ব্যাসেল-৩ পরিপালনে ইসলামি ব্যাংকিং

. মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা:

(পূর্ব প্রকাশের পর, তৃতীয় অংশ)

ব্যাসেল: ক্রেডিট ঝুঁকি ফোকাস

ব্যবসায়ের ইতিহাস বেশ পুরোনো। পুরোনো দিনের ব্যবসা যুগের পর যুগ অতিবাহিত হয়ে আজকের আধুনিক বিশ্বে পদার্পণ করেছে। এর মূলে রয়েছে ব্যাংকিং ব্যবসার উৎপত্তি। ব্যাংকিং কার্যক্রমের মাধ্যমে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মূল চাহিদা অর্থের জোগান দিয়ে থাকে আধুনিক ব্যাংকগুলো। ব্যাংকিং ব্যবসায়ে রয়েছে সফলতা এবং ব্যর্থতা ও ঝুঁকি সবই। তাই ব্যাংকগুলোকে প্রদেয় বিনিয়োগ বা ঋণের ঝুঁকি বহন করতে হয়। ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বিআরপিডি সার্কুলার নং-১৭, ২০০৩ সালের ৭ অক্টোবর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা গাইডলাইন প্রদান করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিভাগটি পুরোপুরি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। সে কারণেই ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রিতে খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি এবং ডিপোজিট বিনিয়োগ অনুপাত দিন দিন বাড়ছে। তাই বিনিয়োগ বা ঋণের টাকা সময়মতো পরিশোধ করার ব্যাপারে ইসলামে দিকনির্দেশনা রয়েছে। ঋণ গ্রহীতার দায়িত্ব ও কর্তব্য বিষয়ে ‘আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত জনৈক ব্যক্তি আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে তার পাওনা আদায়ের কড়া তাগাদা দিল। সাহাবায়ে কিরাম তাকে শায়েস্তা করতে উদ্যত হলেন। তিনি বলেন, তাকে ছেড়ে দাও। কেননা, পাওনাদারের কথা বলার অধিকার রয়েছে। তার জন্য একটি উট কিনে আন এবং তাকে দিয়ে দাও। তাঁরা বললেন, তার উটের চেয়ে বেশি বয়সের উট ছাড়া আমরা পাচ্ছি না। তিনি বলেন, সেটিই কিনে তাকে দিয়ে দাও। কারণ তোমাদের উত্তম লোক সেই, যে উত্তমরূপে ঋণ পরিশোধ করে। (বুখারি শরিফ হাদিস নং-২৩৯০)।’

ক্রেডিটঋণের ইতিকথা

ইংরেজিতে ‘ক্রেডিট’ অর্থাৎ ঋণ শব্দটি ১৫২০ সালে ব্যবহার হয়। এই শব্দটি মধ্যযুগীয় ফরাসি শব্দ ক্রেডিট (বিশ্বাস, আস্থা) ইতালীয় শব্দ ক্রেডিত, লাতিন শব্দ ক্রেডিয়াম ‘ঋণ, যা অন্যকে বিশ্বাস করে দেয়া’, ক্রেডিয়ারের ক্রিয়াবাচক পুরাঘটিত অতীত শব্দ ‘বিশ্বাস করা, আস্থা রাখা, নির্ভর করা’ থেকে উদ্ভূত। ঋণের ব্যবসায়িক অর্থ, যা শুরুতে ইংরেজিতে ব্যবহার হতো তাই বোঝায়, ক্রেডিটার শব্দটি ঋণদাতা অর্থে ব্যবহার ১৫শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে। ‘ঋণদান সংঘ’ এই ব্যুৎপন্ন শব্দটি মার্কিনিরা ইংরেজি শব্দ হিসেবে প্রথম ব্যবহার হয় ১৮৮১ সালে। আরেকটি শব্দ ‘ক্রেডিট রেটিং’ ব্যবহার হয় ১৯৫৮ সালে।

ঝুঁকি ধারণার ইতিকথা

বুর্জোয়া শব্দটি ফরাসি। যার অর্থ হলো দেয়াল ঘেরা শহর। তবে ব্যবহারিক অর্থে বুর্জোয়া বলতে তখনকার দিনের শহরে বসবাসকারী মানুষজনকেই বুঝানো হতো। বুর্জোয়া শব্দের প্রয়োগ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকে। যখন শহুরে মধ্যবিত্ত পেশাজীবী এবং উৎপাদক শ্রেণি তাদের অর্থনৈতিক পদমর্যাদার ওপর ভিত্তি করে রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে আগ্রহী হয়। এসব শহুরে পেশাজীবী এবং ব্যবসায়ী শ্রেণির আগ্রহেই ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয় বলেই কার্ল মার্কস এবং আরও অনেক চিন্তাবিদ এ বিপ্লবকে ‘বুর্জোয়া বিপ্লব’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। কার্ল মার্কসের ধারণা ছিল, দিনশেষে এই চূড়ান্ত বিপ্লবের মাধ্যমে বুর্জোয়া শ্রেণির সম্পদ বাজেয়াপ্ত হবে এবং শোষণ, শ্রেণি সংগ্রাম ও রাষ্ট্রের বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে সূচনা ঘটবে সাম্যবাদের। বুর্জোয়ারা তখন তাদের সামাজিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক অধিকারের দাবিতে ফরাসি বিপ্লব এবং শিল্প বিপ্লবে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল। তখন বুর্জোয়া অর্থনৈতিক কাঠামোর উত্থানের সময়কালে প্রকৃতি এবং ঝুঁকির সারাংশ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত গবেষণা শুরু হয়েছিল। বাণিজ্যিক-ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সভ্যতা এবং শিল্প সম্পর্কের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক চিন্তার মহান মন ক্রমবর্ধমান মুনাফা এবং ঝুঁকির মধ্যে সম্পর্কের দিকে মনোযোগ দেয়। প্রথমবারের মতো, অ্যাডাম স্মিথ তার লেখায় এই সম্পর্কে লিখেছিলেন। আমেরিকান অর্থনীতিবিদ পল এল. হেইন, পিটার জে বোয়েটকে এবং ডেভিড এল প্রিচিটকো তাদের রচিত ‘দ্য ইকোনমিক ওয়ে অব থিংকিং’ বইতে উল্লেখ করেছেন যে কোম্পানিগুলোর মুনাফার উত্থানের শর্ত হলো অনিশ্চয়তা এবং সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি। ঝুঁকি অধ্যয়ন এবং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ক্ষেত্রের উত্থান এবং সক্রিয় বিকাশ বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত বিপ্লবের যুগে ২০ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে শুরু হয়। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের চিহ্নিত হুমকির অবস্থাকে আরও বিস্তৃতভাবে আর্থিক ফলাফলের সম্ভাবনা, প্রত্যাশিত ইভেন্ট সিরিজের বিচ্যুতি এবং নেতিবাচক পরিণতির ঘটনার সম্ভাব্য মূল্যায়নের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার অনুমতি দেয়। যাই হোক না কেন, এটা মনে রাখতে হবে যে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়া কোনো ঝুঁকি নেই এবং তার গ্রহণের বিষয় ছাড়া ঝুঁকির কোনো বস্তু নেই।

ঝুঁকির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

ঝুঁকি হলো অনিশ্চয়তার যে অংশটুকু পরিমাপ করা যায়; প্রত্যাশিত আয়ের পরিবর্তনশীলতা; খারাপ কোনো ঘটনা ঘটার আশঙ্কা এবং প্রত্যাশা হতে বিচ্যুতির যে সম্ভাবনা তা মূলত ঝুঁকি। অনিশ্চয়তা হতে ক্ষতি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাকে ঝুঁকি বলে। ঝুঁকি হলো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বা কোনো সম্পদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ভবিষ্যৎ আয়ের তারতম্য। ঝুঁকির আরেকটি ধারণা হলো, উত্থান-পতন। আয়ের উত্থান-পতন যত বেশি হবে, ঝুঁকিও তত বেশি হবে। সব অনিশ্চয়তাই ঝুঁকি নয়। ঝুঁকির কারণে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কাক্সিক্ষত ফলাফল না পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। আদর্শ বিচ্যুতি বা পরিমিত ব্যবধান, পরিসর ও বিভেদাঙ্ক এসব পদ্ধতির মাধ্যমে ঝুঁকি পরিমাপ করা যায়। ঝুঁকি ও আয়ের মধ্যে ধনাত্মক সম্পর্ক বিদ্যমান। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান সফলভাবে পরিচালনার জন্য ঝুঁকি পরিমাপ করা অত্যাবশ্যক। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের সঙ্গে ঝুঁকির তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি হলো ঝুঁকির উৎস খুঁজে বের করা ও শ্রেণি বিন্যাস করা। উদাহরণ স্বরূপ ওয়ান ব্যাংক আল-নূর ইসলামি ব্যাংকিংয়ের ২০২০ সালে ৩১ ডিসেম্বরে ২০ শতাংশ নিট মুনাফার টার্গেট ছিল কিন্তু বছর শেষে দেখা গেল প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত মুনাফা হয়েছে ১৫ শতাংশ। এখানে ৫ শতাংশ বিচ্যুতিকে ঝুঁকির উৎস বলে। কিন্তু যদি প্রত্যাশার বেশি লাভ হতো (৩০ শতাংশ) তাহলেও ঝুঁকির উৎস বলে বিবেচিত হতো, কারণ অধিক আয়ের কারণ অজানা ছিল। সুতরাং ঝুঁকি পরিমাপ করা যায় বলে তা কমানো বা হ্রাস করা যায়। সুতরাং আর্থিকমূল্যে পরিমাপযোগ্য ক্ষতিই হচ্ছে ঝুঁকি।

ক্রেডিট ঝুঁকি

সাধারণত ঋণ প্রদান কার্যক্রমের মাধ্যমে ঋণ ঝুঁকির উদ্ভব হয়। এই ঝুঁকি ব্যাংকের অন ব্যালান্স শিট আইটেম ও অফ ব্যালান্স শিট আইটেম থেকে সৃষ্টি হয়। ব্যাংকের সঙ্গে ঋণ গ্রহীতার পূর্বনির্ধারিত চুক্তি পালনে অক্ষমতা বা অনিচ্ছা থেকে এই ঝুঁকির উদ্ভব ঘটে। ঋণগ্রহীতা কর্তৃক শর্ত মোতাবেক সকল দায় (সুদ, আসল ও অন্যান্য চার্জ) পরিশোধের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য অনিশ্চয়তাকে বোঝায়। বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ-সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি হলো হ্রাসযোগ্য, পরিমাপ যোগ্য ও পরিহার যোগ্য। কোনো বিনিয়োগের প্রকৃত আয় থেকে প্রত্যাশিত আয়ের পার্থক্যকেই বিনিয়োগ ঝুঁকি বলা হয়। অর্থাৎ কোনো বিনিয়োগ থেকে ভবিষ্যৎ রিটার্নের পরিবর্তনশীলতাকে ঝুঁকি বলে। সুতরাং কোনো বিনিয়োগের আয় যত অনিশ্চিত হবে তার পরিবর্তনশীলতা তত বেশি হবে এবং ঝুঁকিও তত বেশি হবে আর আয় যত নিশ্চিত হবে তার পরিবর্তনশীলতা তত কম হবে এবং ঝুঁকিও কম হবে।

একটি আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত ক্রেডিট ঝুঁকি বা ক্রেডিট ডিফল্ট ঝুঁকি কেবল সেই লেনদেনের প্রত্যাশিত ক্ষতি। এটি সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে – ক্রেডিট রিস্ক = ডিফল্ট সম্ভাব্যতা ী এক্সপোজার ী ক্ষতির হার।

ডিফল্ট সম্ভাব্যতা হলো একজস দেনাদার তার ঋণ পরিশোধে প্রত্যাহার করার সম্ভাবনা। এক্সপোজার হলো ঋণদাতাকে যে পরিমাণ অর্থ প্রদান করার কথা। বেশিরভাগে ক্ষেত্রেই এটি কেবল ঋণগ্রহীতার দ্বারা ধার করা এবং সুদের অর্থপ্রদানের পরিমাণ। ‘ক্ষতির হার = ১ – পুনরুদ্ধার হার’ যেখানে পুনরুদ্ধার হার হলো মোট পরিমাণের অনুপাত, যা যদি দেনাদার খেলাপি হয়ে যায়। ক্রেডিট ঝুঁকি বিশ্লেষকরা ক্রেডিট ঝুঁকির প্রতিটি নির্ধারক বিশ্লেষণ করে এবং একটি প্রতিষ্ঠানের মুখোমুখি হওয়া সামগ্রিক কমানোর চেষ্টা করে।

ক্রেডিট ঝুঁকি সৃষ্টির সম্ভাব্য কারণ 

ক্রেডিট ঝুঁকি সাধারণত ঋণগ্রহীতা কর্তৃক ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে বা ঋণ পরিশোধে অসমর্থ হলে উদ্ভব হয়, যা প্রতিষ্ঠানের মুনাফা অর্জন ও মূলধনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। একটি ঋণের একাধিক অস্তিত্ব দেখা দিলে বা একটি ঋণ যখন প্রয়োজন ব্যতীত বর্ধিত করা হয় তখন এই ঝুঁকির সৃষ্টি হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ (করোনাভাইরাস, টর্নেডো, সিডর, আইলা, ভূমিকম্প, খরা, বন্যা, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সৃষ্টি হয়)। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা/অস্থিতিশীলতা, দেশের অর্থনৈতিক মন্দা, মূল্যস্ফীতি ইত্যাদিও ঋণ ঝুঁকি সৃষ্টির অন্যতম কারণ। ঋণের প্রাক্কলন প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম-বেশি হলে ঋণের ঝুঁকির সৃষ্টি হয়। উপযুক্ত সময়ে ঋণ বিতরণ করা না হলে ঝুঁকি বেড়ে যায়। রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে ঋণ প্রদান করলে ঝুঁকির উদ্ভব হয়। অসৎ কর্মকর্তারা কর্তৃক নিয়মবহির্ভূতভাবে ঋণ প্রদানের ফলে ঝুঁকির সৃষ্টি হয়। উপযুক্ত তদারকির অভাবে ঋণ ঝুঁকির উদ্ভব হয়। এছাড়া ব্যবসায়িক কার্যক্রমে যে কোনো ধরনের ক্রুটির কারণে ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে। (চলবে)

অফিসার

ইসলামি ব্যাংকিং ডিভিশন

ওয়ান ব্যাংক লিমিটেড

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০