Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 10:27 pm

ব্যাগ ভর্তি ঘুষে টাকা বহনের শাস্তি ‘বাধ্যতামূলক অবসর’

নিজস্ব প্রতিবেদক : বিমানে করে ব্যাগ ভর্তি টাকা নিয়ে এসে আটক হয়েছেন। সেই আটক নিয়েও হয়েছে নাটক। শেষে সাময়িক বরখাস্ত হলেন। তদন্ত কমিটি হলো। প্রতিবেদন দিয়েছে। যাতে টাকার উৎস অজানা রয়ে গেল। শেষে এই বিপুল পরিমাণ টাকাকে ‘জ্ঞাত আয় বর্হিভূত’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কর্মকর্তা কর্মস্থল ত্যাগ করতে অনুমতি নেয়নি। শেষে ‘জ্ঞাত আয় বর্হিভূত’ টাকা বহন ও অনুমতি না নিয়ে কর্মস্থল ত্যাগ করায় ‘বাধ্যতামূলক অবসর’ দেয়া হয়েছে। এই কর্মকর্তা হলেন—বেনাপোল কাস্টম হাউসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা খন্দকার মুকুল হোসেন। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এই কর্মকর্তার ঘুষের টাকা বিষয়ে মামলা করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খন্দকার মুকুল হোসেন ব্যবসায়ী আর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট থেকে বিপুল টাকা ঘুষ নিয়েছেন। সেই টাকা বহন করে ঢাকায় নিয়ে আসছেন। এই টাকা ভাগ করে দেবেন। কিন্তু ঘুষের এত টাকা বহনের শাস্তি মাত্র বাধ্যতামূলক অবসর! অবসর দেয়ার মাধ্যমে তাকে বাঁচিয়ে দেয়া হয়েছে।
এনবিআর সূত্রমতে, ২ জুন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম সই করা আদেশ জারি করা হয়েছে। খন্দকার মুকুল হোসেন বেনাপোল কাস্টম হাউসে কর্মরত ছিলেন। আর সেখান থেকে যশোর বিমানবন্দর হয়ে ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামলে ২২ লাখ ৯৯ হাজার টাকাসহ তিনি আটক হয়েছেন। তবে সূত্রমতে, মুকুল বেনাপোল কাস্টম হাউসে আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট থেকে ঘুষের এই টাকা নিয়ে ঢাকা আসছেন। প্রমাণ থাকার পরও এই কর্মকর্তার সঙ্গে থাকা টাকার উৎস অজানা হিসেবে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। চাকরিচ্যুতির মাধ্যমে তাকে বাঁচিয়ে দেয়া হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
আদেশে বলা হয়েছে, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা খন্দকার মুকুল হোসেন ২০২০ সালের ৫ নভেম্বর বেনাপোল কাস্টম হাউসে যোগ দেন। ২০২২ সালের ১৪ জুলাই তিনি বন্দরে ৩১ নম্বর শেডের ওয়েব্রিজ জিএল শাখায় কর্মরত ছিলেন। ২৬ জুলাই এই কর্মকর্তা যশোর বিমানবন্দর থেকে ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সে করে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। এভিয়েশন সিকিউরিটির কর্মকর্তারা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তার ব্যাগ তল্লাশি করে ২২ লাখ ৯৯ হাজার টাকা উদ্ধার করেন। পরে এভিয়েশন সিকিউরিটি কাস্টম হাউসকে একটি চিঠি দেয়। যাতে বলা হয়, জিজ্ঞাসাবাদে এই টাকার উৎস বিষয়ে সদুত্তর দিতে পারেননি মুকুল। বেনাপোল কাস্টম হাউস উপ কমিশনার তানভীর আহমেদ ও রাজস্ব কর্মকর্তা নঈম মীরনের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্তে দেখা গেছে, এভিয়েশন সিকিউরিটি মুকুল থেকে যে টাকা উদ্ধার করেছেন, তার সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দিতে পারেননি মুকুল। অর্থাৎ এই টাকা তিনি অন্য কোন উপায়ে উপার্জন করেছেন মর্মে এই সন্দেহের অবকাশ হয়। ২৬ জুলাই কর্মস্থল ত্যাগ করে ঢাকা যাওয়ার বিষয়ে মুকুল বেনাপোল কাস্টম হাউস থেকে কোনো লিখিত বা মৌখিক অনুমতি নেননি।
আরও বলা হয়, খন্দকার মুকুল হোসেন সরকারের দায়িত্বশীল কাজে নিয়োজিত থেকে এমন কার্যক্রম সরকারি কর্মচারি বিধিমালা অনুযায়ী ‘দুর্নীতি পরায়ন’ ও ‘অসদাচরণ’ হিসেবে গণ্য। ২০২৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর লিখিত জবাব দিতে মুকুলকে এনবিআর নোটিশ দেয়। মুকুল জবাব দেয় এবং ব্যক্তিগত শুনানিতে অংশ নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। ২ নভেম্বর তার শুনানি নেন এনবিআরের প্রথম সচিব (বোর্ড প্রশাসন) ও তদন্ত কর্মকর্তা গাউছুল আজম (উপসচিব)। পরে তদন্ত কর্মকর্তা একটি প্রতিবেদন দেয়। তদন্ত প্রতিবেদন ও সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রাপ্ত দলিলাদি বিশ্লেষণ করে এনবিআর। এতে দেখা যায়, জ্ঞাত আয় বর্হিভূত ২২ লাখ ৯৯ হাজার টাকা এই কর্মকর্তার ব্যাগে পাওয়া যায়। তিনি অনুমতি না নিয়েই কর্মস্থল ত্যাগ করেছেন বলে তদন্তে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় গুরুদণ্ড হিসেবে তাকে ‘বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান’ করা হলো।
অন্যদিকে, ব্যাগভর্তি ঘুষের ২২ লাখ ৯৯ হাজার টাকাসহ আটক খন্দকার মুকুল হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা করা করেছে দুদক। ২০২৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি দুদক যশোর সমন্বিত কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. আল আমিন বাদী হয়ে এ মামলা করেছেন। ঘুষের টাকাসহ আটক হওয়ার ৭ মাস পর মামলাটি দায়ের করা হয়। দায়েরকৃত মামলায় খন্দকার মুকুল হোসেনের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলার এজাহারে বলা হয়, খন্দকার মুকুল হোসেন ২০১০ সালে ঢাকায় এনবিআরের ক্যাশিয়ার পদে যোগ দেন। ২০১৭ সালের তিনি সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা পদে উত্তীর্ণ হন। ২০২০ সালের নভেম্বরে বেনাপোল কাস্টম হাউসে যোগ দেন। ঢাকায় চাকরির সুবাদে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। এ সুযোগে বেনাপোল কাস্টম হাউসে দুর্নীতি ও ঘুষের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে আসছেন।
সূত্রমতে, ২০২২ সালের ২৬ আগস্ট সকালে খন্দকার মুকুল হোসেন ঢাকার উদ্দেশে যশোর বিমানবন্দরে আসেন। এ সময় বন্দরের স্ক্যানার মেশিনে তার বহন করা ব্যাগে বিপুল পরিমাণ টাকার উপস্থিতি পাওয়া যায়। পরে বিষয়টি ঢাকা হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে যশোর বিমানবন্দর সিকিউরিটি বিভাগ। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের একটি বিমানে তিনি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিমানবন্দরে এভিয়েশন সিকিউরিটি সদস্যরা তাকে আটক করেন। তার ব্যাগ তল্লাশি করে ২২ লাখ ৯৯ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মুকুল ওই টাকার উৎস বলতে পারেনি।
সূত্র আরও জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ওই রাজস্ব কর্মকর্তা জব্দ করা টাকার কোনো উৎস জানাতে ব্যর্থ হন। সিকিউরিটির সদস্যরা তার আইডি কার্ড ও বোর্ডিং পাস কার্ড জব্দ করেন। পরে জব্দকৃত টাকার নম্বরের তালিকা এবং রাজস্ব কর্মকর্তার জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করে পরবর্তী আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণের জন্য অভিযোগ বেনাপোল কাস্টম হাউস কমিশনারের কাছে পাঠানো হয়। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২৭ আগস্ট বেনাপোল কাস্টম হাউস কমিশনার খন্দকার মুকুল হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করে। দুদকের অভিযানে অভিযুক্ত মুকুলকে জিজ্ঞাসাবাদে অব্যাখ্যায়িত ও অবৈধ অর্থ দখলে রেখে হস্তান্তর করার বিষয়টির প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়।