সম্প্রতি প্রাথমিক স্তরে পড়ুয়া শিশুদের ব্যাগের বোঝা কমাতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। নির্দেশনা অনুসারে আগামী ছয় মাসের মধ্যে শিশুর শরীরের ১০ শতাংশের বেশি ওজনের ব্যাগ বহন নিষিদ্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়গুলোয় সার্কুলার জারি করতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যালয়গুলো নির্দেশ পালন করছে কি না, তা পর্যবেক্ষণের জন্য মনিটরিং সেল গঠন এবং নির্দেশনা না মানলে কী শাস্তি হবে, তাও যাতে সার্কুলারে উল্লেখ থাকেÑসে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে হাইকোর্ট থেকে। বাংলাদেশে, বিশেষত শহুরে এলাকায় শিশুরা যে পরিমাণ বই-খাতার বোঝা পিঠে নিয়ে বিদ্যালয়ে যায়, তার পরিপ্রেক্ষিতে এ নির্দেশনাকে যুগান্তকারী হিসেবে দেখা হবে। আমরা এ রায়কে স্বাগত জানাই এবং বিদ্যালয়গুলো যেন নির্দেশনাটি গাফিলতি ছাড়া পুরোপুরি পালন করে, সে আহ্বান জানাই।
প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক পর্যায়ে পড়ালেখার জন্য শিশু যখন বিদ্যালয়ে যায়, তাদের সেই বয়সটি নানা ধরনের বিকাশের সময়। প্রাক-শৈশব যতœ ও বিকাশ নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তাদের মতে, এ সময়ে শিশুদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, আবেগিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, ভাষাগত ও যোগাযোগ দক্ষতার বিকাশ ঘটে। এ সময় তাদের গড়ে তুলতে হয় সাবধানতার সঙ্গে। শিশুর বিকাশ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নেওয়া ও তার বাস্তবায়ন করতে হয় সচেতনভাবে। বাংলাদেশের শিশুরা যে মাত্রাতিরিক্ত ব্যাগের বোঝা বয়ে বিদ্যালয়ে যায়Ñবিষয়টি বার বার আলোচনায় এলেও এতে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা অভিভাবকরা সচেতন হননি। অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের ‘ক্রেডিট’ বাড়াতে পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়। অনেক বিদ্যালয়ে প্রতিটি বিষয়ের জন্য আলাদা খাতা রাখতে হয়। এর বাইরে পেনসিল বক্স, জ্যামিতি বক্স, টিফিন বক্স প্রভৃতি তো আছেই। শিশুর পিঠের ওপর বই-খাতার বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার জন্য প্রধানত বিদ্যালয় দায়ী হলেও অভিভাবকরাও কম দায়ী নন। অভিভাবকদের চাপে অনেক সময় বিদ্যালয় বাড়তি বাড়ির কাজ ও বই দিতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে বিদ্যালয় এই বাড়তি অংশটুকু না দিলে অনেক অভিভাবক সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের ওপর আস্থা রাখতে পারেন না। ফলে একটি চক্রের মধ্য দিয়েই আবর্তিত হচ্ছিল শিশুদের অতিরিক্ত বোঝা বহনের বিষয়টি। অথচ আমাদের পাশের দেশ ভারত কিংবা শ্রীলঙ্কায় আগে থেকেই অতিরিক্ত ব্যাগ বহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে শুধু নিষেধাজ্ঞা নয়, আমরা চাইবো প্রতিটি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক ও অভিভাবক যেন উপলব্ধি করতে পারেন, শিশুদের বয়স বিবেচনায় বাড়তি যে কোনো কিছুই তাদের জন্য ক্ষতিকর; এমনকি বাড়তি পড়ালেখা। শৈশবকালে মানুষের বিকাশের বিষয়টি এক জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আবর্তিত হয় এবং সেখানে কোনো অপচর্চা ঢুকে পড়লে তা বয়ে বেড়াতে হয় সারাজীবন। আমাদের শিশুদের অনেকের যে লেখাপড়া-ভীতি আছে, তার একটি বড় কারণ লেখাপড়াকে বোঝা হিসেবে গ্রহণ করা। ব্যাগের অতিরিক্ত ভার এতে বাড়তি ইন্ধন জুগিয়েছে। আমরা চাইবো, শিশুর কাঁধ ও পিঠ থেকে অতিরিক্ত বোঝা কমুক, পারতপক্ষে শূন্য হোক। এর বদলে দিনে দিনে বাড়ুক পড়ালেখার প্রতি আনন্দময় আগ্রহ ও জ্ঞানের ভার।
Add Comment