ব্যায়ামের জন্যই শুধু নয়, যাতায়াতের জন্যও হাঁটুন

আ ন ম মাছুম বিল্লাহ ভূঞা: হাঁটা একটি জনপ্রিয় ও সর্বজনীন যাতায়াতমাধ্যম। মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যও হলো হাঁটা। আমরা কম-বেশি সবাই হাঁটতে পছন্দ করি। মানুষ হেঁটে চলাচল করে ছোটবেলা থেকে কেউ পায়ের ওপর ভর করে, কেউবা হামাগুড়ি দিয়ে। ছোট শিশুরা যখন হাঁটে তখন আমরা খুশি হই। এছাড়া হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী মানুষটি যখন হাঁটতে পারে, তখনও আমরা খুশি হয়ে থাকি। হাঁটা মানবজীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

হাঁটার অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর একটি। হাঁটা স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্যও উপকারী বটে। হাঁটতে গিয়ে আমরা যত্রতত্র ব্যক্তিগত গাড়ির পার্কিং, যান্ত্রিক যান ও ফুটপাত দখল প্রভৃতি কারণে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছি। তাই বর্তমানে নির্বিঘ্নে হাঁটার জন্য পার্কে যেতে হয়। নগরজীবনে যান্ত্রিক যানবাহনকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে মানুষের হাঁটার অধিকারকে খর্ব করা হচ্ছে। যেখানে বিলাসবহুল দ্রুতগতির গাড়ির দেশেও (লস এঞ্জেলেস) পথচারীকে প্রাধান্য (Pedestrians First Policy) দিয়ে গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা হয়, সেখানে আমাদের দেশে তার উল্টো চিত্র!

পথচারীকে প্রাধান্য দিয়ে যেসব শহর গড়া হয়েছে, বিশ্বের সেসব শহর টেকসই উন্নয়ন পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারে সরকারের উদারতা দৃশ্যমান রয়েছে; বিশেষ করে ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য স্বল্প সুদে ঋণ ও প্রকল্পে গাড়ি দেয়া হচ্ছে, যা যানজটকে অসহনীয় করছে। এই অপরিকল্পিত ও ভুল পরিকল্পনার কারণে রাজধানী ঢাকার তীব্র যানজট এখন অনেকটাই স্থায়ী রূপ নিয়েছে। এমন পরিস্থিতি বছরের পর বছর ধরে চললেও যানজট অবস্থার উন্নতির জন্য সরকারের পক্ষে যে ধরনের কার্যকর উদ্যোগ ও পরিকল্পনা থাকা দরকার, তাতেও ঘাটতি দৃশ্যমান বটে। তারপরও হাঁটার অধিকারের বিষয়ে কথা বললে অনেকে বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে না বলেই হয়তো হাসবেন।

এছাড়া বাংলাদেশে শহরের যাতায়াত পরিকল্পনায় যান্ত্রিক যানবাহনকে সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়ে ফুটপাত ভেঙে রাস্তা প্রশস্ত করা হচ্ছে। কিন্তু সেই রাস্তায় মানুষকে পায়ে হেঁটে চলাচলে গুরুত্ব না দেয়ার কারণেই হাঁটার বিষয়টি বাংলাদেশে তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। একদিকে নির্মাণ করা হচ্ছে ফ্লাইওভার ও ফুটওভার ব্রিজ, অপরদিকে হাঁটার উপযোগী প্রশস্ত ও প্রয়োজনীয় ফুটপাত এবং সড়ক না থাকায় মানুষ হাঁটার সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। আর এজন্য দায়ী অপ্রতুল ফুটপাত এবং রাস্তায় চলাচলের প্রতিক‚ল পরিবেশ। যে কোনো দূরত্বে যাতায়াত করতে যান্ত্রিক যানবাহনের ব্যবহার বেড়ে চলছে প্রতিনিয়ত। শহরে বাড়তি যানবাহনের জন্য তৈরি হচ্ছে যানজট, বাড়ছে জ্বালানিনির্ভরতা, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ এবং বৃদ্ধি পাচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনা।

আবার অনেক ক্ষেত্রেই কোন বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন, তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে না পারার ফলে অনেকেই ধারণা করে থাকেন রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলের অধিকতর গুরুত্ব পাচ্ছে। কিন্তু আসল বিষয়টি হচ্ছে রাস্তায় গাড়ির চেয়ে মানুষের যাতায়াতের অধিকার বেশি। সহজে ও স্বচ্ছন্দে অধিকাংশ মানুষের যাতায়াত সুবিধা নিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের প্রথম কাজ হওয়া উচিত নয় কি? যেহেতু যাতায়াতের ক্ষেত্রে হেঁটে চলাচল অধিকাংশ মানুষের প্রধান মাধ্যম, তাই প্রথমে হাঁটার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব। হাঁটার ফলে সামাজিক সম্পর্ক জোরদার হয়। কোনো রাস্তায় মানুষের চলাচল বেশি হলে সেখানে নিরাপত্তা বৃদ্ধির পাশাপাশি সামাজিক সম্পর্ক বৃদ্ধি ও আনন্দময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এছাড়া হাঁটাকেন্দ্রিক যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে তা রাজধানীর তীব্র যানজট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। যানজট নিরসনে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করে যাতায়াতে হাঁটাকে উৎসাহিত করা এবং ব্যক্তিগত গাড়িতে যারা চলাচল করেন, তারাও যেন হাঁটতে আগ্রহী হন, সেই যাতায়াত ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা দরকার।

সুস্থ থাকতে হলে মানুষকে হাঁটতে হবে। মানুষ যতক্ষণ হাঁটবে, ততক্ষণই সুস্থ থাকবে। সুস্থ থাকার জন্য হাঁটার বিকল্প নেই। একটি ইঞ্জিন যেমন ফেলে রাখলে অকেজো হয়ে যায়, তেমনি মানুষও যদি হাঁটাচলা না করে, সে মানুষ কিন্তু স্বাভাবিকভাবে জীবন-যাপন করতে পারে না। আমাদের যদি সুস্থ ও নীরোগ থাকতে হয়, তাহলে দুটো জিনিসকে গুরুত্ব দিতে হবে। তা হলো হাঁটা ও ব্যায়াম এবং এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর খাবার।

যারা শারীরিক পরিশ্রম করে না, তাদের জন্য হাঁটা একটি উত্তম ব্যায়াম। সুস্বাস্থ্যের জন্য নিয়মিত হাঁটা দরকারি। তাই ব্যায়ামের জন্যই শুধু নয়, যাতায়াতের জন্যও হাঁটা প্রয়োজন। হেঁটে যাতায়াত দূষণ কমাতে, জ্বালানি অপচয় রোধে এবং যানজট হ্রাসে ইতিবাচক অবদান রাখে। নিয়মিত হেঁটে যাতায়াত সামাজিকীকরণের জন্যও সহায়ক। এতে অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি প্রতিদিন হাঁটার মাধ্যমে আমরা সুস্থ থাকতে পারি। অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে প্রতিদিন অন্তত আধা ঘণ্টা নিয়মমাফিক হাঁটা উচিত।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, শতকরা ৬৭ ভাগ মানুষ মারা যায় অসংক্রামক রোগের কারণে। এই রোগের প্রধান ঝুঁকির অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে অপর্যাপ্ত কায়িক পরিশ্রম। সুতরাং অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত হাঁটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দৈনিক ৩০ মিনিট হাঁটা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। ওই তথ্যে বোঝা যায়, মানুষের সুস্থতার জন্য হাঁটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাঁটলে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করা লাগে না। কার্বনমুক্ত বিশ্ব গড়তে হাঁটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সুস্থ থাকতে হাঁটার গুরুত্ব তুলে ধরে এখন থেকে শুরু করতে হবে সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান। হাঁটার অভ্যাস নিয়মিত করার জন্য দরকার একটি সম্মিলিত উদ্যোগ।

তাই মানুষের সুস্থ জীবনের আশায় প্রতি বছরই ভিন্ন ভিন্ন স্লোগানে হাঁটা দিবস বেসরকারিভাবে পালন করে আসছে বাংলাদেশ ওয়াকিং ক্লাব। মানুষের মধ্যে হাঁটার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিগত ২০১৪ সাল থেকে ‘সুস্থ রাখতে দেহযন্ত্র, হাঁটাই হোক মূলমন্ত্র’ এই স্লোগানে বাংলাদেশে জাতীয় হাঁটা দিবস পালন করা হলেও ২০১৮ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলা প্রশাসন ‘হাঁটা দিবস’ পালন শুরু করে। ক্রমেই যানবাহনের ওপর নির্ভরশীলতা আমাদের হাঁটার সংস্কৃতি ও দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিবর্তন ঘটাচ্ছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ, অর্থনীতি ও যাতায়াত ব্যবস্থায়। তাই বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে হাঁটা দিবসের জন্য সরকারি স্বীকৃতি লাভের দাবিতে কাজ করছে অনেক বেসরকারি সংগঠন। আমরা আশা করি, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ উন্নয়নে এবং অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে হাঁটার অধিকার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

আইনজীবী

masumbillahlaw06@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০