Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 11:05 am

ব্যাটারি খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে পান্না গ্রুপ

বাংলাদেশের ব্যাটারির মান বেশ উন্নত। এটি এখন শিল্প খাত হিসেবে বিস্তৃত হচ্ছে। অ্যাকিউমুলেটর অ্যান্ড ব্যাটারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএবিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, ছোট-বড় মিলিয়ে দেশে প্রায় ২০টি ব্যাটারি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সক্ষমতা রয়েছে দেশীয় ব্যাটারি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর। দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানির আশা করছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। শুনতে সহজ মনে হলেও অনেকটা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে আজকের এ অবস্থানে এসেছে খাতটি। এ অবস্থানে আসার পেছনে খাতসংশ্লিষ্ট মানুষ, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও গ্রুপের বেশ ভূমিকা রয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম পান্না গ্রুপ। দেশে ব্যাটারি খাতের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রটি তৈরির পেছনে পান্না গ্রুপের অবদান প্রথম সারিতে। বলা যায়, বাংলাদেশের ব্যাটারি খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে পান্না গ্রুপ।
পান্না গ্রুপের ব্যবস্থাপনা টিমের নেতৃত্বে রয়েছেন মো. লোকমান হোসেন। বাংলাদেশে ব্যাটারিশিল্পের পথিকৃৎদের একজন তিনি। মাত্র আট বছর বয়সে পুরান ঢাকার আল মদিনা ব্যাটারি কারখানায় সাপ্তাহিক ১০ টাকা বেতনে কাজ শুরু করেন তিনি। পারিশ্রমিকের সঙ্গে খাবারও পেতেন। কারখানাটি তেমন উন্নত ছিল না। সেখানে হাতে ব্যাটারি তৈরি করা হতো। কাজ শেখার পর মাসিক ১৫০ টাকা বেতন পেতেন। এভাবে চলতে থাকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত। ওই বছর উপার্জিত সাড়ে তিন হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ব্যাটারি কারখানায় কয়লা সরবরাহ শুরু করেন লোকমান হোসেন। এর মধ্য দিয়ে ব্যবসায় হাতেখড়ি তার। গড়ে তোলেন সিসা পুনঃপ্রক্রিয়াজাত ব্যাটারি কারখানা। ধীরে ধীরে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার কঠোর পরিশ্রম, সততা ও জবাবদিহির ফসল আজকের পান্না গ্রুপ। এ গ্রুপের প্রাণপুরুষ তিনিই। বর্তমানে তার গ্রুপে দেশি-বিদেশি প্রায় ১৫ হাজার কর্মী রয়েছেন। পান্না গ্রুপে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন জোনাকি বেগম।
সমাজ, গ্রাহক ও কর্মীদের জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে গ্রুপটি। নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত গ্রুপটির কর্মপরিবেশ। কারখানায় শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। তাদের জন্য কারখানায় সার্বক্ষণিক তিনজন চিকিৎসক রয়েছেন। শ্রমিকদের ক্যালরি নিশ্চিতে প্রতিদিন প্রত্যেক শ্রমিকের জন্য এক গ্লাস দুধ, একটি ডিম, ৫০ গ্রাম কাঁচা ছোলা, দুই পিস পাউরুটি ও একটি কলা বরাদ্দ রেখেছে কর্তৃপক্ষ। কর্মীদের জন্য প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের একটি অংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়। যে বছর যেমন লাভ হয়, সে বছর সে হারে কর্মীদের ‘প্রফিট বোনাস’ দেওয়া হয়। সম্পূর্ণরূপে শ্রম আইন অনুসরণ করে থাকে গ্রুপটি। চালু রয়েছে গোষ্ঠী বিমা। পান্না গ্রুপের সব কারখানা পরিবেশবান্ধব বলে সুবিদিত। পরিবেশের কথা মাথায় রেখে এখানে সার্বক্ষণিক ইটিপি চালু রাখা হয়। বায়ুদূষণ রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পানি বিশুদ্ধকরণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় এখানে।
কঠোর পরিশ্রম, উদ্ভাবনী শক্তি ও গুণগত মানের ওপর ভর করে টেকসই প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে বদ্ধপরিকর গ্রুপটি। তবে সবার ওপরে গ্রাহক সন্তুষ্টিকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে তারা। প্রতিষ্ঠার শুরু হতে উৎপাদনের সব পর্যায়সহ সরবরাহ সবখানে স্বচ্ছতা বজায় রাখা হয় এখানে। কাঁচামাল, উৎপাদন প্রভৃতির বেলায় সর্বোচ্চ মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সময়মতো পণ্য সরবরাহে বদ্ধপরিকর তারা। ব্যবসায় নীতি-নৈতিকতার কারণে অল্প সময়ের মধ্যে দেশের শীর্ষস্থানীয় গ্রুপে পরিণত হয় পান্না গ্রুপ।
বর্তমানে ব্যাটারি খাতে অন্যতম জনপ্রিয় ‘ভলভো’ ব্র্যান্ডের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তারা। এ ব্র্যান্ডের ব্যাটারি দীর্ঘস্থায়ী, সাশ্রয়ী ও অধিক কার্যক্ষমতাসম্পন্ন। গুণগত মানে সেরা ব্যাটারি বাজারজাতকরণের পাশাপাশি ব্যবহƒত ব্যাটারি রিসাইক্লিং করে অন্য প্রস্তুতকারকদের কাছে ব্যাটারির কাঁচামাল সিসা সরবরাহ করে তারা। একই সঙ্গে সৌরবিদ্যুৎ ও পাট খাতে পান্না গ্রুপের ব্যবসা রয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানের একটি অটোমেটিক ব্যাটারি কারখানা নির্মাণ করছে পান্না গ্রুপ। এখানে মাসে প্রায় দুই লাখ ব্যাটারি তৈরি হবে। এজন্য জার্মানি থেকে প্রধান যন্ত্রাংশগুলো আনা হয়েছে। কোরিয়া ও তাইওয়ান থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তিগত সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। এখানে প্রায় ১৬০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হবে। সাধারণ ব্যাটারি কারখানার তুলনায় এখানে শ্রমিক তুলনামূলক কম লাগবে। অনেক রোবট এখানে কাজ করবে। কারখানাটি থেকে উৎপাদিত পণ্য বিশ্বের প্রায় ৬২ দেশে রফতানি করা হবে।
দেশ-বিদেশের অনেক পুরস্কারে পূর্ণ পান্না গ্রুপের ঝুলি। এর মধ্যে জার্মানির বিআইডি অ্যাওয়ার্ড-২০১২ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

 
পান্না গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান পান্না ব্যাটারি লিমিটেড
মূল প্রতিষ্ঠান পান্না ব্যাটারির পথচলা শুরু ১৯৮০ সালে। পথচলার চার দশকে ‘ভলভো’সহ স্বনামখ্যাত ব্র্যান্ডের ব্যাটারি উৎপাদন ও বিপণনের মাধ্যমে দেশের বাজারে জনপ্রিয়তা পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। স্থানীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি এখন রফাতানিও করা হচ্ছে। সময়ের ব্যবধানে পান্না গ্রুপের মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠানটি।

পান্না ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড
এটি মূলত পান্না গ্রুপের নিজস্ব বিপণন চ্যানেল। এর মাধ্যমে দেশজুড়ে শক্তিশালী বিপণন নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। গ্রুপের উৎপাদিত পণ্য ব্যাটারি ও লুব্রিক্যান্টসসহ অন্যান্য পণ্য বাজারজাতে কাজ করছে পান্না ডিস্ট্রিবিউশন। বর্তমানে দেশজুড়ে শতাধিক ডিলার-পরিবেশক নিয়ে ব্যবসায়িক দিক দিয়ে প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে এগিয়ে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

লুব ইন লিমিটেড
ব্যাটারি ব্যবসায় সফলতার পরে ব্যবসায় ভিন্নতা আনতে ২০১৪ সালে সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে লুব ইন গড়ে তোলে পান্না গ্রুপ। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জার্মানির ‘ম্যানোল’ ব্র্যান্ডের লুব্রিক্যান্টস বাজারজাত করা হচ্ছে। দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি গুণগত মানসম্পন্ন লুব্রিক্যান্টস সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য এ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়েছে।

পিবিএল প্লাস্টিক ইউনিট
ব্যাটারি-আইপিএসসহ আনুষঙ্গিক পণ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় পিপি ও পিপিআইসিপি কন্টেইনারসহ প্লাটিক সামগ্রীর জোগান নিশ্চিত করতে কাজ করছে আরেক সহযোগী প্রতিষ্ঠান পিবিএল প্লাস্টিক ইউনিট। নিজেদের চাহিদা পূরণের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হলেও এখন অন্য ব্যাটারি প্রস্তুতকারী কোম্পানির কাছে প্লাস্টিক পণ্য বিক্রি করছে গ্রুপটি। বাজারের চাহিদা মাথায় রেখে পিবিএল প্লাস্টিক ইউনিটে প্রতি মাসে প্রায় ৫০ হাজার কন্টেইনার উৎপাদিত হচ্ছে।

আলতু খান জুট মিলস লিমিটেড 
ব্যাটারিই পান্না গ্রুপের মূল ব্যবসা। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার লোকমান হোসেনের জন্মস্থান ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলা। স্থানীয় অধিবাসীরা কর্মসংস্থানের জন্য তার কাছে আসা শুরু করে। কিন্তু প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা না থাকায় তিনি ব্যাটারি কারখানায় কাজের সুযোগ দিতে পারছিলেন না। সেই অপূর্ণতা থেকে নিজের জন্মভিটার পাশে গড়ে তোলেন আলতু খান জুট মিলস। এখানে প্রায় আড়াই হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক না হলেও কর্মরতদের স্বার্থেই প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রেখেছেন তিনি। একইসঙ্গে গ্রুপের প্রয়োজনীয় পাটজাত পণ্যের জোগান দিচ্ছে পাটকলটি।

পান্না রুরাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাশ্রয়ী মূল্যে সৌরবিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দিতে ২০১০ সালে পান্না রুরাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম শুরু করে পান্না গ্রুপ। প্রায় ৮০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দু’শতাধিক শাখার মাধ্যমে সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে কাজ করছে এ ফাউন্ডেশন।

পণ্য

ব্যাটারি
# জিএসএমএফ ২ ভোল্ট ব্যাটারিজ
# ভলভো এসএমএফ ব্যাটারিজ
#ভলভো ইভি ব্যাটারিজ
# ভলভো মোটরসাইকেল ব্যাটারিজ
# ভলভো আইপিএস ব্যাটারিজ
# ভলভো সোলার ব্যাটারিজ
# ভলভো অটোমোটিভ ব্যাটারিজ

পাটপণ্য
# পাটসুতা
# ব্যাগ

ব্যাটারি কনটেইনার
# অটোমেটিভ, সোলার ও আইপিএস ব্যাটারি
# ডিএম ওয়াটার
# পান্না আইপিএস
# সোলার সিস্টেম
# লিড অ্যান্টিমনি
# রেড অক্সাইড
# গ্রে অক্সাইড
# ম্যানল লুব্রিক্যান্টস