ড. মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা
(গত সংখ্যার পর, ষষ্ঠ অংশ)
বাংলাদেশের আর্থিক খাতের প্রধান উপাদান হলো ব্যাংক খাত, যা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে অপরিহার্য। বিশেষ করে ২০০৮-২০১২ সালের বিশ্বমন্দা-পরবর্তী সময়ে ব্যাংক খাতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বমন্দা মোকাবিলায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যাংক প্রধান হাতিয়ার এবং আর্থসামাজিক ও অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং বিকাশের ক্ষেত্রে এক মুখ্য ভূমিকা পালন করে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে সময়ের বিবর্তনে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত গভীর সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কারণ ব্যাংকের সংখ্যা বাংলাদেশের আর্থিক কাঠামোর তুলনায় বেড়েছে, অসুস্থ প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং নতুন নতুন ব্যাংকিং পণ্য ও সেবার পরিধি বাড়ছে। ফলে সম্ভাবনার পাশাপাশি সৃষ্টি হচ্ছে অসংখ্য নতুন নতুন ঝুঁকির উৎস। কার্যকর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা অর্জন এবং দক্ষতা বৃদ্ধি সময়ের দাবি। ঝুঁকি নির্মূল পন্থা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার একটি মৌলিক উপাদান। ঝুঁকি হ্রাসের ক্ষেত্রে প্রচলিত ব্যাংকগুলোর তুলনায় ইসলামি ব্যাংকগুলো সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। কারণ যেসব বিনিয়োগ গ্রাহক দেউলিয়া হওয়ার কারণে বিনিয়োগ পরিশোধ করতে পারেন না, সেসব বিনিয়োগ গ্রাহকের পাওনা ইসলামি ব্যাংকগুলো অনেক সময় জাকাত/সিএসআর খাত থেকে পরিশোধ করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু প্রচলিত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে সেই সুযোগ নেই; কারণ প্রচলিত ব্যাংকগুলো জাকাত তহবিল গঠনের আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘তোমাদের ঋণগ্রহীতা অভাবী হলে সচ্ছলতা লাভ করা পর্যন্ত তাকে অবকাশ দাও। আর যদি দান করে দাও, তাহলে এটা তোমাদের জন্য বেশি কল্যাণকর হবে, যদি তোমরা অনুধাবন কর’ (সুরা বাকারা-২৮০)। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন যে, ‘তাঁর পিতা উহুদের যুদ্ধে শহিদ হন এবং তাঁর ওপর কিছু ঋণ ছিল। পাওনাদাররা তাদের পাওনা সম্পর্কে কড়াকড়ি শুরু করে দিল। আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমীপে এলাম। তিনি তাদের আমার বাগানের ফল নিয়ে নিতে এবং আমার পিতার অবশিষ্ট ঋণ মাফ করে দিতে বললেন। আর তিনি (আমাকে) বলেন, আমরা সকালে তোমার কাছে আসব। তিনি সকাল বেলায় আমাদের কাছে এলেন এবং বাগানের চারদিকে ঘুরে বরকতের জন্য দুয়া করলেন। আমি ফল পেড়ে তাদের সব ঋণ আদায় করে দিলাম এবং আমার নিকট কিছু অতিরিক্ত খেজুর অবশিষ্ট রয়ে গেল’ (বুখারি শরিফ-২৩৯৫)। বাংলাদেশ ব্যাংকঋণ বা বিনিয়োগ ঝুঁকির পরিমাণ হ্রাস বা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নিরাপত্তাজনিত কারণে যে ঝুঁকির উদ্ভব হয় তাকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। সেগুলো হলো সিকিউরিটি কভারেজ, জামানত কভারেজ এবং সমর্থন।
(৪) নিরাপত্তা ঝুঁকি (১০ শতাংশ): ব্যাংক আমানতকৃত অর্থ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন করে থাকে। মুনাফার সঙ্গে ঝুঁকির বিষয়টি জড়িত। মুনাফার পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হলে ঝুঁকির পরিমাণ হ্রাস করতে হবে। ব্যাংক যে প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করবে সে প্রতিষ্ঠানের ঋণ বা বিনিয়োগের অর্থ পরিশোধ করার অতীত রেকর্ড যাচাই করা ঝুঁকি হ্রাসের একটি অন্যতম পদ্ধতি। এছাড়া বিনিয়োগের অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে গ্রাহকের কাছ থেকে ব্যাংক উপযুক্ত জামানত গ্রহণ করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক নিরাপত্তার ঝুঁকি মোকাবিলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তিনটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন তা হলো সিকিউরিটি কভারেজ; কুলাটারাল কভারেজ এবং সমর্থন।
(৪.১) সিকিউরিটি কভারেজ (৪ শতাংশ): সিকিউরিটি কভারেজ হলো, প্রত্যাশিত বিনিয়োগের তুলনায় জামানতের অনুপাত। বিনিয়োগের পরিমাণের চেয়ে জামানতের পরিমাণ যত বেশি হবে বিনিয়োগ তত নিরাপদ হবে। জামানতের গুণগত মানের ওপর বিনিয়োগ থেকে সৃষ্ট ঝুঁকির পরিমাণ নির্ভর করে। সে লক্ষ্যে জামানতের পরিমাণের সঙ্গে সঙ্গে গুণগত দিকটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। প্রত্যাশিত বিনিয়োগের বিপরীতে জামানতের প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করা হয়। প্রাথমিক জামানত যদি সম্পূর্ণ পণ্য বন্ধকি হয় বা বিনিয়োগের বৃহদাংশ কোনা নগদ সম্পদ (স্থায়ী আমানত/বন্ড ইত্যাদি) বা নিবন্ধিত বন্ধক হয়, যদি নিবন্ধিত বন্ধক হয়, তবে স্কোর হবে ৪, রেজিস্টার্ড হাইপোথিকেশনের ক্ষেত্রে ১ম চার্জ হলে স্কোর হবে ৩, দ্বিতীয় চার্জ হলে ২, সাধারণ হাইপোথিকেশন হলে স্কোর হবে ১ এবং কোনো জামানত না থাকলে স্কোর হবে শূন্য। প্রতিটি ব্যাংক বিনিয়োগ ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য সিকিউরিটি কভারেজের বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে বিনিয়োগ প্রদান করে থাকে।
(৪.২) জামানত (Collateral) কভারেজ (৪ শতাংশ):
জামানত কভারেজ হলো জামানতকৃত সম্পত্তির অবস্থানের মূল্যায়ন করে গ্রেডিং করা। সিটি করপোরেশন, জেলা এবং গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকার ক্ষেত্রে এবং জামানতকৃত সম্পত্তির সঙ্গে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সহজেই বিক্রয় যোগ্য তাহলে নিবন্ধিত বন্ধকের (Registered Mortgage) ক্ষেত্রে স্কোর হবে ৪, পৌরসভা/উপজেলা/উপশহর বা তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকা হলে সেক্ষেত্রে স্কোর হবে ৩, কোনো জমি বা Equitable Mortgage না হয়ে যদি Plant and Machinery হয় তবে সে ক্ষেত্রে স্কোর হবে ২। জামানতবিহীন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্কোর হবে শূন্য।
(৪.৩) সমর্থন (Support) (২ শতাংশ ): অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের জামানত দিয়ে বিনিয়োগ গ্রহণ করার মতো উপযুক্ত জামানত নেই। কিন্তু মার্কেটের তাদের বেশ সুনাম রয়েছে। নীতি নৈতিকতার ভিত্তিতে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে গ্রহকের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের ব্যবসায়িক পরিধি বৃদ্ধির জন্য ঋণ বা বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়ে। সেক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য ব্যক্তিগত বা করপোরেট গ্যারান্টি নিয়ে বিনিয়োগ প্রদান করে থাকে। উচ্চ নিট সম্পদ (High Net Worth)যুক্ত ব্যক্তিগত অথবা করপোরেট গ্যারান্টির ক্ষেত্রে স্কোর হবে-২, মোটামুটি নিট সম্পদযুক্ত গ্যারান্টির ক্ষেত্রে স্কোর হবে-১, কোনো গ্যারান্টি না থাকলে স্কোর শূন্য হবে।
(৫) পারস্পরিক সম্পর্ক ঝুঁকি (১০ শতাংশ): বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশ, কাঠামো ও অন্যান্য দিক বিবেচনায় নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার সময় যে সকল ঝুঁকির উৎপত্তি হয় তার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ঝুঁকি অন্যতম। বাংলাদেশ ব্যাংক পারস্পরিক সম্পর্ক ঝুঁকিকে চারটি উপাদানে ভাগ করেছে। সেগুলো হলো হিসাব পরিচালনা; ইউটিলাইজেশন অব লিমিট; চুক্তি বা শর্ত মেনে চলা এবং ব্যক্তিগত আমানত।
(৫.১) হিসাব পরিচালনা (৫ শতাংশ): ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই বিভিন্ন ধরনের ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করে থাকে। ব্যাংক হিসেবে লেনদেনের পরিমাণ দেখে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক কাঠামো কেমন তা যাচাই করা যায়; যার ফলে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ গ্রাহকের অতীতে গৃহীত বিনিয়োগের Performance, আর্থিক লেনদেন এবং তৎসংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় মূল্যায়ন করা হয়। কোনো ঋণ/বিনিয়োগ হিসাবের পূর্বের ৩ বছর খেলাপি ব্যতীত সস্তোষজনক লেনদেন থাকলে স্কোর হবে ৫; খেলাপি ব্যতীত সন্তোষজনক লেনদেন ৩ বছরের কম সময় হলে স্কোর হবে ৪, নির্ধারিত বিনিয়োগের যৌক্তিক কারণে অনির্ধারিত/বিলম্বিত সময়ে পরিশোধের মাধ্যমে হিসাব নিয়মিত থাকলে স্কোর হবে ২ এবং মেয়াদোত্তীর্ণ থাকলে বা হিসাব অনিয়মিত থাকলে স্কোর হবে শূন্য।
(৫.২) ইউটিলাইজেশন অব লিমিট (২ শতাংশ): ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলো তার ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিনিয়োগকৃত মূলধন ব্যবহারে বিনিয়োগ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের কোনো সীমাবদ্ধতা আছে কিনা, তা যাচাই করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অনাকাক্সিক্ষত যে কোনো ঘটনার কারণে ব্যবসায়িক স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এছাড়া ব্যবসায়ের প্রকৃতি, ব্যবস্থাপনার দক্ষতা এবং অন্যান্য উপাদানের তারতম্যের কারণে অনেক সময় মঞ্জুরিকৃত বিনিয়োগ সীমার সম্পূর্ণ অংশ ব্যবসায়ে বিনিয়োগে করা প্রয়োজন নাও হতে পারে। সেই অনিশ্চয়তা থেকে প্রতিষ্ঠানে ঝুঁকির উৎপত্তি হয়। বিনিয়োগের লিমিট ব্যবহারের ওপর ঝুঁকির মাত্রা নির্ণয় করা হয়; কারণ বিনিয়োগ বেশি হলে লাভ বেশি। মঞ্জুরিকৃত বিনিয়োগ সীমার ৬০ শতাংশের বেশি ব্যবহৃত হলে স্কোর হবে ২; ৪০%-৬০% হলে স্কোর হবে ১ এবং ৪০ শতাংশের কম হলে স্কোর হবে শূন্য। সম্পূর্ণ নতুন প্রস্তাবের ক্ষেত্রে স্কোর ধরা হয় ২।
(৫.৩) চুক্তি বা শর্ত মেনে চলা (২ শতাংশ): ব্যাংক বিনিয়োগ প্রদানের সময় বিনিয়োগ গ্রাহকের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়ে থাকে। বিনিয়োগ গ্রাহক কর্তৃক সেই অঙ্গীকার বা শর্তাবলি কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে তার ওপর প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি নির্ভর করে। ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য বিনিয়োগ গ্রাহককে মঞ্জুরিপত্রে দলিলায়নসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট শর্তাদি পূরণ করার জন্য বলা হয়। অনেক বিনিয়োগ গ্রাহক এ সকল শর্তাদি পুরোপুরি পালন করতে পারেন। শর্তাদি পূরণের যোগ্যতার ওপর ভিত্তি করে ঝুঁকির মান নির্ণয় করা হয়। ব্যাংক কর্তৃক উল্লিখিত শর্তাদি পরিপূর্ণভাবে পরিপালনের ক্ষেত্রে স্কোর হবে ২ এবং আংশিক পরিপালনের ক্ষেত্রে স্কোর হবে ১।
(৫.৪) ব্যক্তিগত আমানত (১ শতাংশ): মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই সঞ্চয়ী মনোভাবাপন্ন। ভবিষ্যতের অপ্রত্যাশিত প্রয়োজন পূরণের জন্য ব্যাংক বা বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সঞ্চয় করে থাকে। ব্যবসায়ীরা তাদের আয়ের একটি অংশ সঞ্চয়ের ফলে কারবারের অপ্রত্যাশিত ঝুঁকি হ্রাস করার চেষ্টা করে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাংক বিনিয়োগ প্রদানের পূর্বে বিনিয়োগ প্রার্থী/প্রতিষ্ঠান/কোম্পানির পরিচালকদের ব্যক্তি আমানত হিসাব সম্পর্কিত বিষয়টি বিবেচনায় নেয়। ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ঝুঁকি হ্রাসের উপাদান হিসেবে ব্যক্তিগত আমানত থাকলে স্কোর ধরা হয় ১ এবং ব্যক্তিগত আমানত না থাকলে স্কোর ধরা হয় শূন্য।
ব্যাসেল-১-এর প্রধান আলোচ্য বিষয় হলো ক্রেডিট ঝুঁকি। বাংলাদেশের ব্যাংকিং শিল্পে ২০০৯ সাল থেকে ব্যাসেল পরিপালন হয়ে আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৫ সালের নভেম্বর মাসে Credi t Risk G rading Manual জারি করে ক্রেডিট ঝুঁকিকে পাঁচটি প্রধান উপাদানের অধীনে ২৫টি উপ-উপাদানে শ্রেণিভুক্ত করে। ঝুঁকিগুলোর মোট বিরময ঃ ধরা হয়েছে ১০০। সেই হিসাবে যে প্রতিষ্ঠানের বিরময ঃ যত বেশি সে প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি তত কম। (চলবে)
অফিসার
ইসলামি ব্যাংকিং ডিভিশন
ওয়ান ব্যাংক লিমিটেড