফান্ডের স্বল্পতা উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত করছে এবং ফান্ডের অত্যধিক রেট (১১%-১৬%)। এ ধরনের সীমাবদ্ধতা ব্যাংক ও করপোরেট ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান উভয়কেই ক্ষতির সম্মুখীন করছে।
শেয়ার বিজ: বাংলাদেশে ব্যবসারত দেশি ও বিদেশি করপোরেটগুলোর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির ব্যাপারে অনীহা কেন?
জাহিদ হোসেন: সুনাম আছে এমন করপোরেটরা স্টক মার্কেটে তালিকাভুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানে তাদের নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পাবে বলে ধারণা করে। তাই তারা এ ব্যাপারে আগ্রহী হয় না। তালিকাভুক্তির ফলে করপোরেট করহারেও খুব বেশি প্রণোদনা নেই। তাছাড়া বাজারে এখন মন্দাভাব থাকায় শেয়ারের ভালো মূল্য না পাওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায়।
শেয়ার বিজ: দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে করপোরেট সেক্টরের ভূমিকা কী?
জাহিদ হোসেন: জাতীয় বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে রাজস্বের ভূমিকা অনস্বীকার্য। রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের ক্ষেত্রে করপোরেট হাইজগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর প্রদানের মাধ্যমে সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। তাছাড়া কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, বিনিয়োগ তথা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল রাখার মাধ্যমে করপোরেটগুলো দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শেয়ার বিজ: ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে সরকারের ভূমিকা কি যথাযথ বলে মনে করেন?
জাহিদ হোসেন: বর্তমান সরকার ব্যবসাবান্ধব। সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে উপযুক্ত ভূমিকা রাখছে। গ্যাস ও বিদ্যুতের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা, বিভিন্ন মেগা প্রজেক্টের বাস্তবায়নের মাধ্যমে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রভৃতি সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। তথাপি দুর্নীতি দমন, চট্টগ্রাম বন্দর আধুনিকীকরণ, ব্যাংকিং সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, পুঁজিবাজারকে গতিশীল করা এবং কর ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে সরকারের নজর দেওয়া উচিত।
শেয়ার বিজ: ফাইন্যান্সকে পেশা হিসেবে আরও গ্রহণযোগ্য করতে সংশ্লিষ্ট কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?
জাহিদ হোসেন: গতানুগতিক বিবিএ কিংবা এমবিএ সার্টিফিকেট অর্জনের প্রবণতা থেকে শিক্ষার্থীদের বের হয়ে আসতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে শিক্ষার সঙ্গে কর্মক্ষেত্রের যোগসূত্র তৈরি করার লক্ষ্যে কারিকুলাম সাজাতে হবে। করপোরেটের নবীন এক্সিকিউটিভদের ক্যারিয়ারের পরিকল্পনা করে নিজেকে তৈরি করতে হবে। তাদের যথাযথ মনোযোগসহ নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। সর্বোপরি উচ্চাশা থাকতে হবে।
শেয়ার বিজ: আগামী দশক শেষে আপনি বাংলাদেশকে কোথায় দেখবেন বলে আশা করেন?
জাহিদ হোসেন: যে গতিতে দেশ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগোচ্ছে, তাতে আমি মনে করি ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ এশিয়ার একটি অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে। এসডিজি’র প্রায় সবকটি লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে বাংলাদেশ। তবে এজন্য সরকারি ও বেসরকারি খাতকে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে হবে।