Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 12:20 pm

ব্রয়লার মুরগির মাংসে সহনীয় মাত্রার আড়াইগুণ লেড!

নজরুল ইসলাম: দেশে ব্রয়লার মুরগির মাংসে ক্ষতিকর লেডের (সিসা) উপস্থিতি পাওয়া গেছে আন্তর্জাতিক সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার আড়াইগুণ। কিন্তু, তথ্যটি ধামাচাপা দিতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার (এমআরএল) পরিমাণ বাড়িয়ে দেখিয়েছে অনেক বেশি। আর সে গবেষণার ভিত্তিতে সম্প্রতি ব্রয়লার মুরগির মাংসকে নিরাপদ বলে ঘোষণাও দেয়া হয়েছে।

বিএআরসির গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ব্রয়লার মুরগির মাংসে লেডের উপস্থিতি ২৫৯ দশমিক ১ পিপিবি (পার্টস পার বিলিয়ন), আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের চেয়ে অনেক বেশি। কোডেক্স, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের হিসেবে ব্রয়লার মুরগির মাংসে লেডের সহনীয় মানমাত্রা ১০০ পিপিবি। তবে বিএআরসি সর্বোচ্চ সহনশীল মাত্রা দেখিয়েছে ৬০০০ পিপিবি। যদিও এই মানমাত্রার নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্র বা রেফারেন্স তারা দেখাতে পারেননি। কোনো দেশের ফুড কোড অনুসারে সর্বোচ্চ সহনশীল মাত্রা ৬০০০ পিপিবি দেখানো হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্ট গবেষকও শেয়ার বিজের কাছে তার তথ্যপ্রমাণ দিতে পারেননি।

গত ১২ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। সচিবালয়ের তথ্য অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে গবেষণা প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। সে সময় বলা হয়, ব্রয়লার মুরগির মাংসে লেডের উপস্থিতি ২৫৯ দশমিক ১ পিপিবি পাওয়া গেছে সাভারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাবরেটরিতে।

নিরাপদ খাদ্য নিয়ে কাজ করা একজন বিশেষজ্ঞ নাম প্রকাশ না করে শেয়ার বিজকে বলেন, ‘মুরগি ও ডিম হচ্ছে প্রোটিনের বড় উৎস। আমাদের শিশুরা ব্রয়লার মুরগি ছাড়া খেতেই চায় না। সেই হিসেবে এই প্রতিবেদন আমাদের জন্য আশঙ্কাজনক। খাদ্য শৃঙ্খলের কোন পর্যায়ে রাসায়নিক দূষণ প্রবেশ করছে, সেটি জরুরি ভিত্তিতে চিহ্নিত করে সম্পূর্ণভাবে খাদ্য দষণ দূর করার জন্য ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। এখানে খাদ্য ভেজালের তথ্য গোপন বা ধামাচাপা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। শিল্প ধ্বংস হবে বলে আমরা যদি ভেজালের তথ্য গোপন করি, তা দূর করার ব্যবস্থা গ্রহণ না করি, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজš§কে একটি বিকলাঙ্গ বা অসুস্থ জাতি হিসেবে পরিণত করব। আন্তর্জাতিক মানমাত্রা মানতে আমরা বাধ্য। কিন্তু, বিএআরসির এ প্রতিবেদন জাতিকে বিভ্রান্ত করবে।’

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের (নিখাক) নিরাপদ খাদ্য (রাসায়নিক দূষক, টক্সিন ও ক্ষতিকর অবশিষ্টাংশ) প্রবিধানমালা, ২০১৭ অনুযায়ী কোডেক্স ফুড কোড অনুসারে হাঁস-মুরগির মাংসে ভারী ধাতু বা লেডের (সিসা) সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা পার্টস পার মিলিয়ন (পিপিএম) ০.১০; যা পিপিবির হিসেবে ১০০।

গবেষণাটি করেছেন বিএআরসির প্রাণিসম্পদ বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও পুষ্টি ইউনিটের পরিচালক (অতি. দায়িত্ব) ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। তিনি শেয়ার বিজকে জানান, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে একটি প্রকল্পের অধীনে এটি পরিচালিত হয়। ‘কোয়ালিটি অ্যান্ড কোয়ান্টিটি স্টাডি অব এন্টিবায়োটিক অ্যান্ড হেভি মেটাল রেসিডিউ ইন ব্রয়লার’ নামের প্রকল্পটির মোট বাজেট ছিল ৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা। তার সঙ্গে একটি টেকনিক্যাল টিমও ছিল। তিনিই মূল গবেষক।

কোনো দেশের ফুড কোড অনুসারে সর্বোচ্চ সহনশীল মাত্রা ৬০০০ পিপিবি দেখানো হয়েছে জানতে চাইলে তিনি শেয়ার বিজেকে বলেন, ‘এটা চীনকে অনুসরণ করে করা হয়েছে।’ চীনের কোনো গবেষক এটি তার গবেষণায় দেখিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চই ইয়া ইন নামের একজন গবেষক ২০১২ সালে তার গবেষণায় এটি দেখিয়েছেন।’

গবেষণাটির পেপারস কিংবা ওয়েব লিংক চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এশিয়ান-অস্ট্রালেশিয়ান জার্নাল অব ফুড সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটিতে ‘ডিটেকশন অব হেভি মেটালস ইন ফিড, মিট অ্যান্ড এগ’ শিরোনামে ২০১৮ সালে একটি আর্টিকেল প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) পোলট্রি উৎপাদন গবেষণা বিভাগের এম এ রশিদ, এম এস কে সরকার, এইচ খাতুন, প্রাণী উৎপাদন গবেষণা বিভাগের এন আর সরকার, পোলট্রি উৎপাদন গবেষণা বিভাগের মো. ইউছুফ আলী ও বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) এম এন ইসলাম এই আর্টিকেলটি তৈরি করেন। এটির করেসপন্ডিং অথর ছিলেন এম এ রশিদ। সেই গবষেণাটিতে চই ইয়া ইনের গবেষণার তথ্যটি এসেছে। সেখান থেকে তিনি নিয়েছেন।’’ তার কথা অনুযায়ী গবেষণা প্রতিবেদনটি ঘেঁটে সেটিতে চই ইয়া ইনের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি। এছাড়া রেফারেন্সেও তার নাম পাওয়া যায়নি।

এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গতকাল ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমার ছাত্রের কাছে পেপারসগুলো রয়েছে। এটি একটি সায়েন্টিফিক জার্নালে প্রকাশ হয়েছে। অনেক সময় তারা সেটি ইংলিশে ভার্সনে প্রকাশ করে না। তাই ওয়েব লিংক পাচ্ছি না।’

‘ডিটেকশন অব হেভি মেটালস ইন ফিড, মিট অ্যান্ড এগ’ শিরোনামের আর্টিকেলটির করসপন্ডিং অথর মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ বলেন, ‘আমরা কিছু স্যাম্পল কালেকশন করেছিলাম। রেফারেন্স ভেলু কমপেয়ার করেছি মাত্র। আমরা তো এটাকে জাতীয় মানদণ্ড হিসেবে প্রকাশ করিনি।’

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. সাজেদুল করিম সরকার বলেন, ‘এটা কোনো কারণে মিসিং হয়ে যেতে পারে। বিষয়টি আমরা দেখব। রেফারেন্সে চই ইয়া ইনের বিস্তারিত আমরা যুক্ত করব।’

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য (খাদ্য শিল্প বা খাদ্য উৎপাদন) প্রফেসর ড. মো. আব্দুল আলীম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্য (রাসায়নিক দূষক, টক্সিন ও ক্ষতিকর অবশিষ্টাংশ) প্রবিধানমালা, ২০১৭ অনুযায়ী কোডেক্স ফুড কোড অনুসারে হাঁস-মুরগির মাংসে ভারী ধাতু বা লেডের (সিসা) সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা ০.১০পিপিএম; অর্থাৎ ১০০পিপিবি। তারা সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা ৬০০০ পিপিবি কোথায় পেলেন?’

এই প্রসঙ্গে জানতে গতকাল কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তার, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য (জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি) মঞ্জুর মোর্শেদ আহমেদ এবং চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) মো: আব্দুল কাইউম সরকারের মোবাইল নম্বরে কল করা হলে তারা রিসিভ করেননি।

এই প্রসঙ্গে জানতে গতকাল বিএআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ারের মোবাইল নম্বরে কল করা হলে তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে গতকাল কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের মোবাইল ফোনে কল করা হয়। তিনি কল রিসিভ প্রশ্ন শুনে কল কেটে দেন। পরে কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। এরপর হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় তার বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। তিনি বার্তা সিন করলেও কোনো উত্তর দেননি।

এই প্রসঙ্গে জানতে গতকাল দুপুরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের মোবাইল নম্বরে কল করা হলে তিনি রিসিভ করে প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে আছেন বলে কল কেটে দেন। পরে সন্ধ্যায় কল করা হলে আর রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় জানতে চাওয়া হলেও কোনো উত্তর দেননি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘‘বিএলআরআইয়ের ‘ডিটেকশন অব হেভি মেটালস ইন ফিড, মিট অ্যান্ড এগ’ শিরোনামের আর্টিকেলটি ২০১৮ সালের। চই ইয়া ইনের গবেষণাটি ২০১২ সালের। তার গবেষণার পক্ষে বিএলআরআই ও বিএআরসি কোনো ধরনের প্রমাণ দিতে না পারায় এটি ভুয়া গবেষণা প্রতিবেদন হিসেবেই প্রতীয়মান হয়েছে। আর বিএআরসি কেন ২০১২ সালের ‘ভুয়া’ গবেষণা থেকে তথ্য নিলো?’’

প্রসঙ্গত, গত ১২ জানুয়ারি জানানো হয়, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও বরিশাল জেলা শহরের খামার ও বাজার থেকে এক হাজার ২০০ মুরগি ও ৩০টি খাদ্য থেকে ৩১৫টি নমুনা নেয়া হয়। গবেষণায় মুরগির মাংসে এনরোফ্লাক্সাসিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন, নিওমাইসিন, টাইলোসিন, কলিস্টিন, এমোক্সাসিলিন এবং সালফাডায়াজিন অ্যান্টিবায়োটিক পরীক্ষার জন্য সেসব নমুনা ভারতের চেন্নাইয়ের এসজিএস ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়। আরও তিনটি অ্যান্টিবায়োটিক ক্লোরামফেনিকল, অক্সিটেট্রাসাইক্লিন এবং ডক্সিসাইক্লিন ও তিনটি ভারী ধাতু আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম ও লেড পরীক্ষা করা হয় সাভারে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাবরেটরিতে।