Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 1:28 pm

ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান থেকে আজকের ছাদবাগান

আ ন ম মাছুম বিল্লাহ ভূঞা: প্রকৃতিপ্রেম মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি! তাই অনেকের মধ্যেই বাগান করার বাসনা থাকে। তবে বাগান তৈরির দীর্ঘ ইতিহাস বিদ্যমান রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই এর প্রচলন শুরু হয়েছিল। প্রথম দিকে রাজাদের উদ্যোগে বাগান করা হলেও কালক্রমে তা ব্যক্তিপর্যায়ে স্থান পায়। তখন বাগান করা হতো খাদ্যের প্রয়োজনে। বিশেষ করে নিতান্তই খাদ্যের চাহিদা মেটাতে বসতির আশেপাশে শাকসবজি ও ফসলের চাষ শুরু করা হয়। খাদ্যের চাহিদা মেটানোর উদ্দেশ্যেই তারা বাগান করত। সেক্ষেত্রে অবশ্য কৃষকদের ভূমিকাই মুখ্য ছিল।

সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে মানুষের রুচিও পাল্টাতে থাকে। তখন খাদ্যের চাহিদা পূরণ করা ছাড়াও সৌন্দর্যবোধ থেকে বাগান করতে শুরু করে অনেকেই। বিশ্বে প্রথম ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান বা ঝুলন্ত উদ্যান বদলে দেয় বাগান তৈরির ইতিহাস! এটি ‘হ্যাংগিং গার্ডেন্স অব ব্যাবিলন’ নামে সুপরিচিত। শূন্য উদ্যান ইরাকের ইউফ্রেটিস নদীর তীরে খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দে নির্মিত হয়েছিল। সম্রাট নেবুচাদনেজার সম্রাজ্ঞীর প্রেরণায় এটি নির্মাণ করেন। ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগান বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের একটি সুখ্যাতি লাভ করে, যা আজকের দিনে ছাদবাগানের রূপ লাভ করে।

রাজধানী ঢাকায় ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রাও বেড়ে গেছে এবং এর সঙ্গে বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন সংকটও প্রকট আকার ধারণ করছে। উপরি-উক্ত সমস্যার কারণ ঢাকায় আগের তুলনায় বর্তমানে গাছের সংখ্যা নেই বললেই চলে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৫০ সালে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ছিল মাত্র চার লাখ ১৭ হাজার, যা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে এক কোটি ৮০ লাখের বেশি। ২০২২ সালে সম্ভাব্য জনসংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়ে যাবে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে গত ১৮ বছরে রাজধানীর ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা চার থেকে সাড়ে পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এ তথ্য প্রকাশ করা হয় বিএসএমআর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গবেষণা প্রতিবেদনে।

পরিবেশবিদদের মতে, ঢাকা শহর পরিণত হচ্ছে উত্তপ্ত ভূখণ্ডে এবং পরিবেশ হচ্ছে বিপন্ন। গাছপালা কেটে ফেলা, জলাশয় ভরাট এবং যানবাহন ও কংক্রিটের স্থাপনা হু-হু করে বেড়ে যাওয়াই এর অন্যতম প্রধান কারণ। ‘গ্লোবাল লিভ্যাবিলিটি ইনডেক্স’ অনুযায়ী, বিশ্বে বসবাসের অনুপযোগী শহরগুলোর তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে আছে আমাদের রাজধানী।

জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও উন্নয়ন এবং ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য রাখতে সেজন্য এ মহানগরীর বাসাবাড়ি, ফ্ল্যাট বা ভবনের ছাদে শুধু ফুলের বাগান নয়, শাক-সবজি ও ফলমূলের বাগান তৈরির কার্যক্রমকে বাধ্যতামূলক করার জন্য এরই মধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ঢাকা সিটি করপোরেশন ও রাজউক সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে। এটি নিঃসন্দেহে ঢাকাবাসীর জন্য আনন্দের সংবাদ। বাড়ির ছাদে বাগান বা গার্ডেনিং কর্মসূচির সফলতার জন্য এ মুহূর্তে রাজউক ও রিহ্যাবের ভূমিকাকে খাটো করে দেখা ঠিক হবে না, বরং তারা এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

বাসাবাড়িতে ছাদবাগান করলে ১০ শতাংশ হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফ করা হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। ২০২১ সালের ১৭ মার্চ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন আয়োজিত বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি ও মিস্ট ব্লোয়ারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।

শহরের পরিবেশ রক্ষা ও বিষমুক্ত খাদ্যের জোগানের জন্য ছাদে বাগান করার কার্যক্রমকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব নগরবাসীর। ছাদবাগানের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করা গেলে এতে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি কমবে। বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্ব না দিয়ে ছাদগুলোকে নিজ দেশের পরিবেশ উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করতে হবে এবং এক্ষেত্রে রাসায়নিক দ্রব্যমুক্ত শাকসবজি ও ফলের চাষাবাদ করাই শ্রেয়। এতে নিরাপদ খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করা ছাড়াও অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বাবলম্বী হওয়া সহজতর হবে। এছাড়া নগরীর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে ছাদবাগান কর্মসূচিকে উৎসাহী করা উচিত। এজন্য কাজ করতে পারে হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন।

এ অবস্থায় আগামী প্রজন্মের ও নগরবাসীর স্বার্থে শহরের প্রতিটি বাসাবাড়ি, ফ্ল্যাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এমনকি মসজিদ ও মাদরাসার ছাদে শাক-সবজি ও ফলের বাগানের সৃজন বাধ্যতামূলক করতে সরকারের দরকার একটি আইন পাস করা, যা বাস্তবায়নে হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে এবং গণমাধ্যমের সহায়তায় জনসচেতনামূলক কর্মসূচি সফল করা সম্ভব হবে। রাজধানীর ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা কমানোর জন্য এবং বিষমুক্ত খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করে যদি সামগ্রিকভাবে কাজ করা যায়, তাহলে জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা ও উন্নয়নের মাধ্যমে স্বাস্থ্যঝুঁকির সমস্যার কিছুটা হলেও সামাধান হবে বলে আশা করা যায়। এ মহৎ উদ্যোগকে সফল করার জন্য সিটি করপোরেশন, রাজউক, রিহ্যাব, গণপূর্ত অধিদপ্তর, এনজিও ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর এগিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরিও বটে।

masumbillahlaw06@gmail.com